১৫৭. জটাসুর-বধপর্ব্বাধ্যায়

১৫৭তম অধ্যায়

জটাসুর-বধপর্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবেরা পার্থের আগমনপ্রতীক্ষায় বিশ্বস্ত-মনে ব্রাহ্মণগণের সহিত কৈলাসপর্ব্বতে বাস করিতে লাগিলেন। ভীমসেনাত্মজ ঘটোৎকচ ও অন্যান্য রাক্ষসেরা তাঁহাদিগের নিকট বিদায়গ্ৰহণপূর্ব্বক স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিল। ইত্যবসরে দুরাত্মা জটাসুর ভীমের অগোচরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদীকে হরণ করিতে একান্ত অভিলাষী হইল এবং তদ্বিষয়ে কৃতকাৰ্য্য হইবার নিমিত্ত পাণ্ডবদিগের ধনু ও তূণীরগ্রহণের সমুচিত অবসর অনুসন্ধান করিতে লাগিল। অনন্তর সে আপনাকে সর্ব্বশাস্ত্ৰবিশারদ, মন্ত্রকুশল ব্ৰাহ্মণ বলিয়া পরিচয় প্রদানপূর্ব্বক প্রতিদিন পাণ্ডবগণের উপাসনা করিতে আরম্ভ করিল। মহারাজ যুধিষ্ঠির তাহাকে ভস্মাচ্ছন্ন অনলের ন্যায় অনুধাবনে অসমর্থ হইয়া পরমসমাদরে ভরণপোষণ করিতে লাগিলেন।

অস্ত্ৰাদিসহ জটাসুরের পাণ্ডবহরণ

একদা ভীমসেন মৃগয়ার্থ নিৰ্গত হইলে এবং লোমশ প্রভৃতি মহর্ষিগণ কেহ স্নানার্থ, কেহ বা পুষ্পচয়নার্থ গমন করিলে পর এই সুযোগে জটাসুর বিকটাকার পরিগ্রহ করিয়া সমস্ত অস্ত্রশস্ত্ৰ, পাণ্ডবত্রয় ও দ্রৌপদীকে হরণপূর্ব্বক প্রস্থান করিল। সহদেব সাতিশয় যত্নসহকারে অপসৃত হইয়া বিক্রমপ্রকাশ্যপূর্ব্বক শক্ৰহস্ত হইতে সাক্ষাৎ কালস্বরূপ কোষনিষ্কাশিত খড়্গ গ্রহণ করিলেন এবং মহাবীর ভীমকে মুক্তকণ্ঠে আহ্বান করিতে লাগিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির জটাসুরকে কহিলেন, “হে মূঢ়! তুমি প্রকৃত তত্ত্ব অনুধাবন করিতেছ না, তোমার ধর্ম্মক্ষয় হইতেছে; মনুষ্য, পশু,পক্ষী, বিশেষতঃ রাক্ষসেরা, সকলেই ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া থাকে, রাক্ষসেরা ধর্ম্মের মূল, তাহারা ধর্ম্মের প্রকৃত মর্ম্ম অনুধাবন করে। এক্ষণে তুমি এই সমস্ত পৰ্য্যালোচনা করিয়া আমার সমীপে অবস্থান করিতে পার। দেবতা, পিতৃগণ, ঋষি, সিদ্ধ, রাক্ষস, গন্ধর্ব্ব, উরগ, পশু, পক্ষী, অন্যান্য তিৰ্য্যগ্‌যোনিগত কীট ও পিপীলিকারা মনুষ্যকে আশ্রয় করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করে, তুমিও সেই মনুষ্য হইতে জীবিকানির্ব্বাহ করিতেছ। মনুষ্যের সমৃদ্ধিদ্বারা তোমরা সুসম্পন্ন হইতেছ। দেবতারা মনুষ্যকর্ত্তৃক বিধিপূর্ব্বক প্রদত্ত হব্যকব্যদ্বারা পূজিত হইয়া পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকেন; অতএব মানবগণ শোকাভিভূত হইলে দেবতারা অবশ্যই শোকাকুল হইবেন। রাজ্য অরক্ষিত হইলে সুখসম্পত্তিলাভের সম্যক ব্যতিক্রম ঘটিয়া উঠে। হে রাক্ষস! এ নিমিত্ত আমরা রাজ্যের রক্ষা করিয়া থাকি, নিরপরাধ ভূপালগণের অবমাননা করা রাক্ষসদিগের নিতান্ত অবিধেয়। আমরা তোমাদিগের বিপ্ৰিয়াচরণ করি নাই, বরং প্ৰণতিপর হইয়া শক্তি অনুসারে ব্রাহ্মণ ও গুরুলোকদিগকে বিঘস [পরার্থ পক্ক বৈধ অন্ন-বিশুদ্ধ অন্ন] ভোজন করাইয়া থাকি। হে দুর্ব্বদ্ধে! মিত্র ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির প্রতি কদাচ অনিষ্টাচরণ করিবে না এবং যাহাদিগের অন্নভোজন ও আলয়ে অবস্থান করিতে হয়, তাহাদিগের অপকার করা নিতান্ত গৰ্হিত ও দোষাবহ। তুমি আমাদিগের আলয়ে পরমসুখে ও সমাদরে বাস করিয়া অন্ন-পানদ্বারা প্ৰতিপালিত হইতেছে; অতএব এক্ষণে কি নিমিত্ত আমাদিগকে হরণ করিতে অভিলাষ করিয়াছ? তুমি অতি দুরাচার ও দুর্ম্মতি, তুমি বৃথা বর্দ্ধিত হইয়াছ; তোমার জীবনে কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, অদ্য তোমার মৃত্যু সন্নিকৃষ্ট হইয়াছে। যদি তোমার নিতান্ত মন্দবুদ্ধি উপস্থিত হইয়া থাকে বা সর্ব্বধর্ম্মবিবর্জ্জিত হইয়া থাক, তাহা হইলে এক্ষণে অস্ত্রশস্ত্র প্রদানপূর্ব্বক আমাদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া দ্রৌপদীকে হরণ কর। আর তুমি যদি অজ্ঞানবশতঃ এই কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিয়া থাক, তাহা হইলেও ইহলোকে কেবল অধর্ম্মভাগী ও অযশস্বী হইতে হইবে। অদ্য তুমি দ্রৌপদীকে স্পর্শ করিয়া কুম্ভে কালকূট আলোড়নপূর্ব্বক পান করিয়াছ।”

এই বলিয়া রাজা যুধিষ্ঠির নিতান্ত দুর্ভর ভার ধারণ করিলে রাক্ষস গুরুভার একান্ত আক্রান্ত হইয়া পূর্ব্ববৎ শীঘ্ৰ গমন করিতে অসমর্থ হইল। তখন রাজা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী ও নকুলকে কহিলেন, “তোমরা রাক্ষস হইতে শঙ্কিত হইও না, আমি ইহার গতিশক্তি অপহরণ করিয়াছি, মহাবাহু ভীমসেন অতি দূরবর্ত্তী নহেন, তিনি এই মুহুর্তেই উপস্থিত হইয়া ইহার প্রাণসংহার করিলেন।”

অনন্তর সহদেব সেই মূঢ়চেতন রাক্ষসকে লক্ষ্য করিয়া যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! ক্ষত্ৰিয়েরা যুদ্ধে উদ্যত হইয়া শত্রুবিনাশ বা শরীর পতন করিবে, ইহা অপেক্ষা তাহাদিগের সৎকাৰ্য্য আর কি আছে? এক্ষণে রাক্ষস, আমাদিগকে বধ করুক বা আমরাই রাক্ষসকে রণস্থলে সংহার করি, যাহা হয় হইবে। অধুনা যুদ্ধের দেশ-কাল সমুপস্থিত, আমাদিগের ক্ষাত্রধর্ম্মেরও সমুচিত অবসর প্রাপ্ত হইয়াছি, ইহাতে আমরা পরাজয় বা জয়লাভ করি, উভয়দিকেই সদগতিপ্রাপ্ত হইব। অদ্য যদি এই রাক্ষস জীবিত থাকিতে দিবাকর অস্তাচলে গমন করেন, তাহা হইলে আমি আপনাকে ক্ষত্ৰিয় বলিয়া পরিচয় প্ৰদান করিব না। আরে দুরাচার রাক্ষস ! স্থির হ; আমি পাণ্ডুসূত সহদেব, আমাকে বিনাশ করিয়া দ্রৌপদীকে হরণ কর, নতুবা তোরে সদ্যই বিনষ্ট হইয়া এই রণস্থলে শয়ন করিতে হইবে।”

সহদেব ক্ৰোধাভরে রাক্ষসকে এইরূপ তিরস্কার করিতেছেন, ইত্যবসরে ভীম গদাধারণপূর্ব্বক সবজ্র বাসবের ন্যায় যাদৃচ্ছাক্রমে সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, সহদেব ভূমিস্থ হইয়া রাক্ষসকে তিরস্কার করিতেছেন। পরে কালোপহতচেতাঃ, ইতঃস্তত ভ্ৰমণকারী, দৈববাল-বিনিবারিত এক রাক্ষসকে অন্যান্য ভ্রাতৃগণ ও দ্ৰৌপদীকে হরণ করিতে নিরীক্ষণ করিয়া ক্ৰোধাবিষ্ট হইয়া সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “রে পাপ! আমি পূর্ব্বে শস্ত্রপরীক্ষাকালেই তোর বলবীৰ্য্য সম্যক অবগত হইয়াছি, আমি ইচ্ছা করিলে তোর প্রাণসংহার করিতে পরিতাম, কিন্তু যেহেতু তৎকালে তোকে বিনষ্ট করি নাই, এই নিমিত্ত নিশ্চয় জানিবি, তোর প্রতি আমার তাদৃশ আস্থা নাই। তুই ব্ৰাহ্মণবেশ পরিগ্রহ করিয়া এতদিন প্রচ্ছন্নভাবে ছিলি, কদাচি আমাদিগের অপ্ৰিয়াচরণ করিস নাই, বরং সাধ্যানুসারে আমাদিগের প্রিয়-কাৰ্য্য-সংসাধন করিয়াছিস। তৎকালে তুই অতিথি বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলি, আমি তখন বিনাপরাধে কি প্রকারে সংহার করি? এক্ষণে এইরূপ অবস্থায় তোকে নিশ্চয় রাক্ষসবোধ করিয়াও যে বিনাশ করে, তাহার নিশ্চয় নরকপাত হয়; কারণ, তুই বালক, বালককে বধ করিবার বিধি নাই, কিন্তু যখন তোর এইরূপ বুদ্ধি জন্মিয়াছে, তখন নিশ্চয়ই বোধ হয়, তোর শৈশবকাল অতিক্রম হইয়াছে। যেমন সরোবরস্থ মৎস্য সূত্রাবলম্বিত বড়িশ গ্রাস করিয়া প্ৰাণপরিত্যাগ করে, তদ্রূপ তুই কৃতান্তদত্ত কালসূত্রগ্রথিত দ্রৌপদীহরণরূপ বড়িশ গ্ৰাস করিয়াছিস, এক্ষণে কিরূপে প্রাণরক্ষা করিবি? তুই যে প্রদেশে গমন করিতে উদ্যত হইয়াছিস, তথায় অগ্ৰেই তোর মন গমন করিয়াছে; তোকে আর গমনক্লেশ স্বীকার করিতে হইবে না, তুই এক্ষণে বকাহিড়িম্বের পথে প্রস্থান করিবি।”

ভীমসহ জটাসুরের যুদ্ধ

রাক্ষস ভীমসেনকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ভীতমনে তাঁহাদিগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইল এবং রোষাভরে অধর কম্পিত করিয়া ভীমকে কহিল, “রে পাপ! আমি অনায়াসেই যাইতে পারিতাম, কেবল তোর নিমিত্ত বিলম্ব করিতেছি। তুই রণস্থলে যে সমস্ত রাক্ষসকে সংহার করিয়াছিস, অদ্য তোর রুধিরধারায় তাহাদিগের তপণ করিব।” এই কথা শ্রবণ করিবামাত্ৰ ভীমসেন সাক্ষাৎ কালান্তক যমের ন্যায় ক্ৰোধাভরে সৃক্কণীলেহন ও বাহ্বাস্ফোটনপূর্ব্বক রাক্ষসের প্রতি ধাবমান হইলেন। বলি যেমন দেবরাজ ইন্দ্রের অভিমুখে ধাবমান হইয়াছিলেন, রাক্ষসও সেইরূপ ক্রোধাবেশে বারংবার মুখবাদান ও সৃক্কণীলেহন করিয়া যুদ্ধাভিলাষী ভীমের প্রতি ধাবমান হইল; উভয়ের নিদারুণ বাহুযুদ্ধ হইতে লাগিল। ইত্যবসরে মাদ্রীতনয় নকুল ও সহদেব ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভীমসেনের সাহায্যের নিমিত্ত ধাবমান হইলেন। বৃকোদার সহাস্যমুখে তাহাদিগকে নিবারণ করিয়া কহিলেন, “আমি একাকীই রাক্ষসকে সংহার করিতে সমর্থ হইব; তোমরা উভয়ে কেবল অবলোকন কর। আমি এক্ষণে আত্মা, ভ্রাতৃগণ, ধর্ম্ম, সুকৃতি ও যজ্ঞদ্বারা শপথ করিয়া কহিতেছি, নিশ্চয়ই এই রাক্ষসকে বিনাশ করিব।”

ভীমকর্ত্তৃক জটাসুরবধ

অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত বীরদ্বয় স্পর্দ্ধা করিয়া পরস্পর পরস্পরকে বাহুদ্বারা বেষ্টন করিলেন এবং একান্ত অসহমান হইয়া ত্রোধভরে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা জলধরের ন্যায় গভীর গর্জ্জন ও সিংহনাদ পরিত্যাগ করিয়া পরস্পরের প্রতি বৃক্ষোৎপাটনপূর্ব্বক নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা কখন ক্ৰোধে একান্ত অধীর ও পরস্পরের বধে কৃতসঙ্কল্প হইয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন; তাঁহাদিগের উরুদেশের আঘাতে বৃক্ষ-সকল ভগ্ন হইতে লাগিল। পূর্ব্বে যেমন বালী ও সুগ্ৰীব ভাৰ্য্যার্থী হইয়া ঘোরতর সংগ্ৰাম করিয়াছিলেন, সেইরূপ ইহারাও উভয়ে মহীরুহবিনাশন বৃক্ষযুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা মুহুর্মুহুঃ সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক মহীরুহ-সকল বিঘূর্ণিত করিয়া মুহূর্ত্তকাল পরস্পর প্রহার করিলেন। এইরূপে তত্রস্থ বৃক্ষসমুদয় নিপতিত ও জর্জ্জরিত হইল। অনন্তর যেমন পর্ব্বতযুগল জলধরজালদ্বারা যুদ্ধ করে, সেইরূপ তাঁহারাও ক্রোধাভিভূত হইয়া তীব্রবেগে বজ্রর ন্যায়। উগ্ররূপ অতি প্ৰকাণ্ড উপল [প্রস্তর] খণ্ডদ্বারা প্রহার করিতে লাগিলেন; পরে মাতঙ্গের ন্যায় বলদৃপ্ত ও ধাবমান হইয়া বাহুযুগলদ্বারা পরস্পর আকর্ষণ ও দৃঢ়তর মুষ্টিদ্বারা প্রহার করিতে আরম্ভ করিলে রণস্থলে অনবরত কটকটা শব্দ শ্রুত হইতে লাগিল।

ইত্যবসরে মহাবীর ভীমসেন পঞ্চশীর্ষ উরগের ন্যায় মুষ্টি সঙ্কুচিত করিয়া মহাবেগে রাক্ষসের গ্ৰীবাদেশে প্রহার করিলেন এবং প্রহার বেগে তাহাকে একান্ত ক্লান্ত ও নিতান্ত পরিশ্রান্ত অবলোকন করিয়া সমধিক উৎসাহাযুক্ত হইলেন। পরে রাক্ষসকে উৎক্ষিপ্ত ও পৃথিবীকে নিষ্পেষিত করিয়া তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-সকল চুর্ণীকৃত করিয়া তলপ্রহারদ্বারা শিরচ্ছেদন করিলেন। জটাসুরের সন্দষ্টধর [দন্তদ্বারা অধরদংশন] ও বিবৃত্তনয়নসংযুক্ত মস্তক শোণিতলিপ্ত হইয়া বৃক্ষের ফলের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইল। তখন ভীমসেন ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্রের ন্যায় দ্বিজাতিগণকর্ত্তৃক স্তুয়মান হইয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সন্নিধানে আগমন করিলেন।

জটাসুরবধপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।