১৯৯. মার্কণ্ডেয়কর্ত্তৃক দানবমাহাত্ম্যকীর্ত্তন

১৯৯তম অধ্যায়

মার্কণ্ডেয়কর্ত্তৃক দানবমাহাত্ম্যকীর্ত্তন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ!! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়মুখে রাজর্ষি ইন্দ্ৰদ্যুম্নের পুনরায় স্বৰ্গপ্রতিপাদন-বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে তপোধন!! গাৰ্হস্থ্য, বাল্য, যৌবন ও বাৰ্দ্ধক্য এই অবস্থাচতুষ্টয়মধ্যে কোন অবস্থায় দান করিলে ইন্দ্ৰলোকপ্ৰাপ্তি হইয়া থাকে এবং উহার ফলশ্রুতিই বা কিরূপ, আপনি তাহা কীর্ত্তন করুন।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “অপুত্র ব্যক্তির জন্ম, জাতিবহিস্কৃতের [জাতিচ্যুতের] জন্ম, পরান্নভোজীর জন্ম এবং যে ব্যক্তি কেবল আপনার নিমিত্ত পাক করে, তাহার জন্ম, এই চারিপ্রকার জন্ম নিতান্ত নিষ্ফল। বাল, বৃদ্ধ ও অতিথিকে আহার না করাইয়া স্বয়ং আহার করিলে তাহা অসত্য বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি যাবজ্জীবন ব্রহ্মচর্য্যব্রত অবলম্বনে সঙ্কল্প করিয়া পরিশেষে অকৃতকাৰ্য্য হইয়াছে, তাহাকে যে দান করা যায়, উহা নিষ্ফল; যে বস্তু অন্যায়পূর্ব্বক উপার্জ্জিত হইয়াছে, তাহা দান করিলে কোন ফলোদয় হয় না। পতিত ব্ৰাহ্মণ, তস্কর, মিথ্যাবাদী গুরু, পাপকারী, কৃতঘ্ন, গ্রামযাজক, বেদবিক্রেতা, শূদ্ৰপাচক বৃষলীপ ত [শূদ্রার পতি] ও বৃত্তাধ্যয়নশূন্য ব্রাহ্মণনামধারী [ব্রাহ্মণের আচার অনুষ্ঠানহীন-নামেমাত্র ব্রাহ্মণ] ব্রাহ্মণকে দান করিলে কোন ফলোদয় হয় না। আর স্ত্রীলোক, আহিতুণ্ডিক [ব্যালগ্ৰাহী-সাপুড়িয়া] ও পরিচারককে দান করিলে তাহারও কোন ফলোপধায়কতা নাই। হে মহারাজ! এই ষোড়শ প্রকার বৃথা দান কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে আরও যে ব্যক্তি মোহাচ্ছন্ন হইয়া ভয় বা ক্ৰোধ-প্ৰযুক্ত দান করে এবং যে ব্যক্তি বিনয়নম্র হইয়া ব্ৰাহ্মণকে প্রতিগ্রহ করায়, সে গর্ভস্থ হইয়া সেই সকল দানফল উপভোগ করে, অতএব স্বৰ্গমার্গ-জিগীষাপরবশ হইয়া সকল অবস্থাতেই ব্রাহ্মণকে দান করা কর্ত্তব্য।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! বৰ্ণ-চতুষ্টয়মধ্যে প্রতিগ্রহপ্রণয়ী [দানগ্রহণপ্রিয়] ব্রাহ্মণেরা কিরূপ বিশেষ কাৰ্য্যবশতঃ অন্যকে ও আপনাকে উদ্ধার করিয়া থাকেন?” মার্কণ্ডেয় কহিলেন “হে মহারাজ! ব্রাহ্মণেরা জপ, মন্ত্র, হোম, স্বাধ্যায়দ্বারা বেদময়ী তরণী প্ৰস্তুত করিয়া অন্যকে ও আপনাকে উদ্ধার করেন; ব্রাহ্মণগণের তুষ্টি-সম্পাদন করিলে দেবতারা সাতিশয় প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া থাকেন। ব্ৰাহ্মণগণের বাক্যবলেই লোকে স্বৰ্গলোক লাভ করিতে সমর্থ হয়। জ্ঞানশূন্য, শ্লেষ্ম ক্লন্নকলেবর ও ত্ৰিয়মাণ হইলেও তুমি পিতৃগণ, দেবগণ ও ব্রাহ্মণগণকে অৰ্চনা করিয়া নিঃসন্দেহে অনন্ত পুণ্যলোক প্রাপ্ত হইবে। স্বৰ্গলাভ-প্রত্যাশায় ব্রাহ্মণগণের অর্চনা করিবে, শ্ৰাদ্ধকালে অনিন্দিত ব্ৰাহ্মণদিগকে ভোজন করাইবে। বিবর্ণ, কুনখী, কুষ্ঠী, মায়াবী কুণ্ড [জারজ], গোলক [জারজ] ও শরতূণীরধারী ব্রাহ্মণকে শ্ৰাদ্ধকালে প্ৰযত্নপূর্ব্বক পরিত্যাগ করিবে। যাদৃশ হুতাশন কাষ্ঠভার দগ্ধ করিয়া থাকে, তদ্রূপ দোষস্পৰ্শ-বিশিষ্ট শ্ৰাদ্ধ সমুদয় কর্ম্মফল ভস্মসাৎ করে। শ্ৰাদ্ধকালে মূক, অন্ধ ও বধির ব্রাহ্মণদিগকে অন্যান্য বেদবেদাঙ্গপারগ বিপ্রদিগের সহিত একত্ৰ মিলিত করিয়া নিয়োগ করিবে। হে মহারাজ! এক্ষণে কি প্রকার বিপ্ৰকে প্রতিগ্রহ প্ৰদান করিবে, তাহাও কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর ।

“যিনি স্বশাক্ত্যনুসারে প্রদাতা ও আপনাকে উদ্ধার করিতে সমর্থ হয়েন, সর্ব্বশাস্ত্ৰবিশারদ ব্যক্তি তাঁহাকেই দান করিবেন। বহ্নি যেমন অতিথি ভোজন করাইলে সন্তুষ্ট হয়েন, তদ্রূপ হবিদ্বারা হোম, কুসুম ও অনুলেপনদ্বারা সন্তোষলাভ করেন না। যাহারা পাদোদক [পা ধুইবার জল], পাদ্ঘৃত [পায়ে মাখিবার ঘৃত], দীপ, অন্ন ও আশ্রয় দান করে, তাহাদিগকে যমালয়ে গমন করিতে হয় না। দেবনির্ম্মাল্য অপনয়ন, দ্বিজেচ্ছিষ্টমার্জ্জন, গন্ধাদিদ্বারা অলঙ্করণ ও গাত্ৰসংবাহন ইহার এক একটি কাৰ্য্য গোদান অপেক্ষাও গুরুতর। হে রাজন! কপিল প্রদান করিলে লোক সঞ্চিতপাপ হইতে বিনির্মুক্ত হইয়া মুক্তিপদ প্রাপ্ত হয়, অতএব গৃহস্থ দারাপুত্র প্রভৃতি পোষ্যবর্গের ভরণপোষণে একান্ত অভিভূত, উপকার সমর্থ, অগ্নিহোত্রী শ্রোত্রিয়কে অলঙ্কৃত কপিলা দান করিবে। হে মহারাজ! সুসম্পন্নকে দান করিলে কোন গুণই দর্শে না।

“এক ব্যক্তিকে একটি গো প্ৰদান করিবে, অনেক ব্যক্তিকে কদাচ একটি গো দান করিবে না; কারণ, সেই ধেনু বিক্রীত হইলে বিক্রেতার তিন পুরুষ পর্য্যন্ত বিনাশপ্রাপ্ত হইয়া থাকে, ফলতঃ এইরূপ দান দাতা ও গ্রহীতাকে উদ্ধার করিতে সমর্থ হয়। তিনি ব্রাহ্মণকে বিশুদ্ধস্বর্ণ-নির্ম্মিত সুবর্ণ [তিন রতির অধিক পরিমাণ ভূষণ] প্রদান করে, তাঁহার শাশ্বত সুবৰ্ণশত-প্রদানের ফললাভ হয়। যিনি ধুরন্ধর বলবান বলীবর্দ্দ প্ৰদান করেন, তিনি দুৰ্গম প্রদেশসকল অনায়াসে উত্তীর্ণ ও স্বৰ্গলোক প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। যিনি স্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রাহ্মণকে ভূমি প্ৰদান করেন, তাঁহার বাসনাসকল সফল হয়।

“যাহারা গমনকালে ক্ষীণকলেবর ও ধূলিধূসরপাদ হইয়া অন্নদাতার অনুসন্ধান করে এবং যাহারা সেই সমস্ত ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত লোকদিগকে অন্নলাভের উপায় নির্দেশ করিয়া থাকেন, সেই নির্দেষ্টাও অন্নদাতার তুল্য বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়া থাকেন। অতএব মহারাজ! তুমিও অন্য দান পরিত্যাগপূর্ব্বক অন্নদান কর। ভূলোকে অন্নদান অপেক্ষা পুণ্যতম কর্ম্ম আর কিছুই নাই। যিনি স্বশক্ত্যনুসারে বিপ্রগণকে সুসংস্কৃত অন্ন দান করেন, তাঁহার ব্ৰহ্মলোকলাভ হইয়া থাকে। অন্নই একমাত্র উৎকৃষ্ট; অন্ন অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই। অন্ন সাক্ষাৎ প্রজাপতি বলিয়া অভিহিত হইয়াছে ও উহাকেই সংবৎসর যজ্ঞ বলিয়া নির্দেশ করে। সেই সংবৎসর যজ্ঞে সমস্ত বস্তুই প্রতিষ্ঠিত আছে; এই নিমিত্ত তাহাতেই স্থাবর, জঙ্গম প্রভৃতি ভূতসকল প্রতিষ্ঠিত হইয়া রহিয়াছে, অতএব অন্নই সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট, তাহার সন্দেহ নাই।

“যাঁহারা অগাধসলিল তড়াগ, হ্রদ, বাপী, কৃপ, গৃহ ও অন্ন প্রদান করেন; যাঁহাদিগের বাক্য অতি মধুর, তাহাদিগের আর কৃতান্তের ভয় থাকে না। যিনি সুশীল ব্রাহ্মণকে শ্রমোপার্জ্জিত অর্থদ্বারা সঞ্চিত ধান্য প্রদান করেন, বসুন্ধরা তাঁহার প্রতি সমধিক সন্তুষ্ট হইয়া ধনধারা বিসর্জ্জন করিয়া থাকেন। হে মহারাজ! অন্নদাতা, সত্যবাদী ও অযাচিত-প্রদাতা এই তিন ব্যক্তি অনুক্রমে 
সমলোক লাভ করিয়া থাকেন।”
 

যমলোকের পথ-পরিচয়—তৎসুগমতা

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির অনুজবর্গের সহিত একান্ত কুতূহলপরতন্ত্র হইয়া মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে তপোধন! যমলোকের পথ ও যমলোক হইতে মনুষ্যলোকের অন্তর কি প্রকার এবং তাহার প্রমাণই বা কি? মনুষ্যেরা কোন উপায়দ্বারা উহা উত্তীর্ণ হইয়া থাকে? আপনি এই সমস্ত সবিস্তরে কীর্ত্তন করুন।”

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! এই প্রশ্ন ঋষি প্রশংসিত, পবিত্ৰ, সকলের গোপনীয় ও ধর্ম্মসঙ্গত, এক্ষণে আমি ইহা কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

“যমলোকের পথ ও মনুষ্যলোকের সীমা ষড়শীতিসহস্ৰ যোজন পরিমিত। উহা কেবল শূন্যময় ও কান্তারের ন্যায় অতি ভীমদৰ্শন। তথায় মনুষ্যেরা নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া ক্লান্তি দূর করিতে পারে, এরূপ বৃক্ষচ্ছায়া বা গৃহ ও সলিলের সম্পর্কও নাই। সেই পথ দিয়া যমদূতেরা বলপূর্ব্বক পৃথিবীন্থ জীবজন্তুদিগকে লইয়া যায়।

“যাহারা ব্রাহ্মণগণকে উৎকৃষ্ট অশ্বাদি প্রদান করিয়াছে, তাহারাই সেই সমস্ত যানে আরোহণ করিয়া ঐ দুৰ্গমবার্ত্ম অতিক্রম করিয়া থাকে। ছত্ৰদাতা ছত্ৰদ্বারা আতপ নিবারণ করিয়া গমন করে; অন্নদাতা পরিতৃপ্ত হইয়া সেই পথে গমন করিয়া থাকে; অন্নদাতা সবস্ত্র ও বস্ত্ৰদানপরাঙ্মুখ ব্যক্তি বিবস্ত্ৰ হইয়া গমন করে; হিরণ্যদাতা বহুবিধ অলঙ্কারে অলঙ্কৃত ও ভূমিদাতা পূৰ্ণমনোরথ হইয়া প্ৰস্থান করে; শস্যপ্ৰদ ব্যক্তি অপরিক্লিষ্টভাবে এবং গৃহদাতা বিমানে আরোহণ করিয়া পরমসুখে গমন করিয়া থাকে; পানীয়দাতা পিপাসাক্লেশশূন্য হইয়া সন্তুষ্টচিত্তে গমন করে; দীপপ্রদ ব্যক্তি গমনপথ সমুজ্জ্বল করিয়া গমন করে এবং গোপ্রদাতা সর্ব্বপাপবির্নিমুক্ত হইয়া পরমসুখে সঞ্চরণ করিতে থাকে। মাসোপবাসী হংসসংযুক্ত ও ষষ্ঠরাত্রোপবাসী ময়ূরবারযোজিত বিমানে আরোহণ করিয়া সুখস্বচ্ছন্দে গমন করে। যে ব্যক্তি একাহারী হইয়া রজনীত্ৰয় যাপন করে, তাহার লোকসকল অনাময় হয়।

“তথায় পুষ্পোদকানামে এক স্রোতস্বতী প্রবাহিত হইতেছে, পানীয়দাতা পুণ্যাত্মারা তাহার দিব্যগুণসম্পন্ন প্রেতলোক-সুখাবহ সুশীতল সলিল পান করিয়া থাকেন, কিন্তু কুক্রিয়াসক্ত ব্যক্তিদিগের পক্ষে তাহা পূয়পূর্ণ বোধ হয়। এইরূপে ঐ নদী মনুষ্যের বাসনাসকল সফল করিয়া থাকে। হে মহারাজ! এক্ষণে তুমি ব্রাহ্মণগণকে বিধিপূর্ব্বক পূজা কর। যিনি পথপর্য্যটনশ্রমে ক্ষীণকলেবর ও ধূলিপটলে পরিপূর্ণাঙ্গ হইয়া অন্নদাতার অনুসন্ধান বা ভোজনপ্রাপ্তির আশায় গৃহপ্ৰবেশ করেন, সেই অতিথি ব্ৰাহ্মণকে প্ৰযত্নাতিশয়সহকারে পূজা করিবে। অতিথি ব্রাহ্মণ গমন করিলে ইন্দ্ৰাদি দেবগণ তাঁহার অনুগমন করিয়া থাকেন, তিনি পূজিত হইলে তাঁহারা প্রীত হয়েন এবং তিনি পূজিত না হইলে তাহারা সাতিশয় নিরাশ হয়েন। হে মহারাজ! এই সমস্ত সবিস্তরে কীর্ত্তন করিলাম, এক্ষণে আর কি শুনিতে অভিলাষ হয়, বলুন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ধর্ম্মজ্ঞ! আপনি ধর্ম্মার্থ-সঙ্গত পাপনাশক পবিত্ৰ কথাসকল বারংবার কীর্ত্তন করুন; উহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত অভিলাষ হইয়াছে।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! সর্ব্বপাপাপনোদন ধর্ম্মার্থসম্বন্ধ কথা-সকল কীর্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর।”

মার্কণ্ডেয়-মুখে যুধিষ্ঠিরের বিবিধ ধর্ম্মকথা-শ্রবণ

“সর্ব্বপ্রধান পুষ্করতীর্থে কপিলা প্ৰদান করিলে যে ফল হইয়া থাকে, ব্ৰাহ্মণের পাদধাবনে তাহাই লাভ হয়। মেদিনী যাবৎকাল দ্বিজপাদপ্রক্ষালন-জলে পঙ্কিল থাকে, তাবৎ পিতৃলোকেরা পদ্মাপলাশ-দ্বারা [পদ্মের পাতা] জলপান করেন। অতিথি ব্ৰাহ্মণকে স্বাগত-প্ৰশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে হুতাশন, আসনপ্রদানে দেবরাজ, পাদপ্রক্ষালনে পিতৃলোক ও অন্নাদিদানে প্রজাপতি ব্ৰহ্মার সাতিশয় তৃপ্তিসাধন হইয়া থাকে। যখন বৎসের পাদ ও মস্তক পরিদৃশ্যমান হইবে, তদবসরে প্রযতমনে সেই প্রসবোম্মুখী গো দান করিলে পৃথিবীদানের ফল হয়; কারণ, যতক্ষণ পৰ্য্যন্ত অন্তরীক্ষগত বৎস যোনিদেশে বাস করিয়া থাকে, তাবৎকালে সেই ধেনু পৃথিবীতুল্য হয়। এইরূপ ধেনুদান করিলে ধেনু ও বৎসের গাত্রে যতগুলি লোম থাকে, দাতা তৎসমসংখ্য-সহস্ৰ যুগ স্বৰ্গলোকে পূজিত হয়। খুরযুক্ত কৃষ্ণবর্ণ ধেনুকে সুবর্ণনির্ম্মিত নাসাসম্পন্ন, তিলপ্রচ্ছাদিত ও নানাবিধ রত্নে অলঙ্কৃত করিয়া প্ৰদান করিবে। যিনি প্রতিগ্ৰহ করিয়া কোন সাধু লোককে ঐ গৃহীত বস্তু প্ৰদান করেন, তাঁহার প্রতিগ্রহজনিত ফলেরও ফললাভ হয়। ফলতঃ এইরূপ অনুষ্ঠান করিলে দরীসমুদ্র-শৈলকাননসম্পন্ন চতুরন্ত [চতুঃসাগরী-চতুর্দ্দিকে সাগরবেষ্টিতা সমস্ত পৃথিবী] পৃথিবীদানের তুল্য হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই। যে ব্ৰাহ্মণ জানুদ্বয়ের অভ্যন্তরে একহস্তদ্বারা ভোজনপত্র অবলম্বনপূর্ব্বক নিঃশব্দে অন্য হস্তে আহার করিয়া থাকেন, যাঁহাদিগকে কেহ পাপাচারপর বলিয়া না জানে ও যাঁহারা সম্যকপ্রকারে সংহিতা জপ করিয়া থাকেন, তাঁহারাই লোকোদ্ধারে সমর্থ হয়েন। সচ্চরিত্র শ্রোত্ৰিয় সমস্ত হব্যকব্যেরই অধিকারী, অতএব শ্রোত্রিয়ে হব্যাকব্যপ্ৰদান প্রজ্বলিত হুতাশনে আহুতিদানের তুল্য ফলপ্ৰদ হইয়া থাকে। বিপ্ৰগণের ক্রোধই অস্ত্র। তাঁহারা কদাচি সামান্য অস্ত্ৰদ্বারা প্রহার করেন না। যেমন দেবরাজ বজ্রদ্বারা অসুরগণকে সংহার করিয়াছেন, সেইরূপ ব্রাহ্মণেরও ক্ৰোধাস্ত্র ধারণপূর্ব্বক সমুদয় বিনাশ করিতে পারেন। হে মহারাজ! নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণ যাহা শ্রবণ করিয়া প্রীতিলাভ করিয়া থাকেন, আমি ধর্ম্মার্থসম্বন্ধ সেই সমস্ত কথা কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। উহা কৰ্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইলে মনুষ্যেরা বিগত-শোকভয় ও বীতপাপ হইয়া মুক্তিলাভ করিয়া থাকে।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে তপোধন! ব্রাহ্মণগণ যদ্বারা সতত বিশুদ্ধ হইয়া থাকেন, সেই শৌচ কি প্রকার? আপনি তাহা কীর্ত্তন করুন; শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! বাকশৌচ, কর্ম্মশৌচ ও জলশৌচ এই তিনপ্রকার শৌচদ্বারা সতত বিশুদ্ধভাবসম্পন্ন হইয়া ব্রাহ্মণ স্বৰ্ণলাভ করিয়া থাকেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। যিনি সায়ং ও প্ৰাতঃকালে সন্ধ্যোপাসনা করেন এবং বেদমাতা পবিত্র দেবীর গায়ত্রী জপ করিয়া থাকেন, তিনি বিগতপাপ হইয়া এই সসাগরা ধরা পরিহ্রহ করিলেও অবসন্ন হয়েন না, তাঁহার পক্ষে অন্তরীক্ষে চন্দ্র, সূৰ্য্য প্রভৃতি যে-সকল অশুভ গ্রহ বিদ্যমান থাকে, তৎসমুদয় শুভপ্ৰদ এবং শিবগণও শিবপ্রদ হইয়া উঠে। ঘোররূপ মহাকায় রাক্ষসেরা তাহাকে কদাচ পরাভব করিতে সমর্থ হয় না।

“ব্রাহ্মণের প্রজ্বলিত হুতাশনের তুল্য; আধ্যাপন, যাজন বা কোনপ্রকার প্রতিগ্রহদ্বারা তাঁহাদিগকে কোনরূপ দোষ স্পর্শ করিতে পারে না। ব্ৰাহ্মণগণ বেদানভিজ্ঞ হউন, বা বেদজ্ঞ হউন, সামান্যই হউন, বা সংস্কৃতই হউন, ভস্মাচ্ছন্ন অনলের ন্যায়, তাহাতে সন্দেহ নাই; তাঁহাদিগকে কদাচ অবমাননা করিবে না। যাদৃশ শ্মশানদেশে প্রদীপ্ত পাবক দোষাবহ নহে, সেইরূপ ব্ৰাহ্মণ বিদ্বান হউন বা মূর্খই হউন, অবশ্যই তাঁহাকে পরামদেবতাস্বরূপ গণ্য করিতে হইবে। রুচির প্রাচীর, উন্নত পুরদ্বার ও নানাবিধ প্রাসাদ সত্ত্বেও ব্রাহ্মণহীন নগরের কোন শোভা নাই। গোষ্ঠই হউক বা অরণ্যই হউক, যথায় বেদবেদাঙ্গপারগ, জ্ঞানবান, সচ্চরিত্র, সর্ব্বশাস্ত্ৰবিশারদ ব্রাহ্মণগণ বাস করিয়া থাকেন, পণ্ডিতেরা তাহাকেই নগর ও তীর্থ বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন। রক্ষক, রাজা ও তপস্বী ব্ৰাহ্মণগণসন্নিধানে উপনীত হইয়া সৎকার করিলে চিরসঞ্চিত পাপ হইতে বিনির্ম্মুক্ত হয়।

শাস্ত্রকারেরা অতি পবিত্র তীর্থে স্নান, পবিত্ৰ বস্তুকীর্ত্তন ও সাধুসহ সম্ভাষণ অতি প্রশস্ত বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। ধর্ম্মপরায়ণ মানবগণ সাধুসঙ্গমপুত অতিমনোহর বাক্যরূপ সলিলদ্বারা আপনাদিগকে প্রতিনিয়ত পবিত্ৰ জ্ঞান করেন। হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! যদি চিত্তশুদ্ধি না হইয়া থাকে, তাহা হইলে ত্ৰিদণ্ডধারণ, মৌনাবলম্বন, জটাভারবহন, শিরোমুণ্ডন, বল্কলাজিনপরিধান, ব্ৰতচৰ্য্যা, অভিষেক, অগ্নিহোত্ৰানুষ্ঠান, অরণ্যবাস ও শরীরশোষণ এই সমুদয় নিষ্ফল হয়। চক্ষুরাদির বিশুদ্ধি ব্যতিরেকে বিষয়োপভোগ সুকর হয়; কিন্তু চক্ষুরাদির বিশুদ্ধিসহকারে বিষয়োপভোগ পরিত্যাগ করা স্বভাবতঃ অতি সুকঠিন; কারণ, চক্ষুরাদির বিকারসমুৎপাদক মন নিতান্ত দুর্জ্ঞেয় ও অপ্রতিশাস্য [শাসনের অযোগ্য—অবশীভূত] । যাঁহারা মন, বাক্য ও কর্ম্মদ্বারা কদাচ পাপাচরণ করেন না, তাহাদিগের অনশনদ্বারা শরীর-শোষণপূর্ব্বক তপস্যা করিবার আবশ্যকতা নাই। যাঁহাদিগের জ্ঞাতিবর্গের প্রতি কিছুমাত্র দয়া নাই, সেই শুক্ৰযোগোপজীবী [জ্ঞাতিদ্রোহী—একই রক্তমাংসসম্বন্ধী জ্ঞাতির নাশকারী] মনুষ্য নিতান্ত পাপপরায়ণ। তাহার সেই নির্দ্দয় ব্যবহারই তপস্যার সম্পূর্ণ বিঘ্ন সম্পাদনা করিয়া থাকে। অতএব কেবল অনশন পরিত্যাগ করিলেই যে তপঃসাধন হয়, এমন নহে।

“হে রাজন! যিনি গৃহস্থাশ্রমে অবস্থানপূর্ব্বক পবিত্ৰভাবসম্পন্ন, গুণগণে অলঙ্কৃত ও সর্ব্বভূতে দয়াবান হয়েন, তিনি চিরসঞ্চিত পাপনিবহ হইতে বিনির্মুক্ত হইয়া থাকেন। অনশনাদিদ্বারা কদাচ পাপকর্ম্ম-সমুদয় বিনষ্ট হয় না; কেবল তৎপ্ৰভাবে এই মাংস-শোণিতময় দেহ ক্রমশঃ অবসন্ন হইয়া থাকে। অজ্ঞাত কর্ম্মের অনুষ্ঠানদ্বারা কেবল ক্লেশপরম্পরাই পরিবর্দ্ধিত হয়; পাপের কিছুমাত্ৰ হানি হয় না। অগ্নি চিত্তশুদ্ধিশূন্য মনুষ্যের অশুভ কর্ম্মসকল দগ্ধ করেন না, কিন্তু লোকসকল স্বকীয় পুণ্যাবলেই প্ৰব্ৰজ্যা অবলম্বন ও বিশুদ্ধ ভাব ধারণ করে, অনশনাদিদ্বারা কোনরূপ ফল সমুৎপন্ন হয় না। ফল-মূল-ভক্ষণ, মৌনাবলম্বন, অনিলাশন, শিরোমুণ্ডন, জটাভার-ধারণ, স্থাবর [স্থায়ী] গৃহত্যাগ, স্থাণ্ডিল বা ধরাশয্যা, নিত্য অনশন, অগ্নিশুশ্রূষা বা জলপ্ৰবেশ ইহার দ্বারা কদাচ জরা, মরণ ও ব্যাধি সকল বিনষ্ট এবং উত্তমগতিপ্ৰাপ্তি হয় না, কেবল জ্ঞান বা কর্ম্মদ্বারা জরা, মরণ ও ব্যাধিসমুদয় নষ্ট এবং উত্তমপদপ্রাপ্তি হইয়া থাকে। যেমন অগ্নিদগ্ধ বীজ-সমুদয় পুনরায় অঙ্কুরিত হয় না, সেইরূপ জ্ঞানদগ্ধ অবিদ্যা প্রভৃতি কখন আর আত্মাকে স্পর্শ করিতে সমর্থ হয় না, কিন্তু আত্মাশূন্য কাষ্ঠকুড্যসম [কাঠের কুঁড়ে–অকিঞ্চিৎকর] দেহ সাগরের ফেনপুঞ্জের ন্যায় নিঃসন্দেহে বিনষ্ট হইয়া থাকে। যিনি সর্ব্বভূতাশায়ী আত্মাকে লাভ করিতে পারেন, পুণ্যফলজনক শ্লোক বা শ্লোকার্দ্ধ পাঠ করিলে তাঁহার সকল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়।

“তত্ত্বং” এই দ্ব্যক্ষর হইতে শাস্ত্রের মর্ম্ম অনুধাবন করিয়া বেদমন্ত্রচিহ্নিত ভিন্ন ভিন্ন শতসহস্র উপনিষদ্‌দ্বারা ‘আমিই ব্রহ্ম’ এইরূপ জ্ঞানই মোক্ষের লক্ষণ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। কোন কোন বেদবিৎ কহেন, পরলোক, ইহলোক ও সুখ-দুঃখ নাই’, এইরূপ জ্ঞানই মোক্ষের লক্ষণ। যিনি বেদাৰ্থ-সমুদয় অবগত হইয়াছেন ও বৈদিক কাৰ্য্যে দক্ষ, যেমন দাবাগ্নি হইতে সকলে ভীত হয়, তদ্রূপ তিনিও বেদোক্ত কর্ম্মের অনুষ্ঠানে উদ্বিগ্ন হয়েন। যদি তুমি বেদবিহিত যুক্তিদ্বারা শ্রুতি ও স্মৃতিসম্বন্ধ তত্ত্ব জানিতে ইচ্ছা কর, তাহা হইলে বৃথাতর্ক পরিত্যাগপূর্ব্বক শ্রুতি বা স্মৃতির আশ্রয় গ্রহণ কর। শম, দম প্রভৃতি সাধনের বিপৰ্য্যয়বশতঃ তত্ত্বজ্ঞান-লাভ হয় না। সাতিশয় যত্নসহকারে তত্ত্বজ্ঞান-লাভ হইলে তাহাকে জানা যাইতে পারে। তত্ত্বই বেদস্বরূপ; বেদও তত্ত্বের শরীর; বেদই তাঁহাকে বিদিত হইবার অদ্বিতীয় উপায়; আত্মা বিপ্ৰকাশ [দুষ্প্রপ্রকাশ—অনায়াস প্রকাশ নহে], তিনি বুদ্ধিতত্ত্বের জ্ঞেয়। দেবগণের দেবত্ব বেদ হইতে প্ৰতিপন্ন, কর্ম্মের শুভাশুভ ফল বেদে কথিত আছে। প্রাণীগণের প্রভাব যুগে যুগে প্রাদুর্ভূত হইতেছে, কিন্তু ইন্দ্ৰিয়াশুদ্ধির দ্বারা উহা পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। যেহেতু, ইন্দ্ৰিয়সংযম দিব্য-অনশনস্বরূপ। তপঃপ্রভাবে স্বাগলাভ ও দানবলে ভোগলাভ, জ্ঞানদ্বারা মোক্ষ ও তীর্থস্নানদ্বারা পাপক্ষয় হয়।”

রাজা যুধিষ্ঠির মহর্ষি-মুখে এই সমস্ত শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “ভগবান! এক্ষণে দানধর্ম্ম শ্রবণ করিতে আমার একান্ত অভিলাষ হইয়াছে; আপনি উহা কীর্ত্তন করুন।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! শ্রুতিস্মৃতিসঙ্গত দানধর্ম্ম গৌরবশতঃ সত্যই আমার অভীষ্ট, এক্ষণে যদি তোমার ইচ্ছা হইয়া থাকে, কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। হস্তীর দেহচ্ছায়ায় তদীয় কর্ণপরিবীজতি [কুলার মত—হাতীর কানের হাওয়া দেওয়া] দ্রব্যাদিদ্বারা শ্ৰাদ্ধ করিলে সেই ফল দশ অযুত কল্প অক্ষয় হয়। যে ব্যক্তি জীবিকা-নির্ব্বাহাৰ্থ অন্নসহিত প্রচুর অর্থ প্ৰদানপূর্ব্বক বৈশ্যকে আশ্রয়দান করেন, তাঁহার সকল-যজ্ঞানুষ্ঠানের ফললাভ হয়। প্রতিকুল-স্রোতবাহিনী স্রোতস্বতীতে অর্থীকে অর্থদান ও অন্নার্থী ইন্দ্রকে অন্নদান করিলে সকল পাপ হইতে বিনির্মুক্ত হইয়া থাকে। উপরাগকালে [গ্রহণসময়ে] ব্ৰাহ্মণকে দধিমণ্ড দান করিলে অক্ষয় ফললাভ হয়। পর্ব্বকালে দান করিলে দ্বিগুণ ফল, বসন্তাদি ঋতুকালে দান করিলে দশগুণ, বৎসরে দান করিলে শতগুণ ও বিষুবসংক্রমে দান করিলে অনন্ত ফললাভ হয় এবং অয়ন ও ষড়শীতিসংক্রমণে দান করিলে অক্ষয় ফললাভ হইয়া থাকে। চন্দ্ৰ-সূৰ্যগ্রহণকালে দান করিলে অক্ষয় ফললাভ হয়।

‘যিনি ভূমি দান করেন নাই, তিনি পরজন্মে কখন ভূমি ভোগ করিতে সমর্থ হয়েন না। যিনি যান প্ৰদান করেন নাই, তিনি যানারোহণে বঞ্চিত হয়েন। ব্রাহ্মণদিগকে যে-সমস্ত অভিলষিত বস্তু প্ৰদান করা যায়, পরজন্মে সেই অভীষ্ট বস্তুর উপভোগ-লাভ হয়। অগ্নির অপত্য সুবর্ণ, বিষ্ণুর তনয়া ভূমি ও সূৰ্য্যসূতা ধেনু, এই সকল দান করিলে ত্ৰিলোকদানের ফললাভ হইয়া থাকে। দান অপেক্ষা শাশ্বত ফলপ্রদ আর কিছুই নাই। ত্ৰিলোকমধ্যে দান হইতেই শ্রেয়োলাভ হয়, এই নিমিত্ত বুদ্ধিমানেরা দানকেই প্রধান বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকেন।”