১৯৮. সর্ব্বপ্রাচীন লোকের পরিচয়

১৯৮তম অধ্যায়

সর্ব্বপ্রাচীন লোকের পরিচয়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহর্ষি ও পাণ্ডবগণ মার্কণ্ডেয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবন! আপনার অপেক্ষা কি আর কেহ প্রাচীন আছেন?” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “রাজর্ষি ইন্দ্ৰদ্যুম্ন ক্ষীণপুণ্য ও স্বর্গভ্রষ্ট হইয়া আমার সন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে তপোধন! আমার কীর্ত্তিকলাপ বিলুপ্ত হইয়াছে, এক্ষণে আপনি কি আমাকে প্ৰত্যভিজ্ঞান [নিশ্চিতরূপে চিনিতে পারা] করিতে পারেন?” আমি কহিলাম, ‘আমরা নিরিবিচ্ছিন্ন তীর্থপর্য্যটন করিয়া থাকি, কাৰ্য্যপৰ্য্যাকুলত্ব [নিরবচ্ছিন্ন কর্ম্মব্যস্ততা] প্রযুক্ত আপনারই সঙ্কল্পসকল বিস্মৃত হইয়া যাই; কখন স্মরণ করিলেও অতি কৃচ্ছ্রসাধ্য ব্ৰতোপবাসাদি-সাধনজনিত শারীরিক উপতাপে তাহার অনুষ্ঠান করিতে সমর্থ হই না, সুতরাং আপনাকে কি প্রকারে প্রত্যভিজ্ঞান করিব?” তখন ইন্দ্ৰদ্যুম্ন কহিলেন, “ভগবন! আপনার অপেক্ষা আর কেহ প্রাচীন আছেন কি না?’ আমি কহিলাম, ‘হিমাচলে প্ৰাবারকর্ণনামে এক উলূক বাস করিয়া থাকে, সে আমা অপেক্ষা অতি প্রাচীন, বোধ হয়, আপনাকে প্রত্যভিজ্ঞান করিলেও করিতে পারে। কিন্তু হিমালয় অতিদূরবর্ত্তী, অতএব যদি আপনার ইচ্ছা হয়ত চলুন, আমিও যাইব ।”

“অনন্তর অশ্বের পরিবর্তে ইন্দ্ৰদ্যুম্ন নিজেই রথ টানিয়া, আমাকে লইয়া উলূকসন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন, অনন্তর তিনি উলূককে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে উলূক’! তুমি কি আমাকে প্রত্যভিজ্ঞান করিতে পার?” প্রাবারকর্ণ উলূক মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া কহিল, “না মহাশয়! আমি আপনাকে প্ৰত্যভিজ্ঞান করিতে পারিলাম না।” তখন ইন্দ্ৰদ্যুন্ন কহিলেন, “হে উলূক! তোমা অপেক্ষা আর কে প্রাচীন আছেন?” উলুক কহিল, “মহাশয়! ইন্দ্ৰদ্যুম্ননামে এক সরোবর আছে, তথায় নাড়ীজঙ্ঘনামে এক বক বাস করিয়া থাকে। সে আমা অপেক্ষাও প্রাচীন; অতএব আপনি তথায় গিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করুন।” তখন ইন্দ্ৰদ্যুম্ন ও উলূক আমাকে সমভিব্যাহারে লইয়া সরোবরে গমন করিলেন।

অনন্তর আমরা বককে নিরীক্ষণ করিয়া কহিলাম, ‘হে নাড়ীজঙ্ঘ! তুমি কি রাজা ইন্দ্ৰদ্যুম্নকে জান?” বক ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিল, “না, আমি তাহাকে জানি না।” তখন আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, নাড়ীজঙ্ঘ! তোমা অপেক্ষা আর কে প্রাচীন আছে?” বক কহিল, “এই সরোবরে অকুপারনামে এক কচ্ছপ বাস করিয়া থাকে, সে আমা অপেক্ষা প্ৰাচীন। আপনারা তাহাকেই জিজ্ঞাসা করুন, বোধ হয়, সে ইন্দ্ৰদ্যুম্ন রাজাকে জানিতে পরিবে।”

“অনন্তর সেই বক আমাদের সহিত অকূপারসন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিল, “আমরা তোমাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি শীঘ্র আমাদিগের সন্নিধানে আগমন কর।” কচ্ছপ এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র সত্বর সরোবর হইতে উত্থিত হইয়া আমাদিগের সমক্ষে আগমন করিল। তখন আমরা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘অকূপার! তুমি কি ইন্দ্ৰদ্যুম্ন রাজাকে জান?” এই কথা জিজ্ঞাসিত হইবামাত্র সে কম্পিত-কলেবর ও বিচেতনপ্রায় হইয়া বাষ্পাকুললোচনে উদ্বিগ্নমনে কহিল, ‘আমি ইহাকে বিলক্ষণরূপে অবগত আছি, ইনি যাগযজ্ঞ-সমাধান-পূর্ব্বক সহস্রাবার যূপসকল আহিত [সংরক্ষিত-স্থাপিত] করিয়াছেন, ইনি যজ্ঞে যে সমস্ত ধেনু দান করিয়াছিলেন, তাহাদিগেরই সঞ্চরণে খুরক্ষুণ্ন [খুরদ্বারা খনিত] হইয়া এই সরোবর হইয়াছে, আমি এই স্থানেই সতত বাস করিয়া থাকি।”

ইন্দ্ৰদ্যুম্নের স্বৰ্গপ্রতিপাদন-বৃত্তান্ত

“এই কথা পরিসমাপ্ত হইবামাত্র দেবলোক হইতে এক দেবরথ আবির্ভূত হইল ও রাজর্ষিকে লক্ষ্য করিয়া আকাশবাণী উচ্চারিত হইয়া উঠিল, “হে মহারাজ! তোমার নিমিত্ত স্বৰ্গ প্রস্তুত আছে, এক্ষণে তুমি সেই সমুচিত স্থান লাভ করিয়া কীর্ত্তমান লোকের অগ্রগণ্য হও। যতদিন মনুষ্যের পুণ্যধ্বনি ভূলোক ও দ্যুলোক স্পর্শ করিয়া থাকে, ততদিন সেই মনুষ্য পুরুষ বলিয়া পরিগণিত, যতদিন লোকের অকীর্ত্তি কীর্ত্তিত হইতে থাকে, ততদিন তাহার নিকৃষ্ট লোকপ্ৰাপ্তি হয়। অতএব মনুষ্যের অনন্তলোকলাভের নিমিত্ত নিরবচ্ছিন্ন সচ্চরিত্র হওয়া ও পপসঙ্কল্প-সকল পরিত্যাগ করিয়া বিশুদ্ধ ধর্ম্মের আশ্রয় গ্ৰহণ করাই শ্ৰেয়ঃকল্প।”

“এই কথা শ্রবণ করিয়া রাজর্ষি ইন্দ্ৰদ্যুম্ন কহিলেন, “আমি অগ্ৰে এই স্থবিরদ্বয়কে স্বস্থানে রাখিয়া আসি, পরে গমন করিব, এক্ষণে তুমি কিয়ৎক্ষণ আমার অপেক্ষা কর।” এই বলিয়া তিনি প্রাবারকর্ণ উলূক ও আমাকে লইয়া যথাস্থানে স্থাপনপূর্ব্বক সেই দেবরথে আরোহণ করিয়া স্বয়ং স্বর্গে গমন করিলেন। হে পাণ্ডবগণ! তিনিই আমা অপেক্ষা প্ৰাচীন।” তখন পাণ্ডবেরা কহিলেন, “হে তপোধন! স্বৰ্গলোকচ্যুতে রাজা ইন্দ্ৰদ্যুম্নকে পুনরায় যথাস্থানে অবস্থাপিত করিয়া আপনি অতি শ্রেয়স্কর কার্য্য সাধন করিয়াছেন।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “এইরূপ দেবকীনন্দন কৃষ্ণও নিরয়নিমগ্ন রাজর্ষি নৃগকে উদ্ধার করিয়া পুনরায় স্বর্গে প্রেরণ করিয়াছেন।”