১৬৯. নিবাতকবচাদির সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ

১৬৯তম অধ্যায়

নিবাতকবচাদির সহিত অর্জ্জুনের যুদ্ধ

অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর আমি অনেকানেক স্থানে মহর্ষিগণকর্ত্তৃক ম্ভূয়মান হইয়া মহাসাগর সন্দর্শন করিলাম। তথায় বহুল ফেনপরিপ্লুত, সংহত ও অত্যুন্নত তরঙ্গনিকর উত্তুঙ্গ পর্ব্বতের ন্যায় পরিদৃশ্যমান হইতেছে, চতুর্দ্দিকে রত্নপরিপূর্ণ শতসহস্র তরণী প্লবমান হইতেছে; তিমি [বৃহৎ সামুদ্রিক মৎস্য], তিমিঙ্গিল [তিমিকে যে মৎস্য গিলিতে পারে], তিমিঙ্গিলগিল [রাঘব—তিমিঙ্গিলকে যে মৎস্য গিলিতে সমর্থ], মকর ও কচ্ছপ-সমুদয় জলমগ্ন শৈলের ন্যায় শোভা পাইতেছে; সলিলমধ্যে শতসহস্ৰ শঙ্খ অল্পভ্রপটলসংবৃত [তরল মেঘস্তর] তারকাস্তবকের [নক্ষত্রগুচ্ছের—একত্র পুঞ্জীভূত তারকা] ন্যায় সুশোভিত হইতেছে; প্রভাবসম্পন্ন বহুবিধ রত্নজাত নিমগ্ন রহিয়াছে এবং অতি ভীষণ সমীরণ প্রবলবেগে আশ্চর্যরূপে ঘূর্ণ্যমান হইতেছে।

“আমি এবংবিধ অম্ভোনিধি নিরীক্ষণ করিয়া পরিশেষে তন্মধ্যস্থিত দানবালয় অবলোকন করিলাম। অনন্তর রথযোগবেত্তা মাতলি অনতিবিলম্বে পাতালতলে অবতীর্ণ হইয়া রথঘর্ঘর-শব্দে তত্ৰত্য সমস্ত লোকের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চারপূর্ব্বক দানবপুরীর অভিমুখে বায়ুবেগে অশ্বচালনা করিতে লাগিলেন। তখন দানবেরা নভোমণ্ডলবর্ত্তী নীরদনিনাদের ন্যায় সেই রথনির্ঘোষ শ্রবণ করিয়া দেবরাজ ইন্দ্ৰবোধে নিতান্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল এবং শশব্যস্ত হইয়া অসি, শূল, পরশু, গদা, মুষল, শর ও শরাসন ধারণপূর্ব্বক শঙ্কিত-মনে পুরদ্বার রোধ করিয়া তথায় রক্ষক নিযুক্ত করিয়া অদৃশ্যভাবে রহিল।

“অনন্তর আমি দেবপ্রদত্ত শঙ্খ, গ্রহণপূর্ব্বক প্রফুল্লমনে মন্দ মন্দ ধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলে, তাহার প্রতিশব্দ অন্তরীক্ষে স্তব্ধ হইয়া উঠিল। প্রাণীগণ সন্ত্রস্তচিত্তে ইতস্ততঃ লুক্কায়িত হইতে লাগিল; ইত্যবসরে সহস্ৰ সহস্র নিবাতকবচ বর্ম্ম ধারণ ও লৌহনির্ম্মিত মহাশূল, গদা, মুষল, পট্টিশ, করবাল, রথচক্ৰ, শতষ্নী, ভুশন্তী এবং বিচিত্ৰ অলঙ্কৃত খড়গ গ্রহণপূর্ব্বক নিৰ্গত হইতে লাগিল। মাতলি বারংবার বিচার করিয়া সমতল প্রদেশে অশ্বচালনা করিলে অশ্বেরা এরূপ দ্রুতপদে গমন করিতে লাগিল যে, তৎকালে কিছুই লক্ষিত হইল না; ফলতঃ উহা আমার পক্ষে নিতান্ত অদ্ভুত বোধ হইয়াছিল। পরে নিবাতকবচগণ সহস্ৰ সহস্ৰ বিকৃতস্বর বিকৃতাকার বাদ্যবাদন করিতে আরম্ভ করিলে সেই ঘোরতর শব্দ-প্রভাবে সাগরগর্ভে পর্ব্বতোপম মৎস্যগণ উদভ্ৰান্তমনে দ্রুতগমনে ইতস্ততঃ সঞ্চারণ করিতে লাগিল। অনন্তর দানবেরা শাণিত বাণবর্ষণ করিতে করিতে আমার প্রতি ধাবমান হইয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইল; ক্রমে ক্রমে সেই নিবাতকবচান্তক যুদ্ধ অতি তুমুল হইয়া উঠিল। পূর্ব্বে দানবযুদ্ধে যেমন দেবগণ দেবরাজ ইন্দ্রকে স্তব করিয়াছিলেন, সেইরূপ দেবর্ষি দানবর্ষি ব্ৰহ্মার্ষি ও সিদ্ধগণ সংগ্রামদর্শনার্থ আগমন করিয়া আমার স্তব করিতে লাগিলেন।”