১৮৯. প্রলয়জলধিগত শিশুরূপী বিষ্ণুর পরিচয়

১৮৯তম অধ্যায়

প্রলয়জলধিগত শিশুরূপী বিষ্ণুর পরিচয়

“দেব কহিলেন, ‘হে বিপ্র! দেবতারাও আমাকে যথার্থরূপে অবগত হইতে পারেন নাই। আমি যেরূপে সৃষ্টি করিয়াছি, তাহা কেবল তোমার প্রীতির নিমিত্তই কহিব। হে বিপ্রর্ষে! তুমি পিতৃভক্ত, আমার শরণাগত এবং প্রকৃত ব্রহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠাতা, এই জন্য আমি সাক্ষাৎ তোমার দৃষ্টিপথে আবির্ভূতা হইলাম। আমি জলের নারসংজ্ঞা প্রদান করিয়াছিলাম; সেই নার সর্ব্বদা আমার অয়ন অর্থাৎ আশ্রয়; এই জন্য আমি নারায়ণ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকি। আমি কারণস্বরূপ, শাশ্বত, অব্যয় এবং সর্ব্বভূতের বিধাতা ও সংহর্ত্তা; আমি বিষ্ণু, ব্রহ্মা, ইন্দ্র, কুবের, প্রেতাধিপতি যম; আমিই শিব, সোম, কাশ্যপ, ধাতা, বিধাতা ও যজ্ঞ। অগ্নি আমার মুখ, পৃথিবী আমার পদ, সূর্য্য-চন্দ্র আমার দুই নেত্র, স্বর্গ আমার মস্তক, আকাশ ও দিক্ আমার দুই শ্রবণ। মহাদি ও মহাকাল আমার শরীর, বায়ু আমার মন। আমি বহু শত সুদক্ষিণাসম্পন্ন যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছি। দেব্যজনপ্রবৃত্ত বেদবেত্তা স্বর্গাকাঙ্ক্ষী ক্ষত্রিয় ও স্বর্গজিগীষু বৈশ্যগণ আমার উদ্দেশেই যাগ করিয়া থাকে। আমি শেষনাগ হইয়া মেরুমন্দরসহিত চতুঃসমুদ্রবেষ্টিত বসুন্ধরা ধারণ করিয়া আছি। আমিই পূর্ব্বে বরাহদেহ পরিগ্রহ করিয়া স্ববীৰ্য্যপ্রভাবে প্রলয়জলবিলীন বসুন্ধরার উদ্ধার করিয়াছিলাম। আমিই বড়বামুখ অগ্নিস্বরূপ হইয়া অসম সলিল-সমুদয় পান করিয়া পুনরায় পরিত্যাগ করিয়া থাকি। আমার মুখ ব্রাহ্মণ, ভুজদ্বয় ক্ষত্রিয়, ঊরুদ্বয় বৈশ্য ও পাদদ্বয় শূদ্র হইয়াছে। ঋক, যজুঃ, সাম ও অথর্ব্ববেদ আমা হইতে প্রাদুর্ভূত হয় এবং আমাতেই প্রবেশ করে।

শান্তিপরায়ণ সংযতাত্মা, জিজ্ঞাসু, আধ্যাত্মিক তত্ত্ববিৎ বিপ্রগণ ধ্যানপূর্ব্বক আমারই উপাসনা করিয়া থাকেন। আমিই সংবৰ্ত্তক অগ্নি, আমিই সংবর্ত্তক অনিল ও আমিই সংবর্ত্তক সূৰ্য্য। আকাশমণ্ডলে যেসকল নক্ষত্র নেত্রগোচর হইতেছে, ঐ সকল আমারই লোমকূপ; সমুদয় সমুদ্র ও চতুর্দ্দিক্‌ আমার বসন, শয়ন ও নিলয়; আমিই দেবগণের কাৰ্য্যসিদ্ধির নিমিত্ত সেই সকলকে বিভক্ত করিয়াছি। কাম, ক্রোধ, হর্ষ, শোক, মোহ এবং শুভসাধন সত্য, দান, কঠোর তপস্যা ও সকল জীবের প্রতি হিংসা আমারই রোমস্বরূপ।

‘মনুষ্যেরা আমারই বিধানক্রমে জায়মান, মায়াভিভূত ও আমারই দেহচারী হইয়া চেষ্টমান হয়; কিন্তু স্বেচ্ছাক্রমে নহে। যে-সকল ব্রাহ্মণ সম্যক্‌রূপে বেদাধ্যয়ন করেন, বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, আত্মাকে শান্ত করেন, ক্রোধকে পরাজয় করেন, তাঁহারাই আমাকে প্রাপ্ত হয়েন। যে ব্যক্তি দুষ্কৃতকর্ম্মা, লোভাভিভূত, কৃপণ, অনাৰ্য্য ও অকৃতাত্মা, সে ব্যক্তি আমাকে প্রাপ্ত হয় না। যোগসেবিত পথ শুদ্ধাত্মাদিগের যেরূপ সুগম, মূঢ়গণের সেইরূপ দুপ্রাপ্য।

‘যে যে সময়ে ধর্ম্মবিপ্লব উপস্থিত হইয়া অধর্ম্মের প্রাদুর্ভাব হয়, সেই সেই সময়ে আমি আপনাকে সৃষ্টি করিয়া থাকি। যে-সময়ে হিংসাপরায়ণ ও সুরগণের অবধ্য দৈত্য বা রাক্ষসগণ উৎপন্ন হয়, আমি সেই সময়ে মানুষদেহ ধারণপূর্ব্বক শুভকর্ম্মাদিগের গৃহে উৎপন্ন হইয়া তাহাদিগকে দমনপূর্ব্বক সকল শান্ত করি; আমি দেব, মনুষ্য, গন্ধর্ব্ব, উরগ, রাক্ষস ও অন্যান্য চরাচর সৃষ্টি করিয়া আত্মমায়ার প্রভাবে তাহাদিগকে সংহার করিয়া থাকি এবং পুনরায় কর্ম্মকালে মৰ্য্যাদাবন্ধনের নিমিত্ত মানবমূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া অচিন্ত্যনীয় দেহসকল সৃষ্টি করি।

‘আমি সত্যযুগে শ্বেতবর্ণ, ত্রেতাযুগে পীতবর্ণ, দ্বাপরযুগে রক্তবর্ণ ও কলিযুগে কৃষ্ণবর্ণ হইয়া থাকি। সেই সময়ে অধর্ম্মও তিন পাদ হয়। আমি অন্তকালে অতি দারুণ কালস্বরূপ হইয়া সমুদয় চরাচর বিনাশ করিয়া থাকি। আমি ত্রিবর্ত্মা, বিশ্বাত্মা, সর্ব্বলোকে সুখদাতা, সকলের শ্রেষ্ঠ, সর্ব্বব্যাপী, অনন্ত, হৃষীকেশ ও প্রচুর বিক্রমশালী। আমিই একাকী সর্ব্বভূতান্তক নীরূপ কালচক্র গ্রহণ [নিয়ন্ত্রণ] করি।

‘হে মুনিপ্রধান! আমার আত্মা এবম্প্রকারে সর্ব্বভূতে নিহিত হইয়া আছে, কিন্তু তাহা কেহই অবগত হইতে পারে না। সকল ভুবনেই আমার ভক্ত-সকল আমাকে পূজা করিতেছে। তুমি আমার নিমিত্ত যে কিছু ক্লেশ প্রাপ্ত হইয়াছ, তাহা তোমার সুখোদয়ের নিমিত্ত ও কল্যাণের হেতু হইবে। তুমি যে কিছু চরাচর দৃষ্টিগোচর করিয়াছ, সে-সকলই আমার আত্মা। আমি ভূতভাবনরূপে সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছি। আমিই শঙ্খচক্রগদাধারী নারায়ণ, সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা আমার শরীরের অর্দ্ধভাগ। যখন কলিযুগের পরিবর্ত্তন হয়, তখন আমি সর্ব্বপ্রাণীকে মোহিত করিয়া নিদ্রিত হই এবং অশিশু ব্ৰহ্মা শিশুরূপ ধারণ করিয়া যাবৎ জাগরিত না হয়েন, তাবৎ আমি এইরূপে অবস্থান করি।

‘হে মুনিপুঙ্গব! আমি বারংবার তোমার প্রতি পরিতুষ্ট হইয়া তোমাকে বরপ্রদান করিয়াছি। তুমি যে সমুদয় চরাচর বিলীন ও একার্ণব অবলোকন করিয়া ব্যাকুল হইয়াছিলে, আমি তাহা অবগত হইয়াই তোমাকে জগৎ প্রদর্শন করিয়াছি। তুমি যখন আমার শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়াছিলে, তখন তুমি সমস্ত লোক অবলোকন করিয়া বিস্ময়বশতঃ আর কিছু অনুভব করিতে পার নাই। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে অবিলম্বে মুখ হইতে নিঃসারিত করিলাম। আমি তোমাকে সুরাসুরের দুর্জ্ঞেয় আত্মতত্ত্ব কহিলাম, এক্ষণে মহাতপাঃ ব্রহ্মা যাবৎ জাগরিত না হয়েন, তুমি তাবৎ এই স্থানে বিশ্রদ্ধচিত্তে সুখে সঞ্চরণ কর। পরে সেই সর্ব্বলোকপিতামহ প্রবোধিত হইলে আমি একাকী সমুদয় শরীর, আকাশ, পৃথিবী, জ্যোতি, বায়ু ও সলিল প্রভৃতি সমস্ত স্থাবরজঙ্গম ও অন্যান্য অবশিষ্ট বস্তু-সমুদয় সৃষ্টি করিব।’ ”

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে ভরতবংশাবতংস! সেই পরমাদ্ভুত দেব এই কথা কহিয়া অন্তর্হিত হইলেন। পরে এই সমস্ত বিবিধ বিচিত্র প্রজা দৃষ্টিগোচর হইল। হে রাজন! আমি যুগক্ষয়ে এইরূপ আশ্চৰ্য্য ব্যাপার দর্শন করিয়াছিলাম; আমি তখন যে কমলায়তনোচন দেবকে দর্শন করিয়াছিলাম, তোমরা সেই পুরুষোত্তমের সহিত সম্বন্ধ-বন্ধন করিয়াছ; আমি ইহারই বরপ্রভাবে অব্যাহত স্মৃতিশক্তি লাভ করিয়াছি এবং দীর্ঘায়ু ও স্বেচ্ছামরণ হইয়াছি। এই বৃষ্ণিবংশসম্ভূত কৃষ্ণ এক্ষণে ক্রীড়াপরায়ণ হইয়া রহিয়াছেন; কিন্তু ইনিই পুরাণপুরুষ, বিভু অচিন্তাত্মা, ধাতা, বিধাতা, সংহর্ত্তা, সনাতন, শ্রীবৎসলাঞ্ছন, গোবিন্দ, প্রজাপতি ও প্রভু। এই জন্মরহিত পীতবাসা আদিদেব দৃষ্টিগোচর হওয়াতে পূর্ব্ববৃত্ত-সমুদয় আমার স্মৃতিপথে সমুদিত হইতেছে। ইনি সকল ভূতের পিতা ও মাতা, তোমরা ইহারই শরণাপন্ন হও।”

পাণ্ডবগণ ও দ্রুপদনন্দিনী মার্কণ্ডেয়ের নিকট এই সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া জনার্দ্দনকে নমস্কার করিলেন। তিনি মনোহর সান্ত্বনাবাদদ্বারা তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।