১৮৭. বৈবস্বতমনু—প্রলয়কালীন মীনবৃত্তান্ত

১৮৭তম অধ্যায়

বৈবস্বতমনু—প্রলয়কালীন মীনবৃত্তান্ত

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়কে কহিলেন, “হে ব্ৰহ্ম! মহর্ষি বৈবস্বত মনুর চরিত্র শ্রবণ করিতে আমার একান্ত অভিলাষ হইতেছে, আপনি অনুগ্রহ করিয়া উহা কীর্ত্তন করুন।” মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “রাজন্! প্রজাপতিসম প্রভাসম্পন্ন মহাবল-পরাক্রান্ত অতি তেজস্বী অসামান্য-রূপসম্পন্ন বিবস্বৎপুত্র মনুনামে এক মহর্ষি ছিলেন, তিনি বিশাল বদরিকাশ্রমে কখন অধোমস্তক, কখন ঊৰ্দ্ধবাহু, কখন বা একপদে দণ্ডায়মান হইয়া নির্নিমেষলোচন অযুত-বৎসর অতিকঠোর তপানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ফলতঃ ক্রমে ক্রমে তেজ, রূপ ও তপস্যাদ্বারা তিনি স্বীয় পিতৃপিতামহকে অতিক্রম করিলেন।

“একদা তিনি আর্দ্রচীর [ভিজা কাপড়] পরিধান ও জটা ধারণপূর্ব্বক চারিণীনদীতীরে তপস্যা করিতেছেন, এই অবসরে এক মৎস্য তথায় উপনীত হইয়া তাঁহাকে কহিল, ‘ভগবন! মহাবল মৎস্যেরা দুর্ব্বল মৎস্যদিকে ভক্ষণ করিবে, আমাদিগের এই চিরন্তনী বৃত্তি বিধাতাকর্ত্তৃক বিহিত হইয়াছে, অতএব আমি অতি ক্ষুদ্র মৎস্য, মহাবল মৎস্য হইতে সাতিশয় ভীত হইয়াছি; এক্ষণে আমাকে রক্ষা করুন। অঙ্গীকার করিতেছি, পশ্চাৎ আপনার প্রত্যুপকার করিব।’ মৎস্যের বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র মহর্ষির অন্তঃকরণে কারুণ্য রসের সঞ্চার হইল। তখন তিনি অঞ্জলিদ্বারা মৎস্যকে উদক হইতে উদ্ধার করিয়া শশিকান্তি ধবল অলিঞ্জরে [মাটির জালা] নিক্ষেপপুর্ব্বক পুত্রভাবে প্রতিপালন করিতে লাগিলেন।

“মৎস্য ক্রমে ক্রমে পরিবর্দ্ধিত হইয়া উঠিলে তদীয় কলেবর অলিঞ্জর-মধ্যে অপর্য্যাপ্ত হওয়াতে তখন সে মনুকে কহিল, ‘হে ভগবন্! আজি আমাকে স্থানান্তরে রক্ষা করুন।’ তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাকে অলিঞ্জর হইতে উদ্ধার করিয়া অতিবিশাল বাপীসলিলে নিক্ষেপ করিলেন। ঐ বাপী দ্বিযোজন আয়ত, একযোজন বিস্তৃত। মৎস্য বহুসংখ্যক বৎসর তথায় অবস্থান করিয়া পরিবর্দ্ধিত হইল। ক্রমে ক্রমে অতিবিস্তীর্ণ সেই বাপীও তাহার পক্ষে নিতান্ত সঙ্কীর্ণ হইয়া উঠিল, তখন সে মনুকে পুনরায় আহ্বান করিয়া কহিল, ‘ভগবন্! আপনি আমাকে এক্ষণে সাগরগামিনী গঙ্গায় সংস্থাপিত করুন, আমি তথায় বাস করিব অথবা আপনার যেরূপ অভিরুচি হয় করুন, আমি অসূয়াপরবশ না হইয়া আপনার আদেশ পালন করিব। আমি আপনারই প্রত্নাতিশয়-সহকারে এইরূপ পরিবর্দ্ধিত ও বৃহৎ মৎস্য হইতে রক্ষিত হইয়াছি।

“এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র মহর্ষি মনু স্বয়ং সেই মৎস্যকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করিলেন। সে তথায় কিছুকাল বাস করিয়া সমধিক পরিবর্দ্ধিত হইয়া পরিশেষে মনুকে কহিল, ‘ভগবন্! আমার কলেবর অধিকতর বিস্তীর্ণ হইয়াছে; এক্ষণে এ স্থলেও আর অঙ্গ-চালনা করিতে পারি না। অধুনা প্রসন্ন হইয়া অবিলম্বে আমাকে লইয়া সাগরে নিক্ষেপ করুন।’ অনন্তর মহর্ষি স্বয়ং তাহাকে ভাগীরথী হইতে উদ্ধার করিয়া লইয়া সমুদ্রাভিমুখে চলিলেন। পথিমধ্যে তাহার স্পর্শগন্ধ [আঁশটে গন্ধ] ও বৃহদাকার বহন জন্য কিছুমাত্র ক্লেশ অনুভব না করিয়া অনায়াসে বহন করিতে লাগিলেন, পরে সাগরতীরে সমুপস্থিত হইয়া তাহাকে সলিলে নিক্ষেপ করিলেন।

প্রলয়সম্ভাবনায় মনুকর্ত্তৃক সংসারবীজরক্ষা

“মৎস্য তৎক্ষণাৎ সহাস্য আস্যে কহিল, ‘হে করুণাময়! আপনি আমাকে সর্ব্বতোভাবে রক্ষা করিয়াছেন, আমিও আপনার প্রত্যুপকার করিতে ত্রুটি করিব না। এক্ষণে যে এক বিষম ব্যাপার ঘটিবার কাল উপস্থিত, আপনি তাহা শ্রবণ করুন। সংসারের সংহার-সময় সমাগত হইয়াছে, এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় বিশ্ব অচিরকালমধ্যেই প্রলয় প্রাপ্ত হইবে। অতএব আজি আমি আপনাকে হিতকর ও শ্রেয়স্কর কাৰ্য্যে উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক সতর্ক করিতেছি, আপনি রজ্জুসংযুক্ত সুদৃঢ় একখানি নৌকা নির্ম্মাণ করাইবেন এবং স্বয়ং সপ্তর্ষিগণের সহিত যথোপযুক্ত বীজ-সকল ভিন্ন ভিন্ন রূপে স্থাপিত ও রক্ষা করিয়া ঐ নৌকায় আরোহণ করিয়া কিয়ৎক্ষণ আমার প্রতীক্ষা করিবেন। পরে আমি শৃঙ্গ সম্পন্ন হইয়া আবির্ভূত হইব। হে তপোধন! আমা ব্যতিরেকে আপনি এই দুস্তর সলিলরাশি হইতে কদাচ পরিত্রাণ পাইবেন না। এক্ষণে আমি চলিলাম, কিন্তু যেরূপ কহিলাম, ইহার যেন অন্যথা না হয়, আমার বাক্যে আপনি কোন আশঙ্কা করিবেন না। তখন মনু ‘তথাস্তু’ বলিয়া মৎস্যবাক্য স্বীকার করিলেন। অনন্তর পরস্পর আমন্ত্রণ করিয়া যথেচ্ছ প্রস্থান করিলেন।

প্রলয়প্লাবনে ভাসমান মনুর অবস্থা

“মহর্ষি মনু মৎস্যের আদেশানুসারে নৌকা ও বীজসমস্ত গ্রহণপূর্ব্বক সেই নৌকায় আরোহণ করিয়া তরঙ্গসঙ্কুল মহাসাগরসলিলে প্লবমান হইতে লাগিলেন এবং সেই মৎস্যকে একান্তমনে চিন্তা করিতে সমাসক্ত হইলেন। মৎস্য মহর্ষি মনুকে চিন্তিত জানিয়া তৎক্ষণাৎ তথায় আবির্ভূত হইল। মনু শৃঙ্গসম্পন্ন ও উন্নতপর্ব্বততুল্য সেই মৎস্যকে অর্ণবমধ্যে অবলোকন করিয়া তদীয় শৃঙ্গে পাশ [রঞ্জু—জাল] সংযত করিলেন। সে তখন মহাবেগে সেই পাশবদ্ধ নৌকা আকর্ষণ করিয়া সমুদ্রে বিচরণ করিতে লাগিল। তৎকালে উত্তাল ঊর্ম্মিমালা উত্থিত হইল। বারিরাশি গর্জ্জন করিতে লাগিল, দেখিলে বোধ হয় যেন মহাসাগর নৃত্য করিতেছে। নৌকা প্রবলবায়ুবেগে ক্ষুভিত ও মদমত্ত চপলস্বভাব অবলার ন্যায় বারংবার বিঘূর্ণিত হইতে লাগিল। তখন ভূমি বা দিগ্বিদিক কিছুই নিরীক্ষিত হইল না। ভূলোক ও দ্যুলোক কেবল জলমগ্ন বোধ হইতে লাগিল। এইরূপে লোকসকল প্রলয়জলে বিলীন হইলে কেবল সপ্তর্ষিগণ, মনু ও মৎস্য ইহারাই পরিদৃশ্যমান হইতে লাগিলেন। মৎস্য নিরলস হইয়া এইরূপে অনেক বৎসর সাগরসলিলে নৌকা আকর্ষণ করিয়া বিচরণ করিতে লাগিল।

“অনন্তর হিমাচলের এক উন্নত শৃঙ্গ পরিদৃশ্যমান হইলে মৎস্য সেই শৃঙ্গাভিমুখে নৌকা লইয়া গমন করিল। ক্রমে ক্রমে তাহার সন্নিহিত হইলে মৎস্য হাস্যমুখে মহর্ষিদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘হে তপোধনগণ! আপনার এই গিরিশৃঙ্গে কিয়ৎকাল নৌকা বন্ধন করিয়া রাখুন।’ তাঁহারা তৎক্ষণাৎ তথায় নৌকা বন্ধন করিলেন। এই নিমিত্ত অদ্যাপি হিমালয়ের ঐ শৃঙ্গ ‘নৌবন্ধনশৃঙ্গ’ বলিয়া লোকে প্রসিদ্ধ আছে।

“অনন্তর মৎস্য ঋষিদিগকে কহিল, “হে মহর্ষিগণ! আমি পরাৎপর প্রজাপতি ব্রহ্মা; মৎস্যরূপ পরিগ্রহ করিয়া এই বিপদ হইতে তোমাদিগকে উদ্ধার করিলাম। এক্ষণে এই বৈবস্বত মনু স্থাবর, জঙ্গম, দেবাসুর, মানুষ প্রভৃতি প্রজাবর্গ ও লোকসকল সৃষ্টি করিবেন। অতিতীব্র তপঃপ্রভাবে ইঁহার প্রতিভা প্রকাশিত ও অপ্রতিহত হইবে; ইনি আমারই প্রসাদবলে প্রজাসৃষ্টি-বিষয়ে মোহপরিশূন্য হইবেন।’ এই বলিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন।

“প্ৰজাসিসৃক্ষু [লোকসৃষ্টি করিতে ইচ্ছুক] ভগবান্ মনু সৃষ্টি করিবার সময়ে মোহে অভিভূত হইলেন। পরে তিনি অতি কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক প্রভাবসম্পন্ন হইয়া প্রজা সৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন। হে মহারাজ! এই উপাখ্যান মাৎস্য উপাখ্যান বলিয়া প্রসিদ্ধ। আমি এই সর্ব্বপাপহর উপাখ্যান কীর্ত্তন করিলাম। এক্ষণে যে ব্যক্তি প্রতিদিন এই মনুচরিত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিবে, সে সুখী ও পরিপূর্ণমনোরথ হইয়া সকল লোকে গমন করিবে।”