১৮৪. দ্বিজাতি-মাহাত্ম্য কথন

১৮৪তম অধ্যায়

দ্বিজাতি-মাহাত্ম্য কথন

পাণ্ডবগণ মহাত্মা মার্কণ্ডেয়কে কহিলেন, “ভগবন্‌! আমরা দ্বিজাতিগণের মাহাত্ম্য শ্রবণ করিবার নিমিত্ত নিতান্ত সমুৎসুক হইয়াছি; অতএব অনুগ্রহ করিয়া আমাদিগের কৌতূহল চরিতার্থ করুন।”

সৰ্ব্বশাস্ত্রবিশারদ মার্কণ্ডেয় পাণ্ডবগণের প্রার্থনা পরতন্ত্র হইয়া কহিলেন, ‘হে রাজন! একদা হৈহয়কুল চূড়ামণি একজন কুমার-নৃপতি মৃগয়াভিলাষে তৃণবল্লরীমণ্ডিত এক অরণ্যে পর্য্যটন করিতেছিলেন, এমত সময়ে তথায় কৃষ্ণাজিনাচ্ছাদিত কলেবর এক মুনিবরকে অবলোকন করিয়া কৃষ্ণসারভ্রমে তাঁহার প্রাণ সংহার করিলেন। পশ্চাৎ আপনার অনবধানতা উপলব্ধি হওয়াতে নিতান্ত ব্যথিত ও শোকে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া হৈহয়রাজগণের সমীপে গমনপূর্ব্বক আত্মকৃত দুষ্কৰ্ম্ম আনুপূর্ব্বিক বর্ণনা করিলেন।

হৈহয়রাজগণ ফলমূলাশী তপস্বীর প্রাণনাশত্তান্ত শ্রবণ ও অরণ্যমধ্যে তাঁহাকে তদস্থ অবলোকন করিয়া বিষাদসলিলে প্লবমান হইতে লাগিলেন এবং তিনি কাহার পুত্র জানিবার নিমিত্ত ইতস্তুতঃ অন্বেষণ করিতে করিতে কাশ্যপনন্দন অরিষ্টনেমার আশ্রমে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক সকলে দণ্ডায়মান হইলেন। মহর্ষি অরিষ্টনেমা তাঁহাদিগের নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ পূজোপকরণ আহরণ করিলে তাঁহারা কহিলেন, “হে মুবির! আমরা ব্ৰহ্মহত্যা করিয়াছি, অতএব আমরা এক্ষণে আপনার সৎকারের অযোগ্য বলিয়া পরিগণিত হইতেছি।”

মহর্ষি কহিলেন, “আমি আপনাদিগকে এইক্ষণেই তপোবল প্রদর্শন করিতেছি। আপনারা কি প্রকারে ব্রহ্মহত্যা করিয়াছেন এবং সেই ব্ৰহ্মণ বা কোথায়, বলুন।”

তাঁহারা তখন অরিষ্টনেমাকে যথাভূত সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদনপূৰ্ব্বক সেই মুনিবরের মৃতকলেবর অন্বেষণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাঁকে আর সে স্থানে দেখিতে না পাইয়া স্বপ্নের ন্যায় বোধ করত গতচেতন ও লজ্জিত হইয়া উঠিলেন। তখন ঋষিবর অরিষ্টনেমা তাঁহাদিগকে কহিলেন, “হে নৃপতিগণ! আপনারা যাঁহাকে বিনাশিত করিয়াছেন, ইনিই সেই ব্রাহ্মণ; ইনি আমার পুত্র।” এই কহিয়া তিনি আপন পুত্রকে প্রদর্শন করিলেন। তাঁহারা সেই দৃষ্টচর ব্রাহ্মণকে দৃষ্টি গোচর করিবামাত্র বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইয়া কহিলেন, “কি আশ্চর্য! সেই মৃত মহর্ষি জীবিত হইয়া এ স্থানে আগমন করিয়াছেন। হে বিপ্র! ইনি যাহার প্রভাবে পুনরায় জীবন প্রাপ্ত হইলেন, সেই তপোবীৰ্য্য কিরূপ, শ্রবণ করিবার নিমিত্ত আমাদিগের সাতিশয় ঔৎসুক্য জন্মিয়াছে ; যদি শ্রোতব্য হয়, বলুন।”

তার্ক্ষ্য কহিলেন, “নৃপগণ! মৃত্যু আমাদিগের নিকট প্রভাব বিস্তার করিতে সমর্থ হয় না। মৃত্যুপ্রভাব আমাদিগের নিকট যে নিমিত্ত প্রতিহত হয়, এক্ষণে তা সংক্ষেপে কহিতেছি, শ্রবণ করুন। আমরা কেবল সত্যই জানি, আমাদিগের মন মিথ্যাতে কখন অনুরক্ত হয় না, আমরা সর্ব্বদা স্বধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া থাকি, এই নিমিত্ত আমাদিগের মৃত্যুভয় নাই। আমরা এই সকল ব্রাহ্মণকে কেবল সদাচারের উপদেশ প্রদান করি, গর্হিতাচারবিষয়ে কদাচ উপদেশ প্রদান করি না; এই নিমিত্ত আমাদিগের মৃত্যুভয় নাই। আমরা অতিথিগণকে অন্নপান ও ভৃত্যগণকে পর্য্যাপ্ত ভোজন। প্রদান করিয়া অবশিষ্ট ভোজন করি, এই নিমিত্ত আমাদিগের মৃত্যুভয় নাই। আমরা দান্ত, শান্ত, বদান্য, ক্ষমাশীল, তীর্থসেবী ও পুণ্যস্থাননিবাসী, এ নিমিত্ত আমাদিগের মৃত্যুভয় নাই। আমরা তেজস্বী দেশে বাস করি, এ নিমিত্ত আমাদের মৃত্যুভয় নাই। হে বিমৎসরগণ! আপনাদিগকে সংক্ষেপে এইমাত্র কহিলাম, এক্ষণে আপনারা প্রস্থান করুন, আপনাদিগের ব্ৰহ্ম হত্যাজনিত পাপভয় আর নাই।”

অনন্তর হৈহয়-ভুপতিগণ তাঁহার আশীর্ব্বাদ গ্রহণ ও তাঁহাকে যথাবিধি অভিবাদনপূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে প্রতিগমন করিলেন।