১৭৩. কালকঞ্জাদি দানবসহ অর্জ্জুনের যুদ্ধ

১৭৩তম অধ্যায়

কালকঞ্জাদি দানবসহ অর্জ্জুনের যুদ্ধ

অর্জ্জুন কহিলেন, “হে নরনাথ! অমরাবতীগমনসময়ে পথিমধ্যে এক কামারী নগর নয়নগোচর করিলাম। ঐ নগর পাবক ও প্রভাকরের ন্যায় প্রভা-সম্পন্ন, সুস্বর-পত্রতি [পক্ষী] গণপরিবৃত, রত্নময় পুষ্পফলশোভিতরত্ন-পাদপশ্রেণীতে পরিকীর্ণ গোপুরনিকরে পরিপূর্ণ; অট্টালিকায় সুশোভিত এবং দুৰ্গমদ্বারচতুষ্টয়ে উদ্ভাসিত হইয়া রহিয়াছে; মালাধারী দানবগণ শূল, ঋষ্টি, মুষল, মুদগর প্রভৃতি বিবিধ আয়ুধ গ্রহণপূর্ব্বক তাহার চতুর্দ্দিক রক্ষা করিতেছে। উহাতে কালকঞ্জ ও পুলোমজ দনুজদলের আবাসস্থান। আমি এই অদ্ভুতদৰ্শন আকাশচর নগর নিরীক্ষণ করিয়া মাতলিকে তাহার সমস্ত বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলাম।

“মাতলি কহিলেন, “পুলোমা ও কালকা-নামী দুই প্রধান অসুরী দিব্য সহস্রবর্ষ কঠোর তপস্যা করিয়াছিল। তপস্যাবসানে ভগবান স্বয়ং সেই অসুরদ্বয়ের প্রার্থনানুসারে “তোমাদিগের পুত্ৰগণ অল্প-দুঃখভোগী ও সুর-রাক্ষস-পন্নগগণের অবধ্য হইবে।” বলিয়া বর প্রদান করিলেন এবং তাহাদিগকে সর্ব্বরত্নসমন্বিত মহর্ষি, যক্ষ, গন্ধর্ব্ব, পন্নগ, অসুর ও রাক্ষসগণের অনভিভবনীয় এই আকাশচারী নগর প্রদান করিলেন। ব্ৰহ্মা এই সর্ব্বকামসমন্বিত বীতরোগশোক নগর কালকেয়গণের নিমিত্তই নির্ম্মাণ করিয়াছেন; এই অমরবর্জ্জিত নগর হিরণ্যপুর বলিয়া বিখ্যাত; কালকা ও পুলোমানন্দনগণ ইহার রক্ষণাবেক্ষণ করে। তাহারা দেবগণের অবধ্য বলিয়া এই নগরে সর্ব্বদা সানন্দচিত্তে বাস করিতেছে; উদ্বেগ বা ঔৎসুক্য তাহাদিগের স্বপ্নের অগোচর। হে ভারত! ভগবান ব্ৰহ্মা মনুষ্য হইতে তাহাদিগের মৃত্যু নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন; অতএব তুমি শীঘ্ৰ বজাস্ত্র প্রয়োগ করিয়া দুরন্ত কালকেয়গণকে কৃতান্তভবনে প্রেরণ কর।”

“আমি তখন দানবগণকে সুরাসুরের অবধ্য বোধ করিয়া হৃষ্টচিত্তে কহিলাম, “হে সূত! আপনি এই পুরীমধ্যে শীঘ্র প্রবেশ করুন। আমি বলারাতির [ইন্দ্র] সমস্ত অরাতিদল অস্ত্রবলে নির্দ্দলিত করিব; এই দানবগণ আমারই বধ্য, তাহাতে সন্দেহ নাই।”

“অনন্তর মাতলি হয়-সনাথ [যোজিতাশ্ব—অশ্বযুক্ত] দিব্যরথের সাহায্যে আমাকে অনতিবিলম্বেই হিরণ্যপুরের উপকণ্ঠে উপস্থিত করিলেন। দানবদল আমাকে অবলোকন করিবামাত্র বদ্ধপরিকর হইয়া রথারোহণপূর্ব্বক মহাবেগে উৎপতিত হইল এবং সংরম্ভ [যুদ্ধোদযোগ] সহকারে তীব্রতর পরাক্রান্ত প্রকটিত করিয়া আমার প্রতি নালীক, নাচার, ভল্প, শক্তি, ঋষ্টি ও তোমর নিক্ষেপ করিতে লাগিল।

“আমি সমর্য্যাঙ্গনে স্যন্দনারোহণে বিচরণ করিতে করিতে শস্ত্র বল ও বিদ্যাবল অবলম্বনপূর্ব্বক তাহাদিগের অস্ত্ৰ-শস্ত্র সুদূরপরাহত ও তাহাদিগকেও সম্মোহিত করিলাম। তাহারা যখন অতিমাত্র বিমোহিত হইয়া পরস্পর আক্রমণ ও আঘাত করিতে লাগিল, আমি সেই অবসরে তাহাদিগের উত্তমাঙ্গ-সকল নিশিত বিশিখজালে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলাম। এইরূপে কামগপুরবাসী দানবগণ নির্ভর [অত্যন্ত] নিপীড়িত হইয়া দানবী মায়া অবলম্বনপূর্ব্বক সেই নগর হইতে যেমন সমুৎপতিত হইল, আমি অমনি শরনিকর বিস্তার করিয়া তাহাদিগের গমনপথ আচ্ছাদন ও গতিরোধ করিলাম।

“অনন্তর আমি বিবিধ আয়ুধপাতদ্বারা দনুজদলসহ সেই দেদীপ্যমান কামচারী নগরী আক্রমণ করিলাম; ঐ দিব্যপুরী কখন ভূতলে নিপতিত, কখন উৰ্দ্ধে উৎপতিত, কখন তিৰ্য্যগভাগে বিচলিত, কখন বা সলিলে নিমগ্ন হইতে লাগিল। উহা আমার সরলগামী লৌহময় বাণে ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া ধরাতালে নিপতিত হইল ও তন্নিবাসী অসুরেরাও বীজসমবেগ বিশিখ-সমূহে নিতান্ত আহত হইয়া কালপ্রেরিতের ন্যায় ঘূর্ণ্যমান হইতে লাগিল।

“অনন্তর মাতলি সেই আদিত্যপ্ৰভ রথের একান্ত প্ৰান্তভাগে উপবেশনপূর্ব্বক আমাকে অচিরকালমধ্যে অবনীতলে অবতারিত করিলেন। তথায় সেই রোষপরবশ যুযুৎসু দানবগণের ষষ্টি-সহস্ৰ রথ আমার সম্মুখীন হইলে আমি সেই রথসকল নিশিত অৰ্দ্ধাকৃতি [অৰ্দ্ধচন্দ্ৰাকৃতি] বাণে খণ্ড খণ্ড করিলাম। পরে দানবগণ সমরে আমাদিগকে পরাভব করা মানবের সাধ্য নহে, মনে করিয়া সাগরতরঙ্গের ন্যায় সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইল। আমিও যথাক্রমে দিব্যাস্ত্ৰ-সকল সংযোজন করিলাম; কিন্তু সেই সকল চিত্ৰযোধী রথী মুহূর্ত্তমাত্রেই আমার দিব্যাস্ত্ৰ-সমুদয় প্রতিহত করিল। পরে তাহারা বিচিত্র ধ্বজকবচে ও মুকুট প্রভৃতি বিচিত্ৰ অলঙ্কারে বিভূষিত হইয়া যেন আমার হর্ষোৎপাদনপূর্ব্বক বিচিত্র রথপথে বিচরণ করিতে লাগিল। তাহাদিগকে উৎপীড়ন করা দূরে থাকুক, তাহারাই তখন আমাকে যৎপরোনাস্তি উৎপীড়ন করিতে আরম্ভ করিল।

“আমি সেই মহাযুদ্ধে যুদ্ধকুশল দানবদলের উৎপীড়নে নিতান্ত ব্যথিত ও ভীত হইয়া সংযতচিত্তে দেবদেব মহাদেব এবং ভূতগণের নামোচ্চারণ ও স্বস্তিবাচনপূর্ব্বক অমিত্ৰবিকর্ত্তন [শত্ৰুচ্ছেদনকারী] রৌদ্রাখ্য মহাস্ত্ৰ সংযোজনা করিলাম; এমন সময়ে সেই সনাতন রৌদ্র অস্ত্ৰ ত্রিমস্তক, নবলোচন, ষড়ভুজ, সূৰ্য্যােনলসঙ্কাশ কেশপাশে শোভিত এবং লেলিহান মহানাগ-সমূহে কৃতশেখর পুরুষের মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে, অবলোকন করিলাম। দর্শনমাত্রেই শরাবির্ভূত ভূতনাথকে নমস্কারপূর্ব্বক দানবগণের জীবনসংহারার্থ সেই গাণ্ডীবনিহিত পাশুপত অস্ত্র পরিত্যাগ করিলাম।

কালকঞ্জাদি দানব-নিধন

“অনন্তর সেই পরিত্যক্ত অস্ত্ৰ সিংহ, ব্যাঘ্র, ভল্লুক, বৃষভ, হরিণ, মহিষ, আশীবিষ, গো, শরভ, বানর, বরাহ, মার্জার, শালবৃক, প্রেত, ভুরুগু, গৃধ্ৰু, গরুড়, চমর, অশ্ব, গজমুখ, মীন, পেচক, দেব, ঋষি, গন্ধর্ব্ব, পিশাচ, অশ্ব, যক্ষ, অসুর, গুহ্যক ও গদা-মুদগরধারী নিশাচর প্রভৃতি অশেষবিধ প্রাণীগণের মূর্ত্তি ও ত্রিশিরা, চতুর্দ্দন্ত, চতুৰ্ম্মখ ও চতুৰ্ভুজ প্রভৃতি বিবিধ রূপ ধারণ করিয়া সমস্ত জগৎ আচ্ছাদিত করিল। আমি এবম্প্রকার সূৰ্য্যাগ্নিসম তীক্ষ্ণ, বীজসম-প্রভাযুক্ত ও পর্ব্বতসম-সারসম্পন্ন বাণসমূহে মুহুর্ত্তমাত্রে দানবদলকে উন্মুলিত করিলাম। তাহাদিগকে গাণ্ডীবাস্ত্ৰপ্ৰভাবে বিনষ্ট ও নভোমণ্ডল হইতে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া পুনরায় ত্রিপুরান্তক দেবাদিদেবকে নমস্কার করিলাম। দিব্যাভরণভূষিত অসুরগণ পাশুপত অস্ত্ৰে নিষ্পেষিত হইয়াছে এবং আমি দেবদুষ্কর কাৰ্য্যসাধনে কৃতকাৰ্য্য হইয়াছি দৰ্শন করিয়া মাতলি সাতিশয় হৃষ্টচিত্তে আমাকে সৎকারপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ধনঞ্জয়! তুমি আজি সুরাসুরগণের অসাধ্য কর্ম্মসাধন করিয়াছ। স্বয়ং সুরেশ্বরও এই কাৰ্য্যে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। তুমি স্বীয় তেজ ও তপঃ-প্রভাবে দেবদানবের অনভিভাবনীয় এই আকাশচর নগর বিমথিত করিয়াছ।”

“এদিকে বৈমানিক নগর ও দানবগণ নিৰ্ম্মলিত হইলে দানবরমণীরা নিতান্ত দুঃখিনী ও স্বলিতকবরী হইয়া দুঃখদগ্ধ কুররীর ন্যায় রোদন করিতে করিতে নগরের বহির্ভাগে নিপতিত হইল। তাহারা পতি, পুত্র, ভ্রাতা ও পিতার শোকে ধরাতালে বিলুন্ঠিত হইয়া দীন-কণ্ঠে রোদন ও উরস্থল [বক্ষ] তাড়ন করিতে লাগিল। তাহাদিগের কুসুমমালা ও বিভূষণসকল স্রস্ত হইয়া পড়িল। গন্ধর্ব্বনগরাকার সেই দানবীগণের শোকানলে দহ্যমান হইয়া নাগবিজ্জিত হ্রদের ন্যায়, সরসতরুশূন্য অরণ্যের ন্যায় শ্ৰীভ্রষ্ট ও কান্তিহীন হইয়া উঠিল।

“অনন্তর মাতলি আমাকে অচিরকালমধ্যেই অমরালয়ে আনয়ন করিলেন। আমি হিরণ্যপুত্র উৎসন্ন ও সংগ্রামে দুর্জ্জয় নিবাতকবচগণকে নিহত করিয়া সমধিক সানন্দচিত্তে দেবেন্দ্ৰসমীপে আগমন করিলাম। মাতলি তখন আমার অনুষ্ঠিত সমুদয় কাৰ্য্য দেবরাজকে আনুপূর্ব্বিক নিবেদন করিলেন। ভগবান সহস্ৰলোচন ও অন্যান্য দেবগণ হিরণ্যপুরের উৎসাদিন, দানবী মায়ার নির্য্যাকরণ এবং মহাতেজঃ দানবগণের নিধনবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া প্রীতি-প্ৰফুল্লচিত্তে আমাকে বারংবার সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন এবং সুমধুরবাক্যে কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! তুমি গুরুর নিমিত্ত ভয়ানক শত্রুগণকে সংহার করিয়া দেবদানবের সাধ্যতীত কর্ম্ম সম্পাদন করিয়াছ। তুমি সংগ্রামসময়ে সর্ব্বদা স্থিরচেতাঃ ও অস্ত্রপয়োহসময়ে অভ্রান্তহৃদয় হইবে। দেব, দানব, রক্ষ, যক্ষ, পক্ষী, পন্নগ প্রভৃতি কেহই তোমার পরাক্রম সহ্য করিতে সমর্থ হইবে না; ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির তোমারই বাহুবলে সসাগরা ধরার আধিপত্যলাভ করিয়া প্রতিপালন করিবেন।’ ”