১৯৭. সৌভাগ্যশালীদিগের মাহাত্ম্যকীর্ত্তন

১৯৭তম অধ্যায়

সৌভাগ্যশালীদিগের মাহাত্ম্যকীর্ত্তন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! মহামুনি মার্কণ্ডেয় রাজা যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক অভিহিত হইয়া পুনর্ব্বার ভাগ্যশীলগণের মাহাত্ম্য কীর্ত্তন করিতে আরম্ভ করিলেন। ‘মহারাজ! বিশ্বামিত্রতনয় অষ্টক অশ্বমেধ-যজ্ঞ সমাপন করিয়া একদিন স্বীয় তিন ভ্রাতা প্ৰতর্দ্দন, বসুমনা ও শিবির সহিত রথারোহণপূর্ব্বক গমন করিতেছেন, ইত্যবসরে, দেবর্ষি নারদকে সাগত দেখিয়া তাঁহারা সকলে অভিবাদনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে তপোধন! রথে আরোহণ করুন।”

“দেবর্ষি নারদ তাঁহাদের বাক্যে রথারূঢ় হইলে পর একজন কহিলেন, “ভগবন! আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে অভিলাষ করি।” নারদ কহিলেন, “কি অভিলাষ হইয়াছে, বল।” তখন তিনি কহিলেন, “তপোধন! আমরা চারিজন অবিনশ্বর স্বৰ্গধামে গমন করিব, তন্মধ্যে প্রথমে কে ভূতলে অবতীর্ণ হইবে?” নারদ কহিলেন, “অষ্টক।” তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! অষ্টক যে স্বর্গভ্ৰষ্ট হইবেন, তাহার কারণ কি?” নারদ কহিলেন, “আমি একদিবস অষ্টকালয়ে বাস করিয়াছিলাম। পরদিন ইনি আমাকে রথে লইয়া গমন করিতেছিলেন। পথিমধ্যে একস্থানে বহুসহস্ৰ নানাবর্ণবিচিত্ৰ ধেনু বিচরণ করিতেছে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই সকল ধেনু কাহার?” তিনি কহিলেন, “আমার; আমি সমুদয় ধেনু স্বৰ্গলাভের নিমিত্ত ব্ৰাহ্মণকে দান করিয়াছি।” এইরূপে আত্মশ্লাঘা করিয়াছিলেন, এই হেতু তিনি অগ্ৰে ভূতলে অবতীর্ণ হইবেন।” তাহারা কহিলেন, “ভগবন! সম্প্রতি আমরা তিনজনে সুরসদনে গমন করিব, ইহার মধ্যে কে অগ্রে অবতীর্ণ হইবে?” নারদ কহিলেন, “প্ৰতর্দ্দন।” একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি নিমিত্ত?” নারদ কহিলেন, “আমি প্ৰদৰ্দ্দনের গৃহেও একদিবস বাস করিয়াছিলাম। ইনি আমাকে রথে লইয়া গমন করিতেছিলেন, পথিমধ্যে এক ব্ৰাহ্মণ আসিয়া প্রতর্দ্দনের নিকট অশ্ব প্রার্থনা করিলে তিনি কহিলেন, “আমি প্রত্যাগত হইয়া তোমাকে অশ্বপ্রদান করিব।” ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, “শীঘ্ৰ প্ৰদান করুন।” তিনি তৎক্ষণাৎ দক্ষিণপার্শ্বস্থ অশ্ব তাঁহাকে প্ৰদান করিলেন।

অনন্তর আর একজন অশ্বপ্রার্থী ব্রাহ্মণ সমাগত হইয়া তাহাঁকে বামপার্শ্বস্থ অশ্ব যাচ্ঞা করিলে তিনি তখন ধুর্য্য [ভারবাহী] অশ্বের পৃষ্ঠ হইতে শীঘ্ৰ ভার অবরোহণপূর্ব্বক সেই অশ্বটি তাঁহাকে প্ৰদান করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। পরে অন্য এক ব্ৰাহ্মণ আসিয়া পুনরায় অশ্ব প্রার্থনা করিলে তিনি কহিলেন, “প্ৰত্যাগত হইয়া প্ৰদান করিব।” ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, ‘সত্বর প্রদান করুন।” তিনি তখন তাঁহাকে রথধুরসংযুক্ত অশ্ব প্ৰদানপূর্ব্বক স্বয়ং ধুর গ্রহণ করিয়া ব্রাগহ্মণদিগকে কহিলেন, “আমি অনেক দান করিয়াছি, সম্প্রতি আর কিছুই নাই।’ ”

“নারদ কহিলেন, ‘দান করিয়া অসূয়াপ্রকাশ করিলে কদাচ স্বর্ণপ্ৰাপ্তি হয় না।” তাঁহারা কহিলেন, “এক্ষণে আমরা দুইজনে গমন করিব; তন্মধ্যে কে ধরাতলে অবতীর্ণ হইবে?” নারদ কহিলেন, ‘বসুমনা।” তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি নিমিত্ত?” নারদ কহিলেন, “আমি একদিবস ভ্রমণ করিতে বসুমনার গৃহে গমন করিয়া পুষ্পরথের প্রয়োজনবশতঃ স্বস্তিবাচনপূর্ব্বক তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলাম, পরে ব্রাহ্মণগণের স্বস্তিবাচন সমাপন হইলে তিনি সকলকে রথ প্রদর্শন করিলেন। আমি তাঁহার অনেক প্রশংসা করাতে বসুমনা কহিলেন, “ভগবন! আপনি যে রথের প্ৰশংসা করিতেছেন, উহা আপনারই রথ।” এই কথা স্বীকার করিলেন, কিন্তু রথ প্ৰদান করিলেন না।

“অনন্তর আমি পুনর্ব্বার একদিবস বসুমনার নিকট উপস্থিত হইয়া পুস্পরথের প্রয়োজনবশতঃ স্বস্তিবাচন করিলাম। তাহাতে রাজা ‘ইহা আপনারই’ বলিয়া স্বীকার করিলেন, কিন্তু প্ৰদান করিলেন না। পুনরায় তৃতীয়বার স্বস্তিবাচন সম্পন্ন করিলে পর রাজা ব্ৰাহ্মণগণের সমক্ষে আমার প্রতি কটাক্ষ করিয়া কহিলেন, “ভগবান! পুষ্পরথের নিমিত্ত স্বস্তিবাচন অতি উত্তম হইয়াছে।” এইরূপ দ্রোহবাক্য প্রয়োগের নিমিত্ত তাঁহাকে ভূতলে অবতীর্ণ হইতে হইবে।”

“তাঁহারা কহিলেন, “সম্প্রতি আমাদের মধ্যে একজন ও আপনি, এই দুইজন গমন করিবেন, তাহাতে কে অবতীর্ণ হইবেন?” নারদ কহিলেন, “আমি অবতীর্ণ হইব। শিবিরাজ স্বৰ্গে গমন করিবেন।” তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি নিমিত্ত?” নারদ কহিলেন, “আমি শিবির সমান হইব না, কারণ, একদা এক ব্ৰাহ্মণ শিবিরাজের নিকট আগমন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আমি ভোজনার্থী।” শিবি জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবান! কি করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন।” ব্ৰাহ্মণ বলিলেন, “রাজন! বৃহদৰ্ভনামে তোমার যে পুত্র আছে, তাহাকে বিনষ্ট করিয়া তাহার মাংস পাক ও অন্ন প্ৰস্তুত করিয়া আমার প্রতীক্ষা করিবে।”

‘রাজা পুত্রকে বিনষ্ট ও যথাবিধি পাক করিয়া পাত্রে স্থাপিত করিয়া মস্তকে লইয়া ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্যে গমন করিলেন। তিনি ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতেছেন, ইত্যবসরে এক ব্যক্তি কহিল, “আপনি যে ব্রাহ্মণের অনুসন্ধান করিতেছেন, তিনি সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া নগরে প্রবেশপূর্ব্বক আপনার গৃহ, কোষাগার, আয়ুধাগার অশ্বশালা ও হস্তিশালা প্রভৃতি সমুদয় দগ্ধ করিতেছেন।” এই অগ্ৰীতিকর সংবাদ-শ্রবণে রাজার মুখ বিবর্ণ বা কিঞ্চিম্মাত্র বিকৃত হইল না, প্রত্যুত তিনি অবিচলিতচিত্তে নগরে প্রবেশ করিয়া সেই ব্রাহ্মণকে কহিলেন, “ভগবন! আপনার ভোজনসামগ্ৰী প্রস্তুত হইয়াছে।” ব্ৰাহ্মণ এই কথাশ্রবণে বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া অধোমুখে রহিলেন, কিঞ্চিমাত্র উত্তর প্রদান করিলেন না।

‘রাজা ব্রাহ্মণকে ভোজন করাইবার নিমিত্ত আগ্রহাতিশয়সহকারে বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন, ব্রাহ্মণ মুহুর্ত্তকাল উৰ্দ্ধে দৃষ্টিপাত করিয়া শিবিকে কহিলেন, “তুমিই ইহা ভোজন কর।” শিবি ব্রাহ্মণ-বাক্যে সম্মত হইয়া আবিষণ্নমনে কপাল [ভিক্ষাপাত্ৰ—মড়ার মাথার খুলি] উত্তোলনপূর্ব্বক ভোজন করিতে প্ৰবৃত্ত হইবামাত্র ব্রাহ্মণ তাঁহার হস্তধারণ করিয়া কহিলেন, “হে সাধো! আমি বুঝিলাম, তুমি জিতক্ৰোধ, ব্রাহ্মণার্থ তোমার কিছু অদেয় নাই।” এই বলিয়া যথাবিধি সৎকার করিলেন। রাজা সম্মুখে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিবামাত্র পবিত্র গন্ধসম্পন্ন অলঙ্কৃত দেবকুমারীতুল্য নিজ পুত্ৰকে দেখিতে পাইলেন। ব্রাহ্মণ সেই বিষয়-সকল সংসাধন করিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। বিধাতা উপস্থিত হইয়াছিলেন।

‘ব্রাহ্মণ অন্তর্হিত হইলে আমাত্যগণ রাজাকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি সবিশেষ জানিয়াও কি নিমিত্ত এইরূপ অনুষ্ঠান করিলেন?” শিবিরাজ কহিলেন, “আমি যশোলাভ, অর্থলাভ বা ভোগাভিলাষে লোলুপ হইয়া এরূপ কর্ম্ম করি নাই, কেবল এই পথে পাপপরায়ণদিগের অধিকার নাই, এই নিমিত্ত আমি ঈদৃশ অনুষ্ঠান করিয়াছি। সাধু লোকে যাহা অধিকার করেন তাহাই প্রশস্ত, এই কারণে আমার বুদ্ধি প্রশস্তবিষয়ের আশ্রয় লইয়া থাকে।” নারদ কহিলেন, “আমি শিবিরাজের এইরূপ সৌভাগ্য সম্যক অবগত হইয়া এরূপ কহিয়াছি।”