১৮০. যুধিষ্ঠিরের অজগরগিলিতভীমজীবনভিক্ষা

১৮০তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের অজগরগিলিতভীমজীবনভিক্ষা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির আশীবিষভোগাবারুদ্ধ [সর্পশরীরদ্বারা দৃঢ় রূপে বদ্ধ] প্ৰিয়তম ভীমসেনকে দর্শন করিয়া কহিলেন, “ত্ৰাতঃ! কি প্রকারে তোমার এই বিপত্তি ঘটিল? আর এই পর্ব্বতোপম ভোগভূষিত ভূজঙ্গমই বা কে?”

ভীমসেন অগ্রজ ভ্রাতাকে অবলোকন করিয়া সর্পের আক্রমণ প্রভৃতি সমুদয় বৃত্তান্ত বর্ণনপূর্ব্বক কহিলেন, “আৰ্য্য! এই যে বিষধর আমাকে ভক্ষণের নিমিত্ত গ্ৰহণ করিয়াছেন, ইনি মহাসত্ত্ব রাজর্ষি নহুষ, ইনি ভুজঙ্গের ন্যায় হইয়া এই স্থানে রহিয়াছেন।”

যুধিষ্ঠির সর্পকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “আয়ুষ্মান! তুমি আমার অমিতবিক্রমশালী সহোদরকে পরিত্যাগ কর; আমরা তোমাকে ক্ষুন্নিবারণোপযোগী অন্য প্রকার আহার প্রদান করিব।”

সৰ্প কহিলেন, “তাত! আমি আহারের নিমিত্তই মুখাগত রাজপুত্রকে প্রাপ্ত হইয়াছি, তুমি এ স্থান হইতে প্ৰস্থান কর, এই স্থানে থাকা কোনক্রমেই তোমার উচিত নহে, কেন না, তাহা হইলে তুমি কল্য আমার ভক্ষণীয় হইবে। আমার এই প্রকার নিয়ম নিবদ্ধ আছে যে, যে ব্যক্তি আমার রাজ্যে আগমন করিবে, আমি সেই ব্যক্তিকেই ভক্ষণ করিব; তুমিও আমার রাজ্যে আগমন করিয়াছ, কিন্তু অদ্য তোমার অনুজাতকে আহাররূপে প্রাপ্ত হইয়াছি; আমি ইহাকে পরিত্যাগ করিব না এবং অন্য আহারেও আমার আকাঙক্ষা নাই।” রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সর্প। তুমি দেবতাই হও, দানবই হও, অথবা সর্পই হও, যুধিষ্ঠির তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, তুমি যথার্থকরিয়া বল, কি নিমিত্ত ভীমসেনকে গ্ৰাস করিয়াছ? কোন বিষয় অবগত হইলে তোমার প্রীতি জন্মে? আমি তোমাকে কি প্রকার আহার দান করিব এবং কি হইলেই বা ভীমকে পরিত্যাগ করিবে?”

সৰ্প কহিল, “রাজন! আমি তোমার পূর্ব্বপুরুষ; আয়ুর পুত্র ও চন্দ্রের বৃদ্ধ প্রপৌত্র, আমার নাম নহুষ; আমি যজ্ঞ, তপস্যা, বেদপাঠ, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহ ও পরাক্রমে বিনা ক্লেশে ত্ৰৈলোক্যের সমুদয় ঐশ্বৰ্য্যপ্রাপ্ত হইয়া, ঐশ্বৰ্য্যসুলভ দৰ্পে এরূপ দর্পিত হইয়াছিলাম যে, সহস্ৰ সহস্ৰ দ্বিজাতিকে অবমাননা করিয়া শিবিকাবাহনে নিযুক্ত করিতাম। সেই অপরাধে ভগবান অগস্ত্য আমাকে এই অবস্থা প্ৰদান করিয়াছেন। কিন্তু অদ্যাপি আমার সেই পূর্ব্বপ্রজ্ঞা বিনষ্ট হয় নাই। এক্ষণে সেই মহাত্মার অনুগ্রহে দিবসের ষষ্ঠভাগে আহারার্থ তোমার কনিষ্ঠভ্রাতাকে প্রাপ্ত হইয়াছি, অতএব কোনমতেই ইহাকে পরিত্যাগ করিব না এবং আমার অন্য কামনাও নাই। এক্ষণে যদি তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হও, তাহা হইলে তোমার সহোদরকে পরিত্যাগ করিব।”

যুধিষ্ঠিরের সর্পপ্রশ্নোত্তর-প্রদানে ভীমমুক্তি

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে বিষধর! আপনি যথেচ্ছ প্রশ্ন করুন, যদি বোধ হয় যে, এ বিষয়ে আপনার প্রীতি-উৎপাদনা করিতে সমর্থ হইব, তাহা হইলে অবশ্যই আপনার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রদান করিব; কিন্তু আপনি ব্রাহ্মণের বেদ্যনির্ব্বিশেষ পুরুষকে অবগত হইয়াছেন কি না, জ্ঞাত না হইয়া আমি আপনার বাক্যের প্রত্যুত্তর প্ৰদান করিব না।”

সৰ্প কহিল, “হে যুধিষ্ঠির! তোমার বাক্যদ্বারা তোমাকে বুদ্ধিমান বলিয়া বোধ হইতেছে, অতএব ব্রাহ্মণ কে এবং বেদ্যই বা কি? ইহার উত্তর প্রদান কর।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “যে ব্যক্তিতে সত্য, দান, ক্ষমা, শীল, আনৃশংসা, তপ ও ঘৃণা লক্ষিত হয়, সেই ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ এবং যাঁহাকে প্রাপ্ত হইলে আর শোকদুঃখ থাকে না, সেই সুখদুঃখবর্জ্জিত নির্ব্বিশেষ ব্ৰহ্মই বেদ্য। যদি আপনার আর কিছু বলিবার থাকে, বলুন।”

সৰ্প কহিল, “হে যুধিষ্ঠির! অভ্রান্ত বেদ চতুর্ব্বর্ণেরই ধর্ম্মব্যবস্থাপক; সুতরাং বেদমূলক সত্য, দান, ক্ষমা, আনৃশংস্য, অহিংসা ও করুণা শূদ্রেও লক্ষিত হইতেছে; যদ্যপি শূদ্রেও সত্যাদি ব্ৰাহ্মণধর্ম্ম লক্ষিত হইল, তবে শূদ্রও ব্রাহ্মণ হইতে পারে। তুমি যাহা বেদ্য বলিয়া নির্দেশ করিলে, সুখদুঃখবর্জ্জিত তাদৃশ বস্তু কুত্ৰাপি বিদ্যমান নাই।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “অনেক শূদ্রে ব্রাহ্মণলক্ষণ ও অনেক দ্বিজাতিতেও শূদ্রলক্ষণ লক্ষিত হইয়া থাকে; অতএব শূদ্ৰবংশীয় হইলেই যে শূদ্র হয় এবং ব্রাহ্মণবংশীয় হইলেই যে ব্রাহ্মণ হয়, এরূপ নহে; কিন্তু যে-সকল ব্যক্তিতে বৈদিক ব্যবহার লক্ষিত হয়, তাঁহারাই ব্ৰাহ্মণ, এবং যে-সকল ব্যক্তিতে তাহা লক্ষিত না হয়, তাহারাই শূদ্র। আপনি কহিয়াছেন যে, “সুখদুঃখবিহীন কোন বস্তু নাই; অতএব তোমার কথিত বেদ্যলক্ষণ অসঙ্গত হইয়াছে।” উহা যথার্থ, কেন না, অনিত্য বস্তুমাত্রেই হয় সুখ, না হয় দুঃখ অনুভূত হইয়া থাকে, কিন্তু আমার মতে কেবল এক নিত্য পরমেশ্বরই সুখদুঃখবিহীন; অতএব তিনিই বেদ্য। এক্ষণে আপনার মত কি প্রকাশ করুন।”

সৰ্প কহিল, “হে আয়ুষ্মান! যদি বৈদিক ব্যবহারই ব্ৰাহ্মণত্বের কারণ বলিয়া স্বীকার করিতে হয়, তাহা হইলে যে পৰ্য্যন্ত বেদবিহিত কাৰ্য্যে সামর্থ্য না জন্মে, সে পৰ্য্যন্ত জাতি কি কোন কাৰ্য্যকারক নহে?”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে মহাসর্প। বাক্য, মৈথুন, জন্ম ও মরণ মানবজাতির সাধারণ ধর্ম্ম, এই নিমিত্ত সর্ব্বদা পুরুষেরা জাতিবিচারে বিমূঢ় হইয়া নারীতে অপত্যোৎপাদন করিয়া থাকে, অতএব মনুষ্যজাতির মধ্যে সমুদয় বর্ণের এইরূপ সাঙ্কৰ্য্যবশতঃ ব্ৰাহ্মণত্বাদি জাতি নিতান্ত দুর্জ্ঞেয়; কিন্তু তত্ত্বদর্শীরা তাহার মধ্যে ‘যাহারা যাগশীল, তাহারাই ব্রাহ্মণ’, এই আর্যপ্রমাণানুসারে বৈদিক ব্যবহারেরই প্রাধান্য অঙ্গীকার করিয়াছেন। বেদবিহিত কর্ম্মই ব্রাহ্মণত্বলাভের হেতু বলিয়া নালীচ্ছেদনের [নাড়ী] পূর্ব্বে পুরুষের জাতকর্ম্ম সমাধান করিতে হয়, তদবধি মাতা সাবিত্রী ও পিতা আচাৰ্য্যস্বরূপ হয়েন। তিনি যতদিন পৰ্য্যন্ত বেদপাঠ না করেন, ততদিন অবধি শূদ্ৰসমান থাকেন। জাতিসংশয়স্থলে স্বায়ম্ভূব মনু কহিয়াছেন, যদি বৈদিক ব্যবহার না থাকিত, যাহা হইলে সকল বর্ণ-ই শূদ্রতুল্য এবং সঙ্কর-জাতিই সর্ব্বপ্রধান হইত। এই নিমিত্ত পূর্ব্বেই কহিয়াছি যে, বৈদিক ব্যবহারসম্পন্ন ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন।”

সৰ্প কহিল, “হে যুধিষ্ঠির! আমি তোমার বাক্য শ্রবণ করিলাম; তুমি জ্ঞাতব্যবিষয়ে বিলক্ষণ অভিজ্ঞতালাভ করিয়াছ, অতএব তোমার ভ্রাতাকে ভক্ষণ করিব না।”