১৯১. সত্যযুগ-প্রবর্ত্তনা

১৯১তম অধ্যায়

সত্যযুগ-প্রবর্ত্তনা

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “মহারাজ! তৎপরে ভগবান কল্কি চৌরক্ষয় করিয়া মহাযজ্ঞ অশ্বমেধ সমুদয় মেদিনীমণ্ডল ব্রাহ্মণহস্তে সমর্পণ ও লোকমধ্যে বিধাতৃবিহিত মৰ্য্যাদা সংস্থাপনপূর্ব্বক পরমরমণীয় কাননে প্রবেশ করিবেন। ভূলোকবাসী মনুষ্যগণ সেই নিয়মানুসারেই কাৰ্য্য করিবে; সত্যযুগে ব্রাহ্মণগণের প্রভাবে অনায়াসে চৌরক্ষয় [দস্যু-তস্করাদির বিনাশ] হইবে। দ্বিজসত্তম কল্কি পরাজিত দেশসমুদয়ে কৃষ্ণাজিন, শক্তি, ত্ৰিশূল ও অন্যান্য আয়ুধসমুদয় সংস্থাপনপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক সংম্ভূয়মান হইয়া দস্যুদল দলনপূর্ব্বক পৃথিবীমণ্ডল ভ্ৰমণ করিবেন। তখন দস্যগণ দারুণ যাতনায় হা তাত! “হা মাতঃ! হা পুত্র!” বলিয়া করুণস্বরে ক্ৰন্দনপূর্ব্বক তাহাঁর করাল করবালের বলিস্বরূপ হইবে।

“হে মহারাজ! এইরূপে সত্যযুগ আরম্ভ হইলে অধর্ম্মের নাশ, ধর্ম্মের বৃদ্ধি ও মনুষ্যগণ ক্রিয়াবান হইয়া উঠিবে। চতুর্দ্দিকে উপবন, চৈত্য, তাড়াগ, আবসথ [গৃহ], পুষ্করিণী ও দেবতাস্থান-সমুদয় নির্ম্মাণ এবং বিবিধ যজ্ঞ ক্রিয়ানুষ্ঠান হইবে। সর্ব্বদাই ব্রাহ্মণ, সাধু ও তপস্বিগণ দৃষ্ট হইবে। পূর্ব্বে যে সমুদয় আশ্রমে কেবল পাষণ্ড গণকেই দেখা যাইত, এক্ষণে তৎসমুদয় সত্যপরায়ণ জনগণে পরিপূর্ণ হইবে। চিরবদ্ধমূল কুসংস্কার সমুদয় প্ৰজাগণের হৃদয়ক্ষেত্ৰ হইতে দূরীভূত হইবে। সমুদয় ঋতুতেই সমুদয় শস্য সমুৎপন্ন হইবে। মনুষ্যগণ দান, ব্রত ও নিয়মে নিরত হইবে। বিপ্ৰগণ জপ যজ্ঞপরায়ণ, ষট্‌কর্ম্মনিরত, ধর্ম্মভিলাষী ও সতত সন্তুষ্টচিত্ত হইবেন; ক্ষত্ৰিয়গণ বিক্রমে রত হইবেন, ভূপতিগণ ধর্ম্মসহকারে পৃথিবী পালন করিবেন, বৈশ্যগণ ব্যবহারনিরত এবং শূদ্ৰগণ উক্ত বর্ণত্রয়ের শুশ্রূষাপরায়ণ হইবে।

মার্কণ্ডেয়ের বিবিধ ধর্ম্মব্যাখ্যা

“হে রাজন! এই ধর্ম্ম সত্য, ত্রেতা ও দ্বাপরযুগে প্রবল থাকিবে; আর শেষযুগের ধর্ম্ম পূর্ব্বেই পরিকীর্ত্তিত হইয়াছে। যুগসংখ্যা সকলেরই বিদিত আছে। এক্ষণে আমি বায়ুপ্রোক্ত ঋষিগণসংস্তুত পুরাণ অনুসরণ করিয়া তোমার সমীপে সমুদয় অতীত ও অনাগত বিষয় কীর্ত্তন করিলাম। আমি চিরজীবী হইয়া সংসারের এইরূপ গতি অনেকবার নিরীক্ষণ ও স্বয়ং অনুভব করিয়াছি। অধুনা ধর্ম্মসংশয়-মোচনের নিমিত্ত যাহা কহিতেছি, তাহা ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে সাবধানে শ্রবণ কর। ধর্ম্মাত্মা ব্যক্তি উভয়লোকেই সুখ সম্ভোগ করে, অতএব ধর্ম্মে সতত আত্মসংযোগ করা তোমার নিতান্ত কর্ত্তব্য, কদাচ ব্ৰাহ্মণের অপমান করিও না, কারণ, ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হইলে অনায়াসেই সমুদয় লোক বিনষ্ট করিতে পারেন।”

কুরুবংশাবতংস ধীমান যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়ের বাক্যশ্রবণানন্তর কহিলেন, “হে মহর্ষে। আমি কোন ধর্ম্মে থাকিয়া প্ৰজাপালন করিব? আর কিরূপ ব্যবহার করিলে স্বধর্ম্ম রক্ষণ হইবে? বলুন।”

মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে রাজন! তুমি সর্ব্বভূতে দয়াবান, হিতৈষী, লোকানুরক্ত, অসূয়াশূন্য, সত্যবাদী, মৃদু, দান্ত ও প্রজারক্ষণতৎপর হইয়া ধর্ম্মানুষ্ঠান কর, এবং অধর্ম্ম পরিত্যাগ কর; দেবগণ ও পিতৃগণের পূজা কর। যদি প্রমাদাবশতঃ কোন মন্দ কর্ম্ম অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, তবে দানদ্বারা তাহার প্রতিবিধান কর। গর্ব্বিত হইও না; সতত নম্র হইয়া ব্যবহার কর। সমুদয় পৃথিবী পরাজয় করিয়া সুখে কালব্যাপন কর। হে রাজন! আমি এই সমুদয় অতীত ও অনাগত ধর্ম্ম তোমাকে কহিলাম। হে বৎস! কি অতীত, কি অনাগত, তোমার কিছুই অবিদিত নাই; অতএব এই বর্ত্তমান ক্লেশে অভিভূত হইও না। পণ্ডিতগণ কালযোগে কষ্টভোগ করিয়াও বিমুগ্ধ হয়েন না। দেবগণেরও এরূপ সময় সমুপস্থিত হইয়া থাকে ও প্রজাগণ কালবশবর্ত্তী হইয়া অভিভূত হয়। কিন্তু হে রাজন! আমি তোমাকে যাহা কহিলাম তদ্বিষয়ে সন্দেহ করিও না, তাহা হইলে তোমার ধর্ম্মলোপ হইবে। তুমি কুরুগণের বিখ্যাত বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, অতএব কায়মনোবাক্যে আমার উপদেশানুরূপ ব্যবহার কর।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! আপনি আমাকে যেরূপ উপদেশ প্ৰদান করিলেন, আমি পরম যত্নসহকারে তদনুসারে কাৰ্য্য করিব। আমার লোভ, ভয় বা মৎসর কিছুই নাই, আপনি আমাকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিলেন, তৎসমুদয়ই প্রতিপালন করিব।”

বাসুদেবসমবেত পাণ্ডবগণ এবং সমাগত ব্ৰাহ্মণ-সমুদয় মার্কণ্ডেয়র সেই পুরাণ-বৃত্তান্ত শ্রবণে পরম পরিতুষ্ট ও সাতিশয়। বিস্ময়াপন্ন হইয়া রহিলেন।