৯২তম অধ্যায়
কৃষ্ণের কর্ণ তিরস্কার-যুদ্ধে অর্জ্জুন-উদ্বোধন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় বাসুদেব কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! তুমি ভাগ্যক্রমে এক্ষণে ধর্ম্ম স্মরণ করিতেছ। নীচাশয়েরা দুঃখে নিমগ্ন হইয়া প্রায়ই দৈবকে নিন্দা করিয়া থাকে; আপনাদিগের দুষ্কর্ম্মের প্রতি কিছুতেই দৃষ্টিপাত করে না। দেখো, দুর্য্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনি তোমার মতানুসারে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে যখন সভায় আনয়ন করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? যখন দুষ্ট শকুনি দুরভিসন্ধিপরতন্ত্র হইয়া তোমার অনুমোদনে অক্ষক্রীড়ায় নিতান্ত অনভিজ্ঞ রাজা, যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করিয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? যখন রাজা দুর্য্যোধন তোমার মতানুযায়ী হইয়া ভীমসেনকে বিষান্ন [বিষমিশ্রিত অন্ন] ভোজন করাইয়াছিল, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি বারণাবতনগরে জতুগৃহমধ্যে প্রসুপ্ত পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিবার নিমিত্ত অগ্নি প্রদান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি সভামধ্যে দুঃশাসনের বশীভূতা রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে “হে কৃষ্ণে! পাণ্ডবগণ বিনষ্ট হইয়া শাশ্বত নরকে গমন করিয়াছে, এক্ষণে তুমি অন্য পতিকে বরণ কর” এই কথা বলিয়া উপহাস করিয়াছিলে এবং অনাৰ্য্য ব্যক্তিরা তাঁহাকে নিরপরাধে ক্লেশ প্রদান করিলে উপেক্ষা করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি রাজ্যলোভে শকুনিকে আশ্রয়পূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে দ্যূতক্রীড়া করিবার নিমিত্ত আহ্বান করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? যখন তুমি মহারথগণসমবেত হইয়া বালক অভিমন্যুকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক বিনাশ করিয়াছিলে, তখন তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? হে কর্ণ! তুমি যখন তত্তৎকালে অধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়াছ, তখন আর এ সময় ধর্ম্ম ধর্ম্ম করিয়া তালুদেশ শুষ্ক করিলে কি হইবে? তুমি যে এক্ষণে ধর্ম্মপরায়ণ হইলেও জীবন সত্ত্বে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইবে, ইহা কদাচ মনে করিও না। পূর্ব্বে নিষধদেশাধিপতি নল যেমন পুষ্করদ্বারা দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হইয়া পুনরায় রাজ্যলাভ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ধর্ম্মপরায়ণ পাণ্ডবগণও ভুজবলে সোমকদিগের সহিত শত্রুগণকে বিনাশপূর্ব্বক রাজ্যলাভ করিবেন। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ অবশ্যই ধর্ম্মসংরক্ষিত পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হইবে।’
কৃষ্ণবাক্যে কোপপরায়ণ কর্ণের পুনঃ সমর
“হে মহারাজ! মহাবীর সূতনন্দন বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া লজ্জায় অধোবদন হইয়া রহিলেন। তৎকালে তাঁহার মুখে বাকস্ফূৰ্ত্তি হইল না। অনন্তর তিনি ক্রোধে প্রস্ফুরিতাধর হইয়া শরাসন উদ্যত করিয়া অর্জ্জুনের সহিত ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। তদ্দর্শনে বাসুদেব ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে পার্থ! তুমি দিব্যাস্ত্রজাল বিস্তারপূর্ব্বক সূতপুত্রকে বিনাশ কর।’ মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া সূতপুত্রের দুর্ম্মন্ত্রণাজনিত ক্লেশপরম্পরা স্মরণপূর্ব্বক ক্রোধে একান্ত অধীর হইয়া উঠিলেন; তখন তাঁহার লোমকূপ হইতে তেজোরাশি বিনির্গত হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইল। অনন্তর সূতপুত্র ব্রহ্মাস্ত্রের প্রাদুর্ভাব করিয়া ধনঞ্জয়ের উপর অসংখ্য শরবর্ষণপূর্ব্বক পুনরায় তাঁহার রথ নিমগ্ন করিতে যত্নবান হইলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয়ও ব্রহ্মাস্ত্রপ্রভাবে সূতপুত্রের প্রতি শরবৃষ্টি প্রয়োগপূর্ব্বক তাঁহার অস্ত্র নিবারণ করিয়া তাঁহাকে প্রহার করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি কর্ণকে লক্ষ্য করিয়া আগ্নেয়াস্ত্র পরিত্যাগ করিলে, উহা স্বীয় তেজঃপ্রভাবে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তখন কর্ণ বারুণাস্ত্র প্রাদুর্ভূত করিয়া সেই প্রজ্বলিত পাবক নির্ব্বাণ করিলেন। তৎকালে সূতপুত্রের সায়ক প্রভাবে জলদজালে দিঙ্মণ্ডল সমাচ্ছন্ন ও গাঢ়তর তিমিরে চতুর্দ্দিক্ পরিপূর্ণ হইয়া গেল। মহাবীর অর্জ্জুন তদ্দর্শনে অসম্ভ্রান্তচিত্তে বায়ব্যাস্ত্র দ্বারা সূতপুত্রের সমক্ষেই সেই অস্ত্রজাল অপসারিত করিলেন।
“অনন্তর সূতপুত্র ধনঞ্জয়কে সংহার করিবার বাসনায় এক প্রজ্বলিত পাবক সদৃশ ভয়ঙ্কর শর গ্রহণ ও শরাসনে সংযোজন করিলেন। ঐ শর সংযোজিত হইবামাত্র শৈলকাননসম্পন্ন অবনী বিচলিত হইল; সমীরণ কৰ্কররাশি প্রবাহিত করিতে লাগিল; দিঙ্মণ্ডল ধূলিপটলে পরিবৃত হইয়া গেল; দেবগণ দেবলোকে হাহাকার করিতে লাগিলেন এবং পাণ্ডবগণ বিষাদ সাগরে নিমগ্ন হইলেন। তখন সেই কর্ণবিসৃষ্ট অশনিসদৃশ শিতধার সায়ক, ভুজগরাজ যেমন বল্মীকমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ অর্জ্জুনের বক্ষঃস্থলে প্রবেশ করিল। তখন মহাত্মা অর্জ্জুন সূতপুত্রের সায়কে অতিমাত্র বিদ্ধ হওয়াতে তাঁহার হস্তস্থিত গাণ্ডীব কোদণ্ড শিথিল হইয়া পড়িল এবং তিনি ভূমিকম্পকালীন অচলের ন্যায় কম্পিত হইলেন। ঐ অবসরে মহাবীর কর্ণ ভূতলগত স্বীয় রথের উদ্ধারাভিলাষে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া বাহুযুগলদ্বারা রথচক্র গ্রহণ করিয়া আকর্ষণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু দৈবপ্রভাবে কৃতকাৰ্য্য হইতে সমর্থ হইলেন না।
“অনন্তর অর্জ্জুন সংজ্ঞালাভ করিয়া অঞ্জলিক নামে এক যমদণ্ডসদৃশ বাণ গ্রহণ করিলেন। ঐ সময় মহাত্মা বাসুদেব ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে পার্থ! কর্ণ রথে আরোহণ না করিতে করিতেই উহার মস্তকচ্ছেদন কর।’ তখন মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবের আদেশানুসারে প্রজ্বলিত ক্ষুরপ্ৰাস্ত্র গ্রহণ করিয়া সূতপুত্রের রথধ্বজস্থিত বিমলার্কসদৃশ [উজ্জ্বল সুৰ্য্যসদৃশ] হস্তিকক্ষা [ধ্বজকেতু] ছেদন করিলেন। মহাবীর কর্ণের ঐ সুবর্ণ, হীরক ও মণিমুক্তাদিখচিত হস্তিকক্ষাকেতু বহুতর জ্ঞানবৃদ্ধ শিল্পীগণের প্রযত্নে সুন্দররূপে নির্ম্মিত হইয়াছিল। ঐ কক্ষাদর্শনে আপনার সৈন্যগণের মনে বিজয়বাসনা. এবং অরাতিগণের মনে ভয়সঞ্চার হইত। উহার প্রভা চন্দ্র, সূৰ্য্য ও হুতাশনের ন্যায় দেদীপ্যমান ছিল। অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন অগ্নিসদৃশ সুবর্ণপুঙ্খ ক্ষুরপ্রদ্বারা অধিরথনন্দনের ধ্বজদণ্ড ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে কৌরবগণের দর্প, যশ, প্রিয়কাৰ্য্য ও মনোরথসকল ভগ্ন এবং হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। সূতপুত্রের বিজয়াশা তাহাদের মনোমন্দির হইতে এককালে তিরোহিত হইয়া গেল।
অর্জ্জুন-বাণে কর্ণের প্রাণসংহার
“অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন কর্ণের বিনাশবাসনায় তূণীর হইতে ইন্দ্রের বজ্র, হুতাশনের দণ্ড ও দিবাকরের তীক্ষ্ণ রশ্মিসদৃশ অঞ্জলিক নামে এক বাণ গ্রহণ করিলেন। ঐ মর্ম্মভেদী বাণ মাংস ও শোণিত লিপ্ত এবং হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণের প্রাণনাশক। উহার পরিমাণ তিন অরত্নি [কিছু কম তিন হাত] ও ছয় পাদ। উহা ব্যাদিতাস্য কৃতান্তের ন্যায়, মহাদেবের পিনাকের ন্যায় ও নারায়ণের চক্রের ন্যায় নিতান্ত ভীষণ এবং দেবতা ও অসুরগণের বিজয়ে সমর্থ; মহাত্মা অর্জ্জুন সতত উহার পূজা করিতেন। হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় হৃষ্টচিত্তে ঐ অস্ত্র গ্রহণ করাতে চরাচর বিচলিত হইল। তদ্দর্শনে মহর্ষিগণ জগতের মঙ্গল প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাধনুর্দ্ধর ধনঞ্জয় সেই অনুপম মহাস্ত্র শরাসনে সংযোজিত করিয়া গাণ্ডীব আকর্ষণপূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে কহিলেন যে, ‘যদি আমি তপানুষ্ঠান, গুরুজনের সন্তোষসাধন ও সুহৃদগণের হিতকথা শ্রবণ করিয়া থাকি, তাহা হইলে এই অরাতিঘাতন মহাস্ত্র অবিলম্বে প্রবল শত্রু সূতপুত্রের প্রাণসংহারপূর্ব্বক আমাকে জয়শ্রী প্রদান করুক।’ মহাবীর অর্জ্জুন এই বলিয়া সেই অন্তকেরও অনতিক্ৰমণীয় সাক্ষাৎ আথর্ব্বণ [বৃহস্পতিকৃত অথর্ব্ব বেদোক্ত অভিচার ক্রিয়া-অসুরবধের জন্য সুরগুরু বৃহস্পতি ঐরূপ আশুফলপ্রদ ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করিতেন] ও আঙ্গিরস কার্য্যের ন্যায় অতি ভীষণ, চন্দ্রসূৰ্য্যসমপ্রভ অঞ্জলিক শর সূতপুত্রের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত মন্ত্রপূত সায়ক সেই অপরাহ্ণকালে দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া, পুরন্দরনিক্ষিপ্ত বজ্ৰাস্ত্র যেমন বৃত্রাসুরের শিরচ্ছেদন করিয়াছিল, তদ্রূপ সূতপুত্রের মস্তকচ্ছেদন করিল। তখন কর্ণের সেই ছিন্নমস্তক গৃহস্থ যেমন অতিক্লেশে ধনরত্নপরিপূর্ণ গৃহ পরিত্যাগ করে, তদ্রূপ তাঁহার সাতিশয় সুরূপ, সতত সুখোপভোগপরিবর্ধিত দেহ অতিকষ্টে পরিত্যাগপূর্ব্বক শরৎকালীন নভোমণ্ডল হইতে নিপতিত দিবাকরের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। অনন্তর সূতপুত্রের ধনঞ্জয়শরনির্ভিন্ন [অর্জ্জুনবাণে ছিন্ন] উন্নত কলেবর ও কুলিশবিদলিত [বজ্রবিদারিত] গৈরিক ধারাস্রাবী গিরিশিখরের ন্যায় ধরাশয্যা গ্রহণ করিল।
কর্ণমরণে কৌরবপলায়ন
“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর সূতপুত্র সমরে নিপতিত হইলে, তাঁহার দেহ হইতে একটি তেজ বিনির্গত হইয়া নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া সুৰ্য্যমণ্ডলে প্রবিষ্ট হইল। তদ্দর্শনে যোধগণ সাতিশয় বিস্মিত হইয়া রহিল। ঐ সময় বাসুদেবসমবেত ধনঞ্জয় ও অন্যান্য পাণ্ডবগণ সূতপুত্রের নিধনে যারপরনাই আহ্লাদিত হইয়া অতি গম্ভীরস্বরে শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। সোমকগণ সৈন্যগণসমভিব্যাহারে সিংহনাদ, তূৰ্য্যধ্বনি এবং অস্ত্র ও হস্ত নিধূনন করিতে আরম্ভ করিলেন। অন্যান্য যোধগণ প্রফুল্লমনে অর্জ্জুনসন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক তাঁহার সংবর্দ্ধনা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কতকগুলি বীর পরস্পরকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক নৃত্য ও সিংহনাদ করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘আজ ভাগ্যবলে সূতপুত্র ধনঞ্জয়ের শরনিকরে বিনষ্ট হইয়া ভূতলে নিপতিত হইয়াছে।’
“হে মহারাজ! এইরূপে সূতপুত্র শরনিকরে পাণ্ডবসৈন্যগণকে সন্তপ্ত করিয়া দিবাবসানসময়ে অর্জ্জুনের ভুজবীর্য্যপ্রভাবে বিনষ্ট হইলেন। তাঁহার সমরাঙ্গনে নিপতিত ছিন্নমস্তক যজ্ঞাবসানে প্রশান্ত হুতাশনের ন্যায়, অস্তগত সূর্য্যবিম্বের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তাঁহার শরনিকর-সমাচিত শোণিতপরিপ্লুত [রক্তাক্ত] কলেবর কিরণজালপরিব্যাপ্ত সূর্য্যের ন্যায় শোভমান হইল। দিবাকর যেমন অস্তগমনকালে স্বীয় প্রভাজাল লইয়া গমন করেন, তদ্রূপ অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত শর কর্ণের প্রাণ লইয়া গমন করিল, কৌরবগণও শত্রুশরে গাঢ়তর বিদ্ধ ও ভয়বিগহ্বল হইয়া অর্জ্জুনের প্রভাপুঞ্জোদ্ভাসিত [প্রভাসমূহে প্রদীপ্ত] ধ্বজ বারংবার নিরীক্ষণ করিয়া দশদিকে ধাবমান হইলেন।”