১২২. চ্যবন-ঋষির সুকন্যা-পাণিগ্রহণ

১২২তম অধ্যায়

চ্যবন-ঋষির সুকন্যা-পাণিগ্রহণ

লোমশ কহিলেন, মহারাজ! মহর্ষি ভৃগুর চ্যবননামে এক পুত্র জন্মে; মহাতেজাঃ ভৃগুনন্দন এক সরোবরতীরে তপস্যা করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি পৈতৃক বীরাসনে স্থাণুর ন্যায় সমাসীন হইয়া একস্থানেই অনল্পকাল অতিবাহিত করিলেন। ক্ৰমে ক্রমে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ লতাবলয়সংবৃত ও পিপীলিকাসমাকীর্ণ হওয়াতে বল্মীকবৎ প্রতীয়মান হইয়া উঠিলেন। এইরূপে ধীমান ভার্গব মৃৎপিণ্ডের ন্যায় হইয়া ঘোরতর তপস্যা করিতে লাগিলেন। বহুকাল অতীত হইলে পর একদা রাজা শৰ্য্যাতি সস্ত্রীক হইয়া বিহারার্থ সেই সুরম্য সরোবরে আগমন করিলেন। তাঁহার চতুঃসহস্ৰ মহিষী; কিন্তু একটিমাত্র কন্যা ছিল, তাঁহার নাম সুকন্যা। রাজতনয়া সুকন্যা রমণীয় বেশ-ভূষা সমাধানপূর্ব্বক সখীগণসমভিব্যাহারে ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ, বনস্থলীর শোভাসন্দর্শন ও বনস্পতিবীথির নাম, গুণ প্রভৃতি পরিচয় গ্রহণপূর্ব্বক ভাৰ্গবের বল্মীকসমীপে উপনীত হইলেন। রূপানিধান সুকন্যা যৌবনকালসূলভ গর্ব্ব ও মদনমদে অন্ধ হইয়া সম্যক পুষ্পিত পাদপশাখাসকল ভগ্ন করিতে লাগিলেন।

‘বিপ্ৰর্ষি চ্যবন নিবিড় অরণ্যমধ্যে সঞ্চারিণী অচিরপ্রভার ন্যায় নানাভরণবিভূষিতা একাকিনী কামিনীকে নয়নগোচর করিয়া আনন্দপ্রবাহে নিমগ্ন হইলেন এবং বারংবার তাঁহাকে সম্ভাষণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তিনি দীর্ঘকাল তপানুষ্ঠাননিবন্ধন সাতিশয় ক্ষীণকণ্ঠ হইয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার বাক্য রাজকুমারীর শ্রবণগোচর হইল না। অনন্তর নৃপকন্যা সুকন্যা বাল্মীকে ভার্গবের নয়নদ্বয় নিরীক্ষণ করিয়া মোহ-প্রেরিত ও কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া ‘ইহা কি?’ এই বলিয়া কণ্টকদ্বারা উহা বিদ্ধ করিলেন। তখন তপোধন চ্যবন নেত্ৰোপঘাতে সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া শৰ্য্যাতি রাজার সৈন্যগণের শৌচ-প্রস্রাব অবরুদ্ধ করিলেন, তাহাতে সৈন্যের মহতী পীড়া উপস্থিত দেখিয়া রাজা শৰ্য্যাতি জিজ্ঞাসা করিলেন, “যদি তোমরা কেহ জ্ঞানকৃত অথবা অজ্ঞানকৃত মহাত্মা ভার্গবের নিকট কোন অপরাধ করিয়া থাক, তাহা হইলে অবিলম্বে আমার নিকট ব্যক্ত কর।” সৈনিকেরা কহিল, “মহারাজা! আমরা অপকারের বিষয় কিছুমাত্র অবগত নহি, আপনি বরং যত্নাতিশয়সহকারে সেই মহৰ্ষির নিকট গমনপূর্ব্বক ইহার বিশেষ অনুসন্ধান করুন।” তখন মহীপাল সান্ত্ববাদ ও উগ্রবচনে সুহ্যদ্বর্গকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু তাঁহারাও এ বিষয়ের কিছুমাত্র জ্ঞাত ছিলেন না। অনন্তর সুকন্যা মলসংরোধজন্য সৈন্যদিগকে দুঃখার্ত্ত ও পিতাকে বিষণ্ন দেখিয়া কহিলেন, “তাত! অদ্য ভ্রমণ করিতে করিতে সহসা এক বল্মীকে খদ্যোতের ন্যায় কোন উজ্জ্বল পদার্থ দর্শনপূর্ব্বক নিকটবর্ত্তিনী হইয়া কণ্টকদ্বারা তাহা বিদ্ধ করিয়াছি।” রাজা শৰ্য্যাতি এই কথা শ্রবণমাত্র ব্যগ্র হইয়া দ্রুতপদে বল্মীকসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক অনিষ্ট-শান্তির নিমিত্ত কৃতাঞ্জলিপুটে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া কহিলেন, “হে তপোধন! মদীয় দুহিতা অজ্ঞানবশতঃ আপনার নিকট যে অপরাধ করিয়াছে, তাহা মার্জ্জন করুন।” চ্যবন কহিলেন, “মহারাজ! আপনার কন্যা রূপযৌবনমদে মত্ত হইয়া আমাকে অবমানিত ও নয়নাহিত করিয়াছে, অতএব আমি সত্য কহিতেছি, সেই মোহপরায়ণা লাবণ্যবতী যুবতীর পাণিগ্রহণ না করিয়া ক্ষান্ত হইব না।”

“রাজা ঋষিবাক্য-শ্রবণানন্তর সদসদ্‌বিচার না করিয়া তৎক্ষণাৎ মহাত্মা চ্যবনকে কন্যা সম্প্রদান করিলেন। ভগবান চ্যবন সেই কন্যা পতিগ্রহ করিয়া রাজার প্রতি প্রসন্ন হইলে পর মহীপাল সৈন্যসামন্ত-সমভিব্যাহারে নগরে প্রত্যাগমন করিলেন। এখানে শুভাননা সুকন্যা তপস্বী-পতিলাভে প্রীত ও অসূয়াশূন্য হইয়া প্রতিদিন তপস্যা, নিয়ম, অতিথিসৎকার এবং অগ্নিশুশ্রূষাদ্বারা স্বামীর পরিচর্য্যা করিতে লাগিলেন।”