১১৮. পাণ্ডবগণের প্রভাসিতীর্থে গমন

১১৮তম অধ্যায়

পাণ্ডবগণের প্রভাসিতীর্থে গমন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অতি সচ্চরিত্র রাজা যুধিষ্ঠির কোন কোন স্থানে ব্রাহ্মণগণোপশোভিত রমণীয় সাগরতীর্থ-সমুদয় সন্দর্শন ও সেই সকল স্থানে অবগাহন করিয়া অনুজগণ-সমভিব্যাহারে সমুদ্রগা পুণ্যততা প্রশস্তা-নাম্নী নদীতে উপস্থিত হইলেন। তথায় স্নান করিয়া পিতৃগণ ও সুরগণের তর্পণ এবং দ্বিজগণকে ধনদানপূর্ব্বক সাগর-গামিনী গোদাবরী-তীর্থে গমন করিলেন। তৎপরে বিগত পাপ হইয়া দ্রাবিড়-দেশের অতিপবিত্ৰ সাগরে গমনপূর্ব্বক মহাপবিত্র অগস্ত্য-তীর্থ ও নারীতীর্থসমুদয় সন্দর্শন করিতে লাগিলেন। তথায় মহর্ষিগণের সাদর সৎকারগ্রহণপূর্ব্বক ধনুৰ্দ্ধারাগ্রগণ্য অর্জ্জুনের আলোকসামান্য কর্ম্মসকল কর্ণগোচর করিয়া পরমপ্রীতিলাভ করিলেন। তৎপরে দ্রৌপদী ও অনুজগণের সহিত সেই সমস্ত তীর্থে স্নান ও অর্জ্জুনের বলবিক্রমের সবিস্তর প্রশংসা করিয়া আনন্দিত হইলেন। অনন্তর সাগরের সেই সমস্ত তীর্থে গোসহস্ৰ দান করিয়া প্ৰহৃষ্ট-মনে ভ্রাতৃগণের সহিত অর্জ্জুনের গোদান-কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন এবং তত্ৰত্য অন্যান্য অতি-পবিত্র বহুতর তীর্থ ক্রমশঃ পৰ্যটনপূর্ব্বক পূৰ্ণকাম হইয়া অতিপাবন সুপারক তীর্থ সন্দর্শন করিলেন। অনন্তর সাগরপ্রদেশ অতিক্ৰম করিয়া অতিবিখ্যাত এক অরণ্যে উপনীত হইলেন; পূর্ব্বে সুরগণ যে স্থানে ঘোরতর তপানুষ্ঠান এবং পুণ্যাত্মা নরেন্দ্ৰগণ যজ্ঞসমাধান করিয়াছিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির সেই স্থানে ধনুৰ্দ্ধারাগ্রগণ্য রামের তপস্বিজনপরিবৃত অনির্ব্বাচনীয় এক বেদী সন্দর্শন করিলেন।

অনন্তর তিনি অষ্টবসু, দেবতা, অশ্বিনীকুমার, বৈবস্তত আদিত্য, ধনেশ্বর, ইন্দ্র, বিষ্ণু, সবিতা, ভব, চন্দ্র, দিবাকর, বরুণ, 
সাধ্যগণ, ধাতা, পিতৃগণ, সগণ রুদ্র, সরস্বতী, সিদ্ধগণ ও অন্যান্য অমরগণের অতিপবিত্ৰ মনোহর আয়তনসকল সন্দর্শন করিলেন। তথায় উপবাসপূ
র্ব্বক মহার্হ রত্ন প্রদান ও তত্ৰত্য তীর্থসমূদয়ে স্নান করিয়া পুনরায় সুপারক-তীর্থে উপস্থিত হইলেন। পরে দ্বিজগণ, সোদারগণ ও দ্রৌপদী-সমভিব্যাহারে সেই সাগর-তীর্থপথ অবলম্বনপূর্ব্বক মহর্ষি লোমশের সহিত অতিপ্ৰখ্যাত প্ৰভাসতীর্থে উপস্থিত হইয়া তথায় স্নান এবং দেব ও পিতৃগণের তর্পণ করিলেন। ধর্ম্মপরায়ণ রাজা যুধিষ্ঠির দ্বাদশ দিবস জলবায়ু ভক্ষণপূর্ব্বক তথায় অহোরাত্ৰ স্নান এবং চতুর্দ্দিকে অগ্নি প্ৰদীপিত করিয়া অতিকঠোর তপস্যায় অভিনিবিষ্ট হইলেন। এই অবসরে বৃষ্ণিবংশাবতংস রাম ও কৃষ্ণ রাজা যুধিষ্ঠিরকে তপানুষ্ঠাননিরত শ্ৰবণ করিয়া সৈন্যগণসমভিব্যাহারে তথায় আগমন করিলেন। তাঁহারা পাণ্ডবগণকে ভূতলশায়ী ও মলবিলিপ্তকলেবর এবং দ্রৌপদীকে তাদৃশ বিসদৃশ অবস্থায় নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া দুঃখিত-মনে বিলাপ করিতে আরম্ভ করিলেন।

অনন্তর যুধিষ্ঠির রাম, কৃষ্ণ, প্ৰদ্যুম্ন, শাল্ব, সাত্যকি ও অন্যান্য বৃষ্ণিবংশীয়দিগকে ধর্ম্মানুসারে সৎকার করিলে অন্যান্য পাণ্ডবগণও তাঁহাদিগকে পূজা করিলেন। পরে পাণ্ডবগণ তাঁহাদিগের কর্ত্তৃক প্ৰতিপূজিত হইলেন। যেমন দেবগণ দেবরাজ ইন্দ্ৰকে পরিবেষ্টন করিয়া উপবিষ্ট হইয়া থাকেন, সেইরূপ বৃষ্ণিবংশীয়েরা যুধিষ্ঠিরকে চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া উপবিষ্ট হইলেন। রাজা যুধিষ্ঠির হৃষ্টান্তকরণে তাঁহাদিগের সমক্ষে বিপক্ষগণের অত্যাচার, আপনাদিগের বনবাস ও অর্জ্জুনের অস্ত্ৰলাভার্থ ইন্দ্ৰসন্নিধানে গমন-বার্ত্তা নিবেদন করিলেন। তাহারা পাণ্ডবগণের করুণ-বাক্য শ্রবণ ও নিতান্ত ক্ষীণতা নিরীক্ষণ করিয়া অবিরলধারে অশ্রুজল বিসর্জ্জন করিতে লাগিলেন।