১৪৯. হনূমানের নিকট ভীমের যুগধর্ম্মাদি কথন

১৪৯তম অধ্যায়

হনূমানের নিকট ভীমের যুগধর্ম্মাদি কথন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাবীর ভীমসেন এইরূপ অভিহিত হইয়া হৃষ্টান্তঃকরণে হনূমানকে প্ৰণিপাতপূর্ব্বক প্রীতিসহকারে কহিলেন, “মহাশয়! আমি আপনার সাক্ষাৎকারলাভ করিয়া ধন্য ও কৃতাৰ্থন্মন্য হইলাম, আপনি আমার প্রতি সবিশেষ অনুগ্রহ প্ৰকাশ করিলেন, এক্ষণে আমার এক প্রিয়কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করুন। পূর্ব্বে মকরনক্রসার্থ [মকর কুম্ভীর দল] সঙ্কুল

মহাসাগর লঙ্ঘন করিবার সময় যেরূপ নিরুপম রূপ প্রতিগ্ৰহ করিয়াছিলেন, তাহা এক্ষণে আমি নিরীক্ষণ করিতে ইচ্ছা করি। হে বীর্য! তাহা হইলে আমি একান্ত সন্তুষ্ট ও কৃতাৰ্থ হইব এবং আপনার বাক্যে শ্রদ্ধা করিব।” হনূমান এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র সহাস্যমুখে কহিলেন, “ভ্রাতঃ! এক্ষণে তুমি হও বা অন্যই হউক, কেহই আমার পূর্ব্বরূপ নিরীক্ষণে সমর্থ হইবে না; কারণ, তৎকালে অন্যপ্রকার কালাবস্থা ছিল, সম্প্রতি তাহার অন্যথা হইয়াছে; সত্য, ত্রেতা-ও দ্বাপর এই কালত্ৰয়ের পৃথক পৃথক অবস্থা নিরূপিত আছে। এক্ষণে ধ্বংসকারী কাল উপস্থিত, আর আমার সেরূপ রূপ নাই। ভূমি, নদী, শৈল, সিদ্ধ, দেব ও মহর্ষিগণ ইঁহারা যুগপৰ্য্যায়ে সমভাবে কালের অনুবর্ত্তী হইয়া থাকেন; কিন্তু বল, প্রভাব ও দেহ এই সকল কেবল হীনতা ও বৃদ্ধিলাভ করে, অতএব আমার পূর্ব্বরূপ-দর্শনে আর অভিলাষ করিও না। কালধর্ম্ম নিতান্ত দূরতিক্রমণীয়, আমি এক্ষণে তাঁহারই অনুবর্ত্তী হইয়াছি।”

ভীম কহিলেন, “হে কপিবর! এক্ষণে যুগের সংখ্যা, আচার, ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, তত্ত্ব, কর্ম্ম, বীৰ্য্য, উৎপত্তি ও বিনাশ এই কয়েকটি বিষয় কীর্ত্তন করুন, আমি শ্রবণ করিব।” হনূমান কহিলেন, “হে বৎস! প্রথমতঃ সত্যযুগ, ঐ যুগে ধর্ম্ম সনাতন, লোকসকল কৃতকৃত্য হইত। এই যুগে ধর্ম্ম অবসন্ন বা প্ৰজাক্ষয় হইত না, এই কারণ, উহা সত্যযুগ বলিয়া বিখ্যাত, কিন্তু ঐ যুগ মুখ্য হইয়াও কালক্রমে অপ্রাধান্যপ্রাপ্ত হইয়াছে। তৎকালে দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও পন্নগেরা পরস্পর উপদ্রবরহিত ছিল, ক্ৰয়বিক্রয়ের সম্পর্ক ছিল না। সাম, ঋক ও যজুর্ব্বেদানুসারে ক্রিয়াকলাপ নির্ব্বাহ হইত না, কৃষি প্রভৃতি মানুষী ক্রিয়াসকল বিলুপ্ত হইয়াছিল। লোকের সঙ্কল্পানুসারে সমস্ত ফল সম্পন্ন হইত ও সন্ন্যাসই পরমধর্ম্ম ছিল। যুগপ্রভাবে ব্যাধি ও ইন্দ্ৰিয়ক্ষয় হইত না। অসূয়া, রোদন, দৰ্প, কপট, বিগ্রহ, আলস্য, দ্বেষ, বৈশুন্য, ভয়, সন্তাপ, ঈৰ্ষা ও মাৎসৰ্য্য ইহার নামগন্ধও ছিল না। যোগীদিগের পরব্রহ্মই পরমগতি, শুক্ল নারায়ণ সর্ব্বভূতের আত্মা, তৎকালে স্বতঃসিদ্ধ; শম-দম প্রভৃতি গুণসম্পন্ন স্বকর্ম্ম-নিরত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র ইহারাই প্ৰজা ছিলেন। সমানকর্ম্মবিশিষ্ট এই বর্ণচতুষ্টয়া ব্ৰহ্মাশ্রয়ী, ব্রহ্মগতি ও ব্ৰহ্মজ্ঞানী ছিলেন এবং একমাত্ৰ ব্ৰহ্মাকে অবলম্বন করিয়া ধর্ম্মোপার্জ্জন করিতেন। তাঁহারা এক দেব পরমাত্মা, এক প্রাণরূপ মন্ত্র, এক বেদান্তশ্রবণাদিরূপ বিধি ও এক ধ্যানদিস্থরূপ ক্রিয়ার অনুসরণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা পৃথক ধর্ম্মসম্পন্ন হইলেও এক বেদ ও একপ্রকার কর্ম্মে নিয়তব্রত ছিলেন এবং কামফলবিবর্জ্জিত হইয়া আশ্রমচতুষ্টয়াসমুচিত দশাদি কর্ম্মদ্বারা পরমগতি প্ৰাপ্ত হইতেন। ব্ৰহ্মযোগসমাযুক্ত ধর্ম্মই সত্যযুগের লক্ষণ; এই যুগে চাতুর্ব্বর্ণ্যের ধর্ম্ম পাদচতুষ্টয়সম্পূর্ণ ও শাশ্বত। হে ভীম! সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণবিবর্জ্জিত সত্যযুগের লক্ষণ কীর্ত্তন করিলাম, এক্ষণে ত্রেতাযুগের বিষয় আরম্ভ করিতেছি, শ্রবণ কর।

“ত্রেতাযুগে সত্ৰানুষ্ঠানের বিধি আছে, ধর্ম্ম একপাদমাত্র পরিহন ও নারায়ণ রক্তবর্ণ হইয়া থাকেন; মনুষ্য ক্রিয়া ও ধর্ম্মপরায়ণ এবং সত্যব্ৰত সত্য প্রবৃত্ত হয়। তৎকালে লোকে সঙ্কল্প করিয়া দানাদিক্রিয়া করিলে ফল হইয়া থাকে। তপোদানপরায়ণ মনুষ্যগণ ধর্ম্মপথ হইতে কদাচ পরিভ্রষ্ট হয়েন না। প্রত্যুত তাঁহারা স্বধর্ম্মনিরত ও ক্রিয়াবান হইয়া থাকেন।

“দ্বাপরযুগে ধর্ম্ম দ্বিপাদবিহীন ; নারায়ণ পীতবর্ণ এবং বেদ চারিভাগে বিভক্ত। তন্মধ্যে কেহ চতুর্ব্বেদ, কেহ ত্ৰিবেদ, কেহ দ্বিবেদ ও কেহ বা একবেদ অধ্যয়ন করিতেন, কেহ কেহ বা এককালে বেদাধ্যয়নে পরাঙ্মুখ হইতেন। এইরূপে শাস্ত্ৰ বিভিন্ন হইলে ক্রমশঃ ক্রিয়াকলাপের বাহুল্য হইয়া উঠিল। প্ৰজাসকল তপোদাননিরত হইয়া রজোগুণাবলম্বী হইতে লাগিল। এক বেদ বহু দিবসে ও বহু ক্লেশে অধ্যয়ন করিতে হয় বলিয়া বহু সংখ্যায় বিভক্ত হইল। দ্বাপরে সত্ত্বগুণের প্রাদুর্ভাব নাই, এই জন্য অনেকে সত্যের আশ্রয় লইল, কিন্তু সত্ত্বগুণবিহীন লোকসকল বহুবিধ ব্যাধি, কাম ও অন্যান্য দৈব উপদ্ৰবদ্বারা আক্রান্ত হইতে লাগিল। ঐরূপ উপদ্রবে পীড়িত হইয়া মানবগণের মধ্যে কেহ কেহ তপস্যা, কেহ কেহ বা কামপ্রার্থী ও কেহ বা স্বৰ্গার্থী হইয়া যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। হে ভীম! এইরূপে দ্বাপরযুগে প্রজারা অধর্ম্মদোষে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

“অনন্তর কলিযুগ; এই যুগে ধর্ম্ম একপাদমাত্র বিদ্যমান আছে; তমোগুণ-প্রধান কলিযুগে নারায়ণ কৃষ্ণবর্ণ হইয়া থাকেন; বেদাচার, ধর্ম্ম, যজ্ঞ ও ক্রিয়াকলাপ বিলুপ্ত হইতেছে। অতিবৃষ্টি প্রভৃতি উপদ্রব, ব্যাধি, আলস্য, দোষ, রোষ, আধি, ক্ষুৎভয় প্রাদুর্ভূত হয়; যুগানাশে ধর্ম্মের নাশ হইয়া থাকে এবং ধর্ম্মের নাশে লোক-সমুদয় বিনষ্ট হয়। এইরূপে লোক-সকল বিনষ্ট ও লোকপ্রবর্ত্তক ধর্ম্মজ্ঞানসকলও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। যুগক্ষয়কালীন ধর্ম্মদ্বারা প্রার্থনা-সকল বিফল হইয়া থাকে। হে ভীম! এই কলিযুগের লক্ষণ, ইহা অচিরাৎ প্রবর্ত্তিত হইবে। আমি এই যুগেরই অনুবর্ত্তী হইব, আমাকে জানিবার নিমিত্ত তোমার একান্ত কৌতুহল হইয়াছে, এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, নিরর্থক বিষয়ের অনুসন্ধানে কি নিমিত্ত তোমার ঈদৃশ অভিনিবেশ হইল? হে বীর! তুমি আমাকে যে যুগসংখ্যার বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছ, তাহা সমুদয়ই কহিলাম, এক্ষণে নির্ব্বিঘ্নে গমন কর।”