১৩৭. পুত্ৰশোকে ভরদ্বাজের জীবনবিসর্জ্জন

১৩৭তম অধ্যায়

পুত্ৰশোকে ভরদ্বাজের জীবনবিসর্জ্জন

লোমশ কহিলেন, “রাজন! অনন্তর ভরদ্বাজ স্বাধ্যায়রূপ আহ্নিক সমাধানপূর্ব্বক সমিৎকলাপ হস্তে লইয়া আশ্রমে প্রবেশ করিলেন। পূর্ব্বে আশ্রম-প্রবেশসময়ে পঞ্চাগ্নি তাহার প্রত্যুদগমন করিতেন; কিন্তু তৎকালে তাহাকে মৃতপুত্র নিরীক্ষণ করিয়া প্রত্যুত্থান করিলেন না। তখন মহর্ষি অগ্নিহোত্রের বিকৃতভাব সন্দর্শন করিয়া গৃহরক্ষক শূদ্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে শূদ্র! অদ্য কি নিমিত্ত অগ্নিগণ আমার প্রত্যুদগমন করিতেছেন না, আর কি নিমিত্তই বা তুমি আমাকে অবলোকন করিয়া পূর্ব্ববৎ অভিনন্দন করিলে না? এক্ষণে আশ্রমের ত’ কুশল? আমার আত্মজ যবক্ৰীত রৈভের নিকট ত’ গমন করে নাই? হে শূদ্ৰ! তুমি শীঘ্ৰ বল, আমার মন সাতিশয় সন্দিহান হইতেছে।”

“শূদ্র কহিল, ভগবন! আপনার পুত্র মন্দমতি যবক্ৰীত রৈভ্যসন্নিধানে গমন করিয়াছিলেন; আপনার পুত্র যবক্ৰীত এক শূলধারী রাক্ষসকর্ত্তৃক নিরোধ্যমান হইয়া অগ্নিশরণে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইলেন, এই অবসরে আমি বাহুযুগল দ্বারা তাহাকে নিবারণ করিলাম। কারণ, তিনি তৎকালে অশুচি ছিলেন, পরে হতাশ হইয়া পুনরায় প্রবেশ করিবার নিমিত্ত যখন জলান্বেষণ করিতে লাগিলেন, এই অবসরে সেই শূলধারী রাক্ষস দ্রুতবেগে আসিয়া তাহাকে সংহার করিল। সম্প্রতি তিনি ভূতলে শয়ন করিয়া রহিয়াছেন।”

“মহর্ষি ভরদ্বাজ শূদ্রমুখ হইতে এই অপ্রিয় সংবাদ শ্রবণে একান্ত দুঃখিত-মনে মৃতপুত্র যবক্ৰীতকে ক্রোড়ে লইয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন, ‘হা বৎস! তুমি দ্বিজগণের শুভসঙ্কল্পে অনধীত বেদসকল প্রতিভাত হইবে বিলিয়া তপানুষ্ঠান করিয়াছিলে। তুমি ব্রাহ্মণগণের মধ্যে বিশেষ কল্যাণভাজন, তুমি কর্কশ স্বভাব পরিগ্রহ করিয়াও নিরপরাধ ছিলে, আমি তোমাকে রৈভ্যের আশ্রমপদে গমন করিতে নিষেধ করিয়াছিলাম, তথাপি তুমি সেই কালান্তকসম আশ্রম দর্শন করিতে গিয়াছিলে। হা বৎস! তুমি আমার একমাত্র পুত্র, দুর্ম্মতি রৈভ্য ইহা অবগত হইয়াও রোষাভরে তোমার প্রাণসংহার করিল। ফলতঃ আমি ক্রুরকর্ম্ম রৈভ্য হইতে পুত্ৰশোক প্রাপ্ত হইলাম। হা তাত! এক্ষণে আমি তোমা ব্যতিরেকে কোনক্রমেই প্ৰাণধারণ করিতে সমর্থ নহি, আমি শীঘ্রই প্ৰাণ পরিত্যাগ করিয়া এই দুর্ব্বিষহ শোক হইতে মুক্ত হইব; আমি যেমন পুত্ৰশোকে কাতর হইয়া প্ৰাণ বিসর্জ্জন করিতেছি, সেইরূপ রৈভ্যের জ্যেষ্ঠপুত্র বিনা অপরাধে তাহাকে সংহার করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। যাহাদিগের জন্মাবচ্ছিন্নে পুত্ৰ নাই, তাহারাই স্বেচ্ছানুসারে সুখভোগ করিতে সমর্থ হয়। তাহারা কখন মর্ম্মচ্ছেদী শোকশঙ্কুর আঘাতপ্রাপ্ত হয় না। যাহারা পুত্ৰশোকে নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া প্রিয়তর মিত্রকে অভিশাপ প্রদান করে, তাহাদিগের অপেক্ষা পাপাচার্যপরায়ণ আর কে আছে? আমি পুত্ৰকে গতাসু দেখিয়া প্রিয়সখা রৈভ্যকে অভিশাপ প্ৰদান করিয়াছি, এক্ষণে আমা অপেক্ষা বিপদাপন্ন আর দ্বিতীয় নাই।” মহর্ষি ভরদ্বাজ এইরূপ বহুবিধ বিলাপ ও অনুতাপ প্রকাশপূর্ব্বক পুত্ৰকে দাহ করিয়া পরিশেষে স্বয়ং প্রজ্বলিত পাবকে প্রবিষ্ট হইলেন।”