১৪৫. ঘটোৎকচ-বাহিত দ্রৌপদীর গমন

১৪৫তম অধ্যায়

ঘটোৎকচ-বাহিত দ্রৌপদীর গমন

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ভীম! রাক্ষসপুঙ্গব ঘটোৎকচ দ্রৌপদীকে গ্রহণ করুন; আমি তোমার বাহুবলে পাঞ্চালীর সহিত অক্ষত-শরীরে গন্ধমাদনে গমন করিব।” তখন ভীমসেন জ্যেষ্ঠের আদেশানুসারে ঘটোৎকচকে আদেশ করিলেন, “হে ঘটোৎকচ! তোমার মাতা অতিপরিশ্রান্ত ও গমন করিতে নিতান্ত অশক্ত হইয়াছিলেন; তুমি এক্ষণে কামগামী হইয়া তাহাকে বহন কর; ইহাতে অবশ্যই তোমার মঙ্গল হইবে। তুমি দ্রৌপদীকে স্কন্ধে লইয়া অন্তরীক্ষে আমাদিগের মধ্যবর্ত্তী হইয়া মন্দগতিতে গমন করিবে; অতিদ্রুতবেগে গমন করিলে ইনি পীড়িত ও শঙ্কিত হইবেন।” ঘটোৎকচ কহিলেন, “হে তাত! আমি একাকীই ধর্ম্মরাজ, ধৌম্য, নকুল, সহদেব ও দ্রৌপদীকে বহন করিতে পারি, বিশেষতঃ অদ্য সহায়সম্পন্ন হইয়াছি। আর কামরূপী অন্যান্য শতসংখ্যক গগনচর রাক্ষস আসিয়া ব্ৰাহ্মণগণ-সমভি ব্যাহারে আপনাদিগের সকলকেই বহন করিবে।”

ঘটোৎকচাদিষ্ট অন্যান্য রাক্ষস বাহিত পাণ্ডবগণের গমন

এই বলিয়া ঘটোৎকচ পাণ্ডবগণের মধ্যবর্ত্তী হইয়া দ্রৌপদীকে বহন করিবার নিমিত্ত স্কন্ধে লইলেন এবং অন্যান্য রাক্ষস আসিয়া পাণ্ডবদিগকে স্কন্ধে লইল। মহর্ষি লোমশ স্বকীয় প্রভাবে দ্বিতীয় ভাস্করের ন্যায় অন্তরীক্ষের সিদ্ধমার্গে গমন করিলেন। রাক্ষসেন্দ্ৰ ঘটোৎকচের আদেশানুসারে অন্যান্য রাক্ষসেরা ব্ৰাহ্মণগণকে বহন করিতে লাগিল। তাহারা অতিরমণীয় বন ও উপবন অবলোকনপূর্ব্বক বিশালা বদরীতে গমন করিলেন এবং রাক্ষসগণের আশুগতিপ্ৰযুক্ত অনতিবিলম্বে অতিবিস্তীর্ণ পথ অল্প পথের ন্যায় উত্তীর্ণ হইলেন। গমনকালে ম্লেচ্ছজনসমাকীর্ণ রত্নাকরসংযুক্ত দেশসকল এবং বহুবিধ ধাতুরাগরঞ্জিত, কিন্নর, কিম্পপুরুষ, গন্ধর্ব্ব ও বিদ্যাধরাধ্যুষিত, রুরুমৃগ, ময়ুর, চামর, বানর, বরাহ, গবয় ও মহিষবৃন্দ-সমাবৃত, বিহঙ্গমকুল-কূজিত, বহুবিধ পাদপরাজিবিরাজিত, নদীশতসমলঙ্কৃত প্রত্যন্তপর্ব্বত সমস্ত-সন্দর্শন করিলেন।

এইরূপে তাঁহারা বহুতর প্রদেশ ও উত্তরকুরু অতিক্রম করিয়া বিবিধ আশ্চৰ্য্যসম্পন্ন গিরিবর। কৈলাস সন্দর্শনপূর্ব্বক সন্নিহিত নরনারায়ণাশ্রম নিরীক্ষণ করিলেন। তৎপরে পরামশোভিত, মধুর মধুস্রব সুস্বাদুফলপূর্ণ, অবিরল কোমল-পল্লবযুক্ত, স্নিগ্ধচ্ছায়াসম্পন্ন, বিহগকুলসমাকুল, বিশাল-শাখাশালী, মহর্ষিগণসেবিত, সুজাতস্কন্ধ, অতিমনোহর ও কণ্টকশূন্য বদরীতরু দর্শন করিলেন। সেই স্থান দংশমশকবিরহিত; বহু মূলফল সংযুক্ত, শাদ্বলসমাকীর্ণ স্বভাবতঃ সমতল ও হিমসম্পর্কে সুখসেব্য এবং মৃদুস্পর্শ। ঐ প্রদেশে নিরবচ্ছিন্ন দেব ও গন্ধর্ব্বগণ বাস করিয়া থাকেন।

পাণ্ডবগণের বদরিকাশ্রম দর্শন

পাণ্ডবেরা ব্ৰাহ্মণগণ-সমভিব্যাহারে বদরীতে উপনীত হইয়া রাক্ষসস্কন্ধ হইতে অবতীর্ণ হইলেন; তৎপরে নরনারায়ণাশ্ৰিত, তমোগুণবিরোহিত, সূর্য্যকরসস্পর্শবিবির্জ্জিত, দিব্য পুষ্পোপহারবিরাজিত, ক্ষুৎপিপাসাদোষশূন্য, সর্ব্বভূতশরণ্য, শোকনাশন, ব্রাহ্মীশোভাসমন্বিত পূর্ণকুম্ভোপশোভিত, ব্ৰহ্মঘোষনিনাদিত, শ্রমনাশন, আশ্রয়ণীয় দিব্য-আশ্রম সন্দর্শন করিলেন। ঐ আশ্রমে অধার্ম্মিক লোকের সঞ্চার নাই; কেবল ফলমূলাশী, অজিনাম্বরধারী, সূর্য্যসম তেজস্বী, ব্রহ্মবাদী, মোক্ষপর, মহাভাগ মহর্ষিগণ সতত বাস করিতেছেন। কোন স্থানে বিশাল অগ্নিশরণ ও স্রূগ্‌ভাণ্ড ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে, কোন স্থানে অনুলেপন সংঘৃষ্ট হইতেছে, কোন স্থানে পূজোপহার পরিকল্পিত রহিয়াছে।

রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃবৰ্গ-সমভিব্যাহারে মহর্ষিগণসন্নিধানে উপনীত হইলে তাঁহারা যুধিষ্ঠিরকে উপস্থিত দেখিয়া প্রীতমনে প্ৰত্যুদগমন ও আশীর্ব্বাদ প্রয়োগপূর্ব্বক সৎকারার্থ ফলমূল ও স্বচ্ছ সলিল আহরণ করিলেন। ধর্ম্মরাজ মহর্ষিগণসমাহাত সৎকার গ্ৰহণ করিয়া পরামপ্রীত ও প্ৰসন্ন হইলেন। তৎপরে বেদবেদাঙ্গ পারগ ব্ৰাহ্মণগণের সহিত দেবলোকসদৃশ মনোরম শক্রসদনপ্রস্থে প্রবেশপূর্ব্বক ভাগীরথী পরিশোভিত দেবর্ষিগণপূজিত নরনারায়ণস্থান সন্দর্শন করিলেন। তথায় দেবর্ষিগণসেবিত মধুস্রব দিব্যফল অবলোকনপূর্ব্বক আনন্দিত হইলেন। অনন্তর সেই ফললাভ করিয়া প্রীতমনে ব্রাহ্মণগণের সহিত পরমসুখে সেই স্থানে বাস করিতে লাগিলেন। তথায় বিহঙ্গমগণনিনাদিত হিরণ্যশিখর মৈনাক ও মনোহর বিন্দুসরোবর সন্দর্শন করিলেন। তৎপরে তাঁহারা দ্রৌপদী-সহিত সকল ঋতু-কুসুমশোভিত মনোজ্ঞ এক কাননে বিহার করিতে লাগিলেন। তথায় কোকিলাকুলকূজিত ফলভারাবরত পাদপাবলী অবিলল শীতল ছায়াদ্বারা লোকের ক্লান্তি দূর করিতেছে। প্রসন্নসলিল কমলোৎপলশোভিত সরোবরসকল অনির্ব্বচনীয় শোভা সম্পাদন করিতেছে এবং সুগন্ধ গন্ধবহ মন্দ মন্দ সঞ্চরণ করিতেছে। পাণ্ডবেরা এই সমস্ত রমণীয় বস্তু নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। অনন্তর বিশালা বদরীসন্নিধানে মণিপ্রবালনির্ম্মিত তীর্থপরম্পরাপরিশোভিত৷ দিব্যপুস্পসমাকীর্ণ ভাগীরথী সন্দর্শন করিলেন। তৎপরে পাণ্ডবেরা সেই পরম-দুৰ্গম দেবর্ষিচরিত প্রদেশে ভাগীরথীর অতিপবিত্ৰ জলে দেব ও ঋষিগণের তর্পণ করিলেন এবং দ্রৌপদীর সহিত বিচিত্র ক্রীড়াদর্শন ও জপ-তপসংসাধনপূর্ব্বক পরমসুখে বাস করিতে লাগিলেন।