১৪১. যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক পথ-গমনে সাবধানোক্তি

১৪১তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক পথ-গমনে সাবধানোক্তি

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ভীমসেন! হে নকুল! হে সহদেব! হে পাঞ্চালি! তোমরা সকলে শ্রবণ কর, প্রাক্তন কর্ম্মের ভোগ ব্যতীত কখনও ক্ষয় হয় না, প্রালব্ধ ফলেই আমাদিগকে বনাচর হইতে হইয়াছে। আমরা নিতান্ত দুর্ব্বল ও একান্ত ক্লান্ত হইয়াছি, তথাপি কেবল সেই প্ৰাণাধিক প্রিয়তমের মুখশশী সন্দর্শন করিবার নিমিত্ত পরস্পরের সাহায্যে এই দুৰ্গম স্থান দিয়া গমন করিতে সাহস করিয়াছি; কিন্তু আমার কলেবর সেই বীরচূড়ামণির অদর্শনে অনলাকবলিত তূলারাশির ন্যায় দহ্যমান হইতেছে। হে বীর! একে অনুজগণের সহিত বনবাসী ও অর্জ্জুনের বিরহে উৎকণ্ঠিত হইয়াছি, তাহাতে আবার যাজ্ঞসেনীর এই নিগ্ৰহ আমাকে সন্তাপিত করিতেছে। হে বৃকোদর! আমি সেই অমিততেজাঃ অজেয় অর্জ্জুনকে অবলোকন না করিয়াই পরিতাপিত হইতেছি। তাঁহার দর্শন-লালসায় তোমাদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া তীর্থ, বন ও জলাশয় সকল পরিভ্রমণ করিতেছি। হে বীর! যিনি সমস্ত ধন জয় করিয়া আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন, যিনি সত্যসন্ধ, যাঁহাতে অভিমানের লেশমাত্ৰও নাই, যিনি বিক্রমে ও গমনে সিংহের ন্যায়, অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী, সংগ্রামে কুশল, অদ্বিতীয় ধনুৰ্দ্ধর, কৌরবকুলের গৌরবস্বরূপ, যিনি ক্রুদ্ধ হইলে অরাতিগণের পক্ষে কালান্তক যমোপম, আজি পঞ্চ বৎসর হইল, সেই শ্যামকলেবর প্রিয়সহোদর নয়নের অন্তরাল হইয়াছেন, আমি তাঁহার আদর্শনেই পরিতাপিত হইতেছি। যিনি বল ও ধনসম্পতিতে দেবরাজের সমান, সেই শ্বেতবাহন এক্ষণে দারুণ দুঃখের হস্তে নিপতিত হইয়াছেন; আমি তাঁহার অদর্শনেই পরিতাপিত হইতেছি। যিনি ক্ষুদ্রজনকর্ত্তৃক অবমানিত হইলেও কখন ক্ষমা করিতে পরাঙ্মুখ হইতেন না, যিনি সরল-পথপরায়ণ ব্যক্তির অভয়দাতা, কপটাচারে প্রবৃত্ত জিঘাংসু ব্যক্তি বজ্রধরের ন্যায় প্রতাপশালী হইলেও যিনি তাহার দণ্ডদাতা, যিনি শরণাগত শাত্ৰবগণের প্রতিও কৃপাবান, আমাদিগের অবলম্বন, সর্ব্বরত্নের আহর্ত্তা, সকলের সুখাবহ; যাঁহার বাহুবলে নানাবিধ দিব্যরত্নসকল লাভ করিয়াছিলাম, যাঁহার ভুজবীৰ্য্যে সর্ব্বরত্নময়ী ভুবনবিখ্যাত সভার অধিকারী হইয়াছিলাম, যিনি পরাক্রমে ত্রিবিক্রমের ন্যায়, সমরে কার্ত্তবীর্য্যের ন্যায়, সেই অর্জ্জুন আমার নয়নপথ অতিক্রম করিয়াছেন। যিনি স্বীয় ভুজবীব্যপ্রভাবে বলরাম, বাসুদেব ও তোমার অনুকরণ করিয়াছেন, যিনি বাহুবলে ও প্রভাবে পুরন্দরসমান, বেগে সমীরণ-সদৃশ, মুখশোভায় সোমতুল্য এবং কোপসময়ে শমন-সমান, এক্ষণে আমরা সেই বীরবারের দর্শনাভিলাষে এই যক্ষগণের নিবাসভূমি মহাগিরি গন্ধমাদনে প্রবেশপূর্ব্বক সকল সন্দর্শন করিব, যে স্থানে নারায়ণের বিশাল বদরী-আশ্রম বিদ্যমান রহিয়াছে। অনন্তর আমরা অতিকঠোর তপস্যার অনুষ্ঠানপূর্ব্বক রাক্ষসগণসেবিত মনোহর কুবের সরোবরে পদব্রজে গমন করিব। যে স্থানে যানারোহী, নৃশংস, লুব্ধ বা অপ্রশান্তচিত্ত ব্যক্তি গমন করিতে সমর্থ হয় না, আমরা খড়্গাদি আয়ুধ গ্রহণপূর্ব্বক ব্ৰতপরায়ণ বিপ্ৰগণসমভিব্যাহারে অর্জ্জুনের অন্বেষণে সেই গন্ধমাদনে গমন করিব। তথায় মক্ষিকা দংশ, মশক, সিংহ, ব্যাঘ্র ও ভূজঙ্গময় অসংযতাচার ব্যক্তিকেই আক্রমণ করে, নিয়মানুগত লোকের কিছুমাত্র অপকার করিতে পারে না, অতএব আমরা নিয়তাচার ও মিতাচার হইয়া অর্জ্জুনের অন্বেষণে এই গন্ধমাদনে প্রবেশ করিব।”