১২৯. যযাতি মরুত্ব প্রভৃতির যজ্ঞক্ষেত্ৰ-বৰ্ণন

১২৯তম অধ্যায়

যযাতি মরুত্ব প্রভৃতির যজ্ঞক্ষেত্ৰ-বৰ্ণন

লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! প্রজাপতি স্বয়ং পূর্ব্বে এই স্থানে ইষ্টাকৃতনামে সহস্ৰ-বর্ষব্যাপী যজ্ঞ করিয়াছিলেন। নাভাগনন্দন অম্বরীষ এই যমুনাসমীপে যজ্ঞ করিয়া সদস্যগণকে দক্ষিণাস্বরূপ দশপদ্ম গোদানপূর্ব্বক বিবিধ যজ্ঞ ও তপস্যাদ্বারা পরম সিদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছেন। যিনি যাগশীল, পুণ্যকর্ম্ম, সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ও অমিততেজাঃ, যিনি দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট স্পৰ্দ্ধা প্রকাশ করিতেন, এই সেই নহুষাত্মজ যযাতির যজ্ঞভূমি দেখুন। এই ভূমি নানাবিধ আকৃতিবিশিষ্ট বহ্নিস্থাপনের স্থণ্ডিলে নিচিত হওয়াতে বোধ হয় যেন যযাতির যজ্ঞকর্ম্মে আক্রান্ত হইয়া নিমগ্ন হইতেছে এবং এই একপত্রা শমী ও মনোহর পানিপাত্ৰ বিদ্যমান রহিয়াছে। এদিকে পঞ্চ রামহ্রদ ও নারায়ণাশ্রম অবলোকন করুন। যিনি যোগপ্রভাবে মহীতলে বিচরণ করিতেন, এই রৌপ্যবর্ণ তটিনীসমীপে সেই অমিততেজঃ চার্চ্চীক-পুত্রের সঞ্চারণভূমি।

“এই স্থানে উদূখলভূষণা পিশাচী যাহা কহিয়াছিল, আমি সেই কিংবদন্তী বলিতেছি, শ্রবণ করুন। ‘যুগন্ধর প্রদেশের দধিপ্রাশন, অচ্যুতস্থলে বাস ও ভূতিলয়-স্থানে স্নান করিয়া সপুত্রা হইয়া এই তীর্থে বাস করা উচিত; নতুবা এই স্থানে একরাত্রি বাস করিয়া পুনরায় দ্বিতীয় দিন বাস করাতে তোমার এইরূপ অবস্থা হইয়াছে; কিন্তু দ্বিতীয় রাত্রি বাস করিলে ইহা অপেক্ষা দুরবস্থা ঘটিবে।

[অর্থাৎ এক ব্রাহ্মণী পুত্র-সমভিব্যাহারে এই তীর্থে স্নান করিতে আগমন করিয়াছিলেন। তিনি প্রথমতঃ যুগন্ধর-দেশের দধি ভোজন করেন। তথায় উষ্ট্রী ও গর্দ্দভী প্রভৃতির দুগ্ধে দধি প্ৰস্তুত হইয়া থাকে। সুতরাং উহা ভোজন করিলে প্ৰায়শ্চিত্ত করিতে হয়। দ্বিতীয়তঃ, তিনি আচ্যুতস্থল-নামক সঙ্করজাতির গ্রামে বাস করিয়াছিলেন; তাহাও ধর্ম্মশাস্ত্ৰবিরুদ্ধ। তৃতীয়তঃ, ভূতিলয়-নামক গ্রামের যে নদীতে মৃতব্যক্তির শরীর নিক্ষেপ করে, তিনি তথায় স্নান করিয়াছিলেন; উহাও পাপজনক। এইরূপ উক্ত শাস্ত্ৰ-প্রতিষিদ্ধ ত্ৰিবিধ কর্ম্মের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক পাপভাগী হইয়া তীর্থবাসে অনধিকারিণী হইয়াছিলেন। এই নিমিত্ত এক পিশাচী আসিয়া ঐ ব্রাহ্মণীকে প্রথমতঃ নিষেধ করিল, তিনি তাহা অবহেলন করিয়া তথায় একরাত্রি বাস করিলেন; তাহাতে ঐ পিশাচী রোষপরবশ হইয়া তাহার ঘট-পিঠরাদি [পাত্ৰাদি] বস্তুসকল বিনষ্ট করিয়া এই কথা কহিয়াছিল।

কেহ কেহ কহেন, যুগন্ধরাদি দেশে দধি-প্রাশনাদি কর্ম্মত্ৰয়ের অনুষ্ঠান করিয়া উক্ত তীর্থে একরাত্রিমাত্র বাস করিবে; তাহার অন্যথা করিলে অধর্ম্মভাগী হইতে হয়, ইহাই প্ৰতিপন্ন করিবার নিমিত্ত এই পিশাচীবাক্য কল্পিত হইয়াছে। [নীলকণ্ঠ টীকা]]

“হে কুরুনন্দন! এই স্থান কুরুক্ষেত্রের দ্বারস্বরূপ, অতএব অদ্য আমরা এই স্থানেই যামিনী যাপন করিব।

“হে রাজন! এই স্থানে নহুষনন্দন যযাতি রত্নসমূহদ্বারা দেবরাজের আনন্দবৰ্দ্ধন ও বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। পণ্ডিতগণ এই যমুনাতীরগত প্লক্ষাবতরণ-তীর্থকে স্বর্গের দ্বার বলিয়া নির্দেশ করেন। মহর্ষিগণ ঘৃত ও পশুদ্বারা সারস্বত যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া এই তীর্থে অবভৃথস্নান সমাধান করিতেন। নানা যজ্ঞের অনুষ্ঠাতা মহারাজ ভরত ধর্ম্মানুসারে পৃথিবী জয় করিয়া বারংবার এই স্থানে অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক কৃষ্ণসারঙ্গ পবিত্র অশ্ব পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। রাজা মরুত্ত মহর্ষি সংবর্ত্ত কর্ত্তৃক প্রতিপালিত হইয়া এই তীর্থে অনুত্তম যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। হে রাজেন্দ্ৰ! এই তীর্থে স্নান করিলে সমুদয় লোক দৰ্শন করিতে সমর্থ ও দুষ্কৃত হইতে বিমুক্ত হয়, অতএব এই স্থানে স্নান করুন।”

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির ও তাঁহার ভ্রাতৃগণ সেই তীর্থে অবগাহন করিলেন ও তত্ৰস্থ মহর্ষিগণ রাজা যুধিষ্ঠিরকে স্তব করিতে লাগিলেন। তিনি তখন লোমশ-মুনিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে সত্যবিক্ৰম! আমি এই স্থানে অবস্থিতি করিয়াই তপঃপ্রভাবে সকল লোক ও পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুনকে দর্শন করিতেছি।”

লোমশ কহিলেন, “হে মহাবাহো! মহর্ষিগণ এবম্প্রকারে সকল লোক ও দেবরাজকে দর্শন করেন, এই পুণ্যশীলজনপরিবৃত পুণ্যদা সরস্বতীতে স্নান করিলে বিগতপাপ হইবেন। ঋষি, দেবর্ষি ও রাজর্ষিগণ এই স্থানে সারস্বত-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। প্রজাপতির পঞ্চ যোজন আয়তা বেদী মহাত্মা কুরুর ক্ষেত্র এই স্থানে বিদ্যমান রহিয়াছে।”