১৩৪. অষ্টাবক্রের যজ্ঞসভা-প্ৰবেশ

১৩৪তম অধ্যায়

অষ্টাবক্রের যজ্ঞসভা-প্ৰবেশ

“অষ্টাবক্র কহিলেন, ‘হে রাজন! আমি উগ্রসেন প্রভৃতি অপ্রতিম রাজগণমধ্যে কোন ব্যক্তি বাদিশ্রেষ্ঠ বন্দী, তাহা অবগত হইতে অক্ষম হইয়াছি, এক্ষণে যেমন লোকে মহাজলস্থ হংসকে অন্বেষণ করে, তদ্রূপ আমি তাহাকে অন্বেষণ করিতেছি। হে অতিবাদিমানিন্‌ বন্দিন্‌! তুমি পণ করিয়া আমার বাক্যের প্রত্যুত্তর-প্রদানে কদাচ সমর্থ হইবে না; প্রত্যুত নদীবেগ, যেমন যুগান্তকালীন জ্বলনের নিকট শুষ্ক হইয়া যায়, তদ্রূপ তুমি আমার নিকট বিনাশপ্রাপ্ত হইবে। তুমি প্রসুপ্ত ব্যাঘ্র ও রোষপরবশ বিষধরকে প্রতিবোধিত করিও না, তাহাদিগের মস্তকে পদাঘাত করিলে কদাচ তাহাদের করাল কবল হইতে নিষ্কৃতি পাইবে না। যে দুর্ব্বল ব্যক্তি পর্ব্বত ধ্বংস করিবার মানসে সগর্ব্বে উহাতে আঘাত করে, তাহারই হস্ত ও নখসমুদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়; কিন্তু পর্ব্বতের কিছুমাত্ৰ হানি হয় না। যেমন পর্ব্বতসকল মৈনাক অপেক্ষা নিকৃষ্ট, যেমন বৎসগণ অনডান্‌ অপেক্ষা নীচ, তদ্রূপ সমুদয় রাজগণ জনকনৃপতি অপেক্ষা অপকৃষ্ট। হে রাজন! যেমন সুররাজ সমুদয় দেবগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যেমন গঙ্গা সমুদয় স্রোতস্বতী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, তদ্রূপ আপনি সমুদয় ভূপতিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; অতএব আপনি এক্ষণে অনুগ্রহপূর্ব্বক বন্দীকে আমার নিকট আনয়ন করুন।”

সভাপণ্ডিত বন্দীর সহিত অষ্টাবক্রের বিচার

“মহাপ্রভাবসম্পন্ন অষ্টাবক্ৰ সভামধ্যে এইরূপ তর্জ্জন-গর্জ্জন করিয়া জগতক্ৰোধ হইয়া বন্দীকে কহিতে লাগিলেন, “হে বন্দিন! আমি যে কথা কহিব, তুমি তাহার উত্তর প্রদান করিবে এবং তুমি যে-সকল বাক্য কহিবে, আমিও তৎক্ষণাৎ তাহার উত্তর প্রদান করিব।”

“বন্দী কহিলেন, ‘এক অগ্নি বহুপ্রকারে প্রদীপ্ত হয়েন, এক সূৰ্য্য এই সমস্ত লোকে আলোক প্রদান করেন, এক বীর দেবরাজ আরিকুলের নিহন্তা এবং এক যম পিতৃগণের ঈশ্বর।”

“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, ‘ইন্দ্র ও অগ্নি এই দুই সখা একত্ৰ ভ্ৰমণ করেন, নারদ ও পর্ব্বত এই দুইজন দেবর্ষি, অশ্বিনীকুমারেরা দুইজন, রথের চক্র দুইখানা, বিধাতুবিহিত জায়া এবং পতিও দুই।”

“বন্দী কহিলেন, “লোক স্ব স্ব কর্ম্মানুসারে ত্ৰিবিধ জন্মগ্রহণ করে, তিন বেদ একত্র হইয়া সমগ্র বাজপেয় সুসম্পন্ন করে, অধ্বর্য্যুগণ ত্ৰিবিধ স্নানের বিধি বিধান করেন, লোক তিন প্রকার এবং জ্যোতিও ত্ৰিদিব।”

“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, ‘ব্রাহ্মণগণের আশ্রম চতুর্ব্বিধ, চারি বর্ণ জ্ঞানযজ্ঞের অধিকারী, দিক চারি, বর্ণচতুষ্টয় ও গবী চতুষ্পদা।”

“বন্দী কহিলেন, “অগ্নি পঞ্চপ্রকার, পংক্তিচ্ছন্দ পঞ্চপদ-যুক্ত, যজ্ঞ পঞ্চবিধ, ইন্দ্ৰিয় পঞ্চ, বেদে অনুসন্ধান্নাত্মিকা চিত্তবৃত্তি পঞ্চ প্রকার দৃষ্ট হইয়া থাকে ও পবিত্ৰ পঞ্চনদ লোকমধ্যে খ্যাত রহিয়াছে।”

“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, “অগ্ন্যান্ধানে দক্ষিণস্বরূপ ছয়টি গো দান করিয়া থাকে, ঋতু ছয়, ইন্দ্ৰিয় ছয় ও কৃত্তিকা ছয় বলিয়া বিখ্যাত আছে এবং ছয় সাদ্যস্কনামক যজ্ঞ সর্ব্ববেদেই বিহিত হইয়াছে।”

“বন্দী কহিলেন, “গ্রাম্য পশু সপ্তবিধ, বন্যপশু সপ্তবিধ, সপ্ত ছন্দ এক যজ্ঞ সম্পন্ন করে, সপ্তর্ষিমণ্ডল লোকে বিখ্যাত, অর্হণা সপ্তপ্রকার ও বীণা সপ্ততন্ত্রী।”

“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, “আটটি গোণী শত-পরিমিত দ্রব্য ধারণ করে, অষ্টপাদ, শরভ সিংহকে বিনষ্ট করিয়া থাকে, দেবগণমধ্যে আটজন বসু প্ৰসিদ্ধ আছেন, এবং অষ্টকোণবিশিষ্ট যূপ সর্ব্বযজ্ঞেই বিহিত হইয়া থাকে।”

“বন্দী কহিলেন, “পিতৃ যজ্ঞে সামধেনী মন্ত্র নববিধ ও ত্ৰিগুণাত্মিক প্রকৃতি অবান্তর-গুণভেদে নয় প্রকার হইয়া বিবিধ সৃষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে, বৃহতী নবাক্ষরা ও একাদি নয় পৰ্যন্ত নয়টি অঙ্কদ্বারা সমুদয় গণনা সম্পন্ন হইয়া থাকে।”

“অষ্টবক্ৰ কহিলেন, “দশ দিক, শত সংখ্যা দশগুণিত হইলে সহস্র হয়, স্ত্রীগণ দশমাস গর্ভধারণ করিয়া থাকে, দশজন তত্ত্বের উপদেষ্টা, দশজন দ্বেষ্টা ও দশজন অধিকারী।”

‘বন্দী কহিলেন, ‘প্ৰাণীদিগের ইন্দ্ৰিয়বিষয় একাদশ, সেই একাদশ বিষয়ই তত্ত্বজ্ঞানের প্রতিবন্ধক, ইন্দ্ৰিয়বিকার একাদশ প্রকার ও স্বর্গে একাদশ রুদ্র সুপ্ৰসিদ্ধ আছেন।”

“অষ্টাবক্ৰ কহিলেন, “দ্বাদশ মাসে সংবৎসর হয়, জগতীচ্ছন্দের প্রত্যেক পাদে দ্বাদশ অক্ষর, প্রাকৃত যজ্ঞ দ্বাদশ দিনে সম্পন্ন হয়, দ্বাদশ আদিত্য ত্ৰিলোকবিখ্যাত।”

“বন্দী কহিলেন, ত্ৰিয়োদশী তিথি প্রশস্ত বলিয়া উক্ত আছে ও পৃথিবী ত্ৰয়োদশ দ্বীপবিশিষ্ট।’

“বন্দী এই অসম্পূর্ণ বাক্য বলিয়া নিস্তব্ধ হইলে অষ্টবক্র উহা পূরণ করিবার নিমিত্ত কহিলেন, ‘আত্মা বিষয়েন্দ্ৰিয়সম্বন্ধ রূপ ত্ৰয়োদশ প্রকার ভোগে আসক্ত হয়েন ও ধর্ম্মাদি সমুদয় বুদ্ধ্যাদি ত্ৰৈয়োদশের নাশক।”

বিচারে বন্দীর পরাজয়

“তখন সভাস্থলে বন্দীকে নিস্তব্ধ ও অধোমুখে চিন্তাপর নিরীক্ষণ এবং অষ্টাবক্রের বাগাড়ম্বর শ্রবণ করিয়া সভাস্থ লোকসকল ঘোরতর নিনাদ করিতে লাগিলেন। এইরূপে জনকনৃপতির সেই প্রভূত-সম্পত্তি-সম্পন্ন যজ্ঞ জনগণের কলরবে: ব্যাপ্ত হইলে পর তত্রস্থ ব্রাহ্মণগণ কৃতাঞ্জলিপুটে আগমনপূর্ব্বক অষ্টাবক্রের পূজা করিলেন।

“তখন অষ্টাবক্ৰ কহিলেন, “এই বন্দী পূর্ব্বে ব্রাহ্মণগণকে বাদে পরাজয় করিয়া সলিলমধ্যে নিমগ্ন করিয়াছে, এক্ষণে উহাকে জলে নিমগ্ন কর।”

“বন্দী কহিলেন, ‘আমি বরুণ-রাজের পুত্র, তিনি জনকনৃপতির ন্যায় দ্বাদশবার্ষিক যজ্ঞ আরম্ভ করিয়াছেন, আমি তন্নিমিত্ত তথায় ব্রাহ্মণগণকে প্রেরণ করিয়াছি। সেই সমুদয় ব্ৰাহ্মণগণ তাঁহার যজ্ঞ অবলোকন করিতে গিয়াছেন। তাঁহারা পুনরায় আগমন করিতেছেন। আমি পূজনীয় অষ্টাবক্ৰ ঋষিকে পূজা করি; যেহেতু, তাঁহার প্রসাদে অদ্য স্বীয় জনয়িতা বিরুণের সমীপে গমন করিব।”

“অষ্টাবক্ৰ কহিলেন, ‘বন্দী যে বাক্য বা মেধাদ্বারা বিদ্বান ব্ৰাহ্মণগণকে পরাজয় করিয়া সমুদ্রজলে নিমজ্জিত করিয়াছে, আমি স্বীয় মেধাসহকারে সেই বাক্য যেরূপ খণ্ডন করিলাম, তাহা অবশ্যই বিচক্ষণ ব্যক্তির বোধগম্য হইবে। সদসদ্ব্যবহারাভিজ্ঞ পাবক যেমন স্বীয় তেজোদ্বারা সত্যপরায়ণ সাধু ব্যক্তির শরীর দাহ করেন না, তদ্রূপ বিদ্বান ব্যক্তি বালকের অতি ক্ষুদ্র বাক্যেও অবমাননা করেন না। ইহাতে বোধ হয়, বুদ্ধিনাশক শ্লেষ্মাতকীবৃক্ষ তোমাকে নিতান্ত নিস্তেজ করিয়াছে, সুতরাং তুমি হস্তীর ন্যায় আহত হইয়াও আমার বাক্য শ্রবণ করিতেছ না।”

“জনক কহিলেন, “হে ব্ৰাহ্মণকুমার! আমি আপনার অমানুষ দিব্যাবাক্য শ্রবণ করিয়া বোধ করিলাম, আপনি সাক্ষাৎ দেবস্বরূপ। আপনি বিবাদে বন্দীকে পরাজয় করিয়াছেন, অতএব তিনি অবশ্যই মহাশয়ের অভিলাষানুরূপ কর্ম্ম করিবেন।”

“অষ্টাবক্ৰ কহিলেন, “হে রাজন! যদি বরুণ বন্দীর পিতা, তবে উহাকে এক্ষণে জলাশয়ে নিমগ্ন করিবার কিছুমাত্র প্রতিবন্ধক নাই; ও জীবিত থাকিলে আমার কি উপকার হইবে?”

“বন্দী কহিলেন, ‘আমি বরুণ-রাজের পুত্র, জলমগ্ন হইতে আমার কিছুমাত্র শঙ্কা নাই। সে যাহা হউক, আমি এক্ষণে নিশ্চয় কহিতেছি, অষ্টবক্র এই মুহুর্তেই চিরবিনষ্ট স্বীয় পিতা কগোড়ের সন্দর্শনপ্রাপ্ত হইবেন।”

“ইতিমধ্যে বন্দিনিমজ্জিত বিপ্ৰগণ বরুণকর্ত্তৃক পূজিত ও জলাশয় হইতে সমুত্থিত হইয়া জনকের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন কহোড় কহিতে লাগিলেন, “হে জনক! লোকে এই নিমিত্তই পুত্রের কামনা করে। যেহেতু, অবলের বলবান, অজ্ঞের পণ্ডিত এবং অবিদ্বানেরও বিদ্বান পুত্র জন্মিয়া থাকে। দেখুন, আমি যাহা করিতে অসমর্থ হইয়াছিলাম, আমার পুত্র অনায়াসে তাহা সম্পন্ন করিল। হে মহারাজ! আপনার মঙ্গল হউক, বৃদ্ধকালে যম স্বয়ং আসিয়া শাণিত পরশুদ্বারা আপনার শত্ৰুগণের শিরশ্ছেদন করিয়া থাকেন। আপনার এই যজ্ঞে ঔকথ্য ও সাম সুচারুরূপে গীত এবং সোমরস প্রচুর পরিমাণে পীত হইতেছে এবং দেবগণ পরিতুষ্ট হইয়া পবিত্ৰ যজ্ঞভাগ-সমুদয় গ্ৰহণ করিতেছেন।”

অক্টাবক্রের অষ্টবক্রতার অপনোদন

“এইরূপে সমুদয় জলনিমগ্ন ব্রাহ্মণ পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর প্রভাসম্পন্ন হইয়া জলাশয় হইতে সমুত্থিত হইলে পর বন্দী জনক-নৃপতির অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক সাগরজলে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন অষ্টবক্ৰ স্বীয় পিতাকে পূজা করিয়া ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া মাতুলসমভিব্যাহারে স্বীয় আশ্রমে গমন করিলেন অনন্তর কহোড় মাতৃসমীপস্থিত অষ্টবক্রকে এই সমঙ্গা-নাম্নী নিম্নগার মধ্যে প্রবেশ করিতে আদেশ করিলে, তিনি পিতৃবাক্যানুসারে নদীমধ্যে প্রবেশ করিবামাত্র তাঁহার শরীরের বক্রতা-সকল বিনষ্ট হইল। এই নদীতে প্রবেশমাত্র অষ্টাবক্রের অঙ্গসকল সমভাবপ্রাপ্ত হইয়াছিল, এই বলিয়া তদবধি ইহার নাম সমঙ্গা হইয়াছে। এই নদী পরমপবিত্ৰ, ইহাতে স্নান করিলে পাপমোচন হয়; অতএব হে মহারাজ যুধিষ্ঠির! আপনিও ভ্রাতৃগণ, ভাৰ্য্যা এবং বিপ্ৰগণ-সমভিব্যাহারে ইহাতে অবগাহন ও ইহার জল পানপূর্ব্বক এই স্থানে পরমসুখে বাস করিয়া অন্যান্য পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করুন।”