১৩৫. ভরদ্বাজ-ঋষির লোকান্তর-বৃত্তান্ত

১৩৫তম অধ্যায়

ভরদ্বাজ-ঋষির লোকান্তর-বৃত্তান্ত

লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! এই সমঙ্গা নদী প্রবাহিত রহিয়াছে, এই কর্দ্দমিলনামে ভরতের অভিষেচনস্থান দৃষ্ট হইতেছে। শচীপতি ইন্দ্ৰ বৃত্ৰবধানন্তর অলক্ষ্মীযুক্ত হইয়া সমঙ্গায় মানপূর্ব্বক সর্ব্বপাপ হইতে বিমুক্ত হইয়াছিলেন। মৈনাককুক্ষিতে বিনশন-তীৰ্থ দৃষ্ট হইতেছে—পূর্ব্বে যে স্থানে অদিতি পুত্রের নিমিত্ত অন্নপাক করিয়াছিলেন। আপনি এই পর্ব্বতে অধিরূঢ় হইয়া অযশস্করী নিন্দনীয় অলক্ষ্মীর অপনয়ন করুন। হে রাজন! ঋষিদিগের প্রিয় এই কনখল পর্ব্বতশ্রেণী ও ঐ মহানদী গঙ্গা বিরাজমান রহিয়াছেন। পূর্ব্বে ভগবান সনৎকুমার এই স্থানে সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন। আপনি এই নদীতে অবগাহন করিয়া সর্ব্বপাপ হইতে বিমুক্ত হউন। আপনি ভৃত্যামাত্যের সহিত পুণ্যাখ্যহ্রদ, ভৃগুতুঙ্গ পর্ব্বত এবং উষ্ণীগঙ্গে অবগাহন করুন। এই মহর্ষি স্থূলশিরার রমণীয় আশ্রমপদ শোভমান হইতেছে, এই স্থানে ক্রোধ ও অভিমান বিসর্জ্জন করুন। হে পাণ্ডবেয়! এই শ্ৰীমান রৈভ্যাশ্রম শোভা পাইতেছে; এই স্থানে ভরদ্বাজতনয় যবক্রীত বিনষ্ট হইয়াছিলেন।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! মহাপ্রভাবসম্পন্ন ভরদ্বাজ কিরূপ যোগী ছিলেন এবং তিনি কি নিমিত্তই বা মানবলীলা সংবরণ করিলেন, তৎসমুদয় আনুপূর্ব্বিক শ্রবণ করিতে বাসনা করি। আপনি দেবকল্প ঋষিগণের কীর্ত্তি কীর্ত্তনপূর্ব্বক আমাকে চরিতার্থ করুন।”

ভরদ্বাজতনয় যবক্রীতের তপস্যা

লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! মহর্ষি ভরদ্বাজ ও রৈভ্য ইঁহারা দুইজন বন্ধু ছিলেন; উভয়ে অবিচলিত সদ্ভাবে এই স্থানে বহুকাল অতিবাহিত করেন। রৈভের অর্ব্বাবসু ও পরাবসুনামে দুই পুত্র এবং ভরদ্ধাজের যবক্রীতনামে এক পুত্র জন্মে। রৈভ্য ও তদীয় আত্মজদ্বয় অসাধারণ বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন; ভরদ্বাজ তপস্বী মাত্র ছিলেন। বাল্যাবধি তাঁহাদিগের অনুপম যশোরাশি সর্ব্বত্র প্রচারিত হইয়াছিল। ভরদ্বাজতনয় যবক্রীত তপস্বী পিতার অসম্মান এবং সুপণ্ডিত রৈভ্য ও তাঁহার সন্তানদিগের সৎকারসন্দর্শনে যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ ও একান্ত সন্তার্পিত হইয়া বেদজ্ঞানের নিমিত্ত ঘোরতর তপস্যা করিতে লাগিলেন। মহাতপাঃ যবক্রীত প্রজ্বলিত হুতাশনে শরীর সন্তপ্ত করিয়া দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তাপ জন্মাইলে তিনি তাঁহার নিকট আগমনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে তপোধন! তুমি কি নিমিত্ত এরূপ কঠোর তপস্যা করিতেছ?” যবক্রীত কহিলেন, ‘ত্ৰিদশাধিপ! কেবল জ্ঞানের নিমিত্ত আমার এই উদযোগ; দ্বিজগণের অনধীত বেদ-সকল আমার হৃদয়াকাশে অনায়াসে প্রতিভাত হইবে বলিয়া এই কঠোর তপস্যা করিতেছি। গুরুর নিকট অধ্যয়ন করিয়া বেদজ্ঞ হওয়া বহুকালসাধ্য; অতএব শীঘ্ৰ জ্ঞানলাভ-বাসনায় প্ৰযত্নাতিশয়সহকারে তপোবল আশ্রয় করিয়াছি।”

“ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে বিপ্ৰ! তুমি যে পথের পান্থ হইতে মানস করিয়াছ, উহা উপযুক্ত পথ নহে। আত্মঘাতের প্রয়োজন কি? গুরুর নিকট গমন করিয়া অধ্যয়নে অনুরক্ত হও।” দেবরাজ এই বলিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিতে অমিতবিক্রম যবক্রীত পুনরায় যত্নপূর্ব্বক তপানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। তাঁহার কঠোর তপস্যায় সুরপতি সন্তপ্ত হইয়া পুনর্ব্বার মুনিসন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে নিবারণ করিবার নিমিত্ত কহিলেন, “হে মুনীন্দ্র। এরূপ অসাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হওয়া বুদ্ধির কাৰ্য্য নহে। যাহা হউক, আমি

প্রতিভাত হইবে।” যবক্রীত কহিলেন, “হে দেবেন্দ্র! যদ্যপি আপনি আমার অভীষ্টসিদ্ধি না করেন, তাহা হইলে আমি স্বীয় অঙ্গ-প্রস্যঙ্গ-সকল কর্ত্তন করিয়া প্রজ্বলিত গুতাশনে আগুতি প্রদানপূর্ব্বক অপেক্ষাকৃত ঘোরতর তপস্যা করিব।”

“দেবরাজ মুনিতনয়ের অবিচলিত অধ্যবসায় পরিজ্ঞাত হইয়া নিবারণের উপায় চিন্তা করিয়া যক্ষ্মরোগগ্ৰস্ত শীর্ণকলেবর এক বৰ্ষীয়ান ব্রাহ্মণের রূপ ধারণপূর্ব্বক ভাগীরথীর অন্তর্গত শৌচক্রিয়োচিত যবক্ৰীতের তীর্থে এক বালুকাময় সেতু নির্ম্মাণ করিবার মানসে তথায় গমন করিলেন। যখন দ্বিজোত্তম যবক্ৰীত দেবরাজ-বাক্যের অন্যথাচরণ করিলেন, তখন তিনি বালুকাদ্বারা গঙ্গা পরিপূর্ণ করিবার নিমিত্ত ভাগীরথীতে সিকতমুষ্টি বিক্ষেপপূর্ব্বক যবক্ৰীতের সমক্ষে সেতু নির্ম্মাণ করিতে আরম্ভ করিলেন।

“মুনিবার তাঁহাকে সেতুবন্ধনে একান্ত যত্নবান দেখিয়া সহাস্যবদনে কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! এ কি হইতেছে? আপনি কি করিতে বাসনা করিতেছেন? নিরর্থক কেন ঈদৃশ প্রয়াস পাইতেছেন?” ইন্দ্ৰ কহিলেন, ‘গঙ্গা উত্তীর্ণ হইবার সময়ে লোকের সাতিশয় ক্লেশ হইয়া থাকে, তন্নিমিত্ত এই সেতু নির্ম্মাণ করিতেছি; এই সুগম সেতুপথদ্বারা সকলে অনায়াসে উত্তীর্ণ হইতে পরিবে।”

যবক্ৰীত কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! মহাবেগবান প্রবাহ প্রতিরুদ্ধ করা আপনার সাধ্যাতীত কাৰ্য্য, তাহাতে সন্দেহ নাই; অতএব এই দুর্ব্যবসায় হইতে নিবৃত্ত হইয়া সাধ্য কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করুন।’ ইন্দ্র কহিলেন, “তপোধন! আপনি যেমন বেদশিক্ষার্থী হইয়া অশক্য তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তদ্রূপ আমিও এই দুর্ব্বহ ভার গ্রহণ করিয়াছি। যবক্রীত কহিলেন, “হে ত্ৰিদশেখর! যেমন আপনার এই উদ্যম নিরর্থক, আমারও তপস্যা যদি সেইরূপ বিবেচনা করেন, তবে আপনার যাহা সাধ্য হয় করুন এবং যাহাতে আমি সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইতে পারি, এইরূপ বর প্রদান করুন।” তখন ভগবান ত্ৰিদশনাথ মুনির প্রার্থিত বরদান করিয়া কহিলেন, “হে যবক্ৰীত! তোমাদিগের পিতাপুত্রের সমুদয় বেদ প্রতিভাত হইবে এবং তোমার অন্যান্য অভীষ্টও সিদ্ধ হইবে; এক্ষণে স্বস্থানে প্রস্থান কর।”

তপোগর্ব্বিত পুত্রের প্রতি ভরদ্বাজের উপদেশ

“অনন্তর যবক্ৰীত পূৰ্ণমনোরথ হইয়া পিতৃসন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, “তাত! দেবরাজদত্ত বরপ্রভাবে আমাদিগের উভয়েরই সমুদয় বেদ প্রতিভাত হইবে এবং আমরা সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইব।” ভরদ্বাজ কহিলেন, “বৎস! আমার বোধ হইতেছে, তুমি অভিলষিত বরলাভে সাতিশয় দর্পিত হইয়া অচিরাৎ বিনষ্ট হইবে। দেবতারা এই বিষয়ের এক উদাহরণ কীর্ত্তন করিয়াছেন, শ্রবণ কর।

“পুর্ব্বে বালধিনামে মহাতেজঃ এক ঋষি ছিলেন। তিনি পুত্ৰশোকে নিতান্ত কাতর ও একান্ত উদ্বিগ্ন হইয়া অমর-পুত্রকামনায় দুষ্কর তপস্যা করিয়া লব্ধকাম হইলেন। দেবতারা প্ৰসন্ন হইয়া তাঁহাকে অভিলষিত বরদানপূর্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! তুমি সর্বাংশেই অমর-সদৃশ পুত্র লাভ করিবে; কিন্তু মর্ত্যলোকে অমর নাই, সুতরাং সেই পুত্রের জীবন কোন নিমিত্তাধীন হইবে।” বালধি কহিলেন, “হে দেববৃন্দা! এই পরিদৃশ্যমান অবিনশ্বর ভূধর সকল আমার পুত্রের জীবিতনিমিত্ত হইবে।” দেবতারা “তথাস্তু’ বলিয়া স্বস্থানে প্ৰস্থান করিলেন।

অনন্তর মহর্ষি বালধির মেধাবী নামে অতি প্ৰচণ্ডস্বভাব এক পুত্র জন্মিল। মেধাবী আত্মবৃত্তান্ত সমস্ত অবগত হইয়া গর্ব্বপ্রকাশপূর্ব্বক অন্যান্য ঋষিগণের অবমাননা করিতে লাগিলেন। এইরূপে পৃথিবী পৰ্যটনপূর্ব্বক একদা মহাতেজাঃ ধনুষাক্ষ ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হইয়া তাঁহার অপকার করিবামাত্ৰ তিনি তাঁহাকে “ভস্ম হও” বলিয়া অভিসম্পাত করিলেন; কিন্তু মেধাবী দেবদত্ত-বীরপ্রভাবে ভস্মীভূত হইলেন না। তদ্দর্শনে মহর্ষি ধনুষাক্ষ রোষপরবশ হইয়া কতিপয় বিশালবিষাণ মহিষদ্বারা মেধাবীর জীবন নিমিত্ত পর্ব্বত-সকল বিদারণ করিলেন। নিমিত্ত বিনষ্ট হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ তাঁহার মৃত্যু হইল। তখন বালধি পুত্রের মৃতদেহ ক্রোড়ে লইয়া নানাপ্রকার বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। বেদজ্ঞ দীর্ঘদর্শী ঋষিগণ তদীয় বিলাপশ্রবণে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া যে গাথা কীর্ত্তনপূর্ব্বক শোকসন্তপ্ত বালধিকে সান্ত্বনা করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করা। “মিনুষ্য কদাপি দৈবকাৰ্য্য অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় না। এই নিমিত্ত মহর্ষি ধনুষাক্ষ মহিষদ্বারা মহীধর বিদারিত করিয়াছে।”

‘পুত্র! অল্পবয়স্ক তপস্বিতনয়েরা এইরূপ বরলাভে দর্পিত হইয়া যেমন শীঘ্ৰ বিনষ্ট হয়, তুমিও যেন সেইরূপ হইও না। মহর্ষি রৈভ্য মহাপ্রভাবসম্পন্ন, তাহার পুত্রদ্বয়ও তাদৃশ কোপনস্বভাব। মহর্ষি রৈভ্য রোষপরবশ হইলে যৎপরোনাস্তি পীড়া প্ৰদান করিতে পারেন, অতএব যাহাতে তোমার কোন অনিষ্টপাত না হয়, সর্ব্বদা অপ্ৰমত্ত হইয়া তদনুরূপ কাৰ্য্য করিবে।”

“যবক্ৰীত কহিলেন, “তাত! যাহা আদেশ করিলেন, আমি তাহাই করিব, আপনি উদ্বিগ্ন হইবেন না। যেমন আপনি আমার পিতা, রৈভাও সেইরূপ।” যবক্রীত পিতাকে এইরূপ মধুরবাক্য বলিয়া আহ্লাদপূর্ব্বক অকুতোভয়ে অন্যান্য ঋষিগণের অপকার করিতে আরম্ভ করিলেন।