১৪৬. দ্রৌপদীসন্নিধানে সহসা কনক-কমল পতন

১৪৬তম অধ্যায়

দ্রৌপদীসন্নিধানে সহসা কনক-কমল পতন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! সেই পুরুষপ্রধান পাণ্ডবগণ ধনঞ্জয়-দর্শনাভিনাষে পরমপরিশুদ্ধচিত্তে সেই স্থানে ছয় রাত্রি বাস করিলেন। একদা এক সূৰ্য্যসন্নিভ সহস্রদলপদ্ম সমীরণবেগসহকারে অকস্মাৎ ঈশানকোণ হইতে আসিয়া দ্রৌপদীর নিকট নিপতিত হইল। দ্রুপদনন্দিনী সেই পবনাহৃত পরিমলপরিপূর্ণ পরমরমণীয় সৌগন্ধিক গ্রহণ করিয়া অতীব হষ্টচিত্তে ভীমসেনকে কহিলেন, “হে ভীমসেন! এই দেখ কেমন উৎকৃষ্ট সৌগন্ধিক পুষ্প। ইহা প্রাপ্ত হইয়া আমার মন পরমহ্লাদিত হইয়াছে; আমি এই পুষ্পটি ধর্ম্মরাজকে প্রদান করিব। হে বৃকোদর! যদি আমার প্রতি তোমার প্রণয়দৃষ্টি থাকে, তবে প্রচুর পরিমাণে এতজ্জাতীয় পুষ্প আহরণ কর, আমি তৎসমুদয় কাম্যক-বনে লইয়া যাইব৷” মত্তচকোরনেত্ৰা পাঞ্চালী ভীমসেনকে এই কথা বলিয়া সেই সৌগন্ধিক গ্রহণপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিলেন।

মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন প্ৰণয়িনীর অভিপ্ৰায় বুঝিয়া তাঁহার প্রিয়ানুষ্ঠান-বাসনায় সৌগন্ধিকসমুদয় আনয়ন করিবার নিমিত্ত সুবৰ্ণপৃষ্ঠ শরাসন ও আশীবিষসদৃশ শরসমূহ গ্রহণপূর্ব্বক বায়ুর অভিমুখে ক্রুদ্ধমৃগরাজের ন্যায়, মদস্রাবী মাতঙ্গের ন্যায় অনবরত ঈশানকোণে গমন করিতে লাগিলেন। তত্ৰস্থ সমস্ত প্রাণিগণ সেই ধনুর্ব্বাণধারী বৃকোদরকে অবলোকন করিতে লাগিল। গমনসময়ে কি গ্লানি, কি বৈক্লব্য, কি ভয়, কি সম্ভ্রম কিছুতেই তাঁহাকে অভিভূত করিতে সমর্থ হইল না। বাহুবলপ্ৰদীপ্ত ভীমসেন দ্ৰৌপদীর প্রিয়ানুষ্ঠানবাসনায় ভয়সম্মোহ পরিত্যাগপূর্ব্বক লতাগুল্মসমাচ্ছন্ন, নীলশিলাযুক্ত, কিন্নর-কুলচরিত, নানাবর্ণধার, বিচিত্র ধাতু ও দ্রুম, মৃগ ও অণ্ডজ-সমুদয়ে ব্যাপ্ত, নানাভরণভূষিত, ভূমির ভূজদণ্ডের ন্যায় সন্নিবেশিত গন্ধমাদনপর্ব্বতে আরোহণপূর্ব্বক পুংস্কোকিল-নিনাদে নিনাদিত ষট্‌পদকুলাসেবিত পরমরমণীয় সানু-সমুদায় নিরীক্ষণ, মনে মনে অভিপ্ৰায়সকল অনুচিন্তন ও সর্ব্বপ্রকার কুসুমের সৌরভ আঘ্রাণ করিতে করিতে মত্ত-মাতঙ্গের ন্যায় গমন করিতে লাগিলেন। গমনকালে পরমপবিত্র বিবিধ কুসুমগন্ধযুক্ত শীতসংস্পৰ্শ মন্দ মন্দ গন্ধমাদনবায়ু তাঁহাকে বীজন করিতে লাগিল।

কনকপদ্মানুসরণে ভীমের ভ্ৰমণ

পবননন্দন স্বীয় পিতার সংস্পর্শে পরম পুলকিত ও বিগতক্লম হইয়া পুষ্পের নিমিত্ত যক্ষ, গন্ধর্ব্ব, অমর ও ব্রহ্মর্ষিগণনিষেবিত ঐ পর্ব্বত অবলোকন করিতে লাগিলেন। ঐ পর্ব্বতে পীত, কৃষ্ণ ও শুভ্রবর্ণ বিমল ধাতুবিচ্ছেদ-সকল ত্রিপুন্ড্রকাকারে [দ্বিজাতিদিগের ললাটস্থ ত্ৰিভাগবিভক্ত মৃত্তিকাদির তিলক] অনুলিপ্ত রহিয়াছে, উহার পার্শ্বদেশে জলদপুঞ্জ লগ্ন হওয়াতে বোধ হয় যেন, পক্ষ বিস্তার করিয়া নৃত্য করিতেছে, প্রস্রবণ-বারি নিপতিত হওয়াতে বোধ হয় যেন, চতুর্দ্দিক মুক্তাহারে ব্যাপ্ত রহিয়াছে; চতুর্দ্দিকে মনোহর দরী [গুহা], কুঞ্জ, নির্ব্বর ও কন্দর-সমুদয় শোভা পাইতেছে, অপ্সরাগণের নুপূরধ্বনি শ্রবণে মত্ত ময়ূরকুল নৃত্য করিতেছে; দিগ্‌গজগণ বিষাণাগ্রদ্বারা শিলাতল খনন করিতেছে এবং অনবরত নদীজল নিপতিত হওয়াতে বোধ হয় যেন, বসনসকল স্রস্ত হইতেছে।

মত্তবারণবিক্রান্ত কনকবৰ্ণ শ্ৰীমান বায়ুতনয় এইরূপে নিরীক্ষণ করিতে করিতে প্রিয়ার প্রিয়ানুষ্ঠান নিমিত্ত পরম প্ৰহৃষ্টচিত্তে গমনবেগে লতাজাল বিচলিত করিয়া পরমরমণীয় গন্ধমাদনসানুতে বিচরণ করিতে লাগিলেন। অদূরসংস্থিত ভয়ানভিজ্ঞ হরিণগণ শষ্পকবল [কচি ঘাসের গুচ্ছ] মুখে করিয়া কৌতুহলান্বিতচিত্তে একদৃষ্টি তাঁহাকে অবলোকন করিতে লাগিল। প্ৰিয়পার্শ্বোপবিষ্ট গন্ধর্ব্বঘোষিদ্‌গণ অদৃশ্য হইয়া রূপের নবাবতার সেই বৃকোদরকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। ভীমপরাক্রম ভীমসেন বনবাসিনী দ্ৰৌপদীর দুৰ্য্যোধনজনিত বিবিধ ক্লেশ স্মরণ করিয়াই তাঁহার প্রিয়ানুষ্ঠানে সমুদ্যত হইয়াছিলেন। তিনি মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, “অর্জ্জুন স্বর্গে গমন করিয়াছে, আমিও পুষ্পের নিমিত্ত এ স্থানে আগমন করিয়াছি, এক্ষণে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির আমাদের দুইজনের বিরহে না জানি কি করিবেন। তিনি নকুল ও সহদেবকে সাতিশয় স্নেহ করিয়া থাকেন; বিশেষতঃ তাহাদের বলবিক্রমে তাঁহার কিছুমাত্র বিশ্বাস নাই, তন্নিমিত্ত তিনি কখনই তাহাদিগকে কুত্ৰাপি প্রেরণ করিবেন না। যাহা হউক, এক্ষণে কিরূপে ত্বরায় কুসুম প্রাপ্ত হই?”

মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া প্ৰফুল্ল গিরিসানুতে দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলেন। তৎকালে দ্রৌপদীর বাক্যই কেবল তাঁহার পাথেয় হইয়াছিল, পর্ব্বতস্থ গজযূথ পবনগামী ভীমসেনের ভীষণমূর্ত্তি সন্দর্শন করিয়া ভীত হইতে লাগিল। তিনি নিৰ্ঘাত [বজ্র] পাতসদৃশ চরণপাতে মেদিনীমণ্ডল কম্পান্বিত করিয়া সিংহ, ব্যাঘ্র ও মৃগগণকে মর্দ্দন করিতে লাগিলেন, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তরুসমূহ উন্মূলিত ও নিখাত করিয়া ফেলিলেন এবং বেগে লতাজাল আকর্ষণপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। তৎকালে তিনি উপর্য্যুপরি শৈলশিখরে আরোহণেচ্ছু গজরাজের ন্যায় শোভমান হইলেন এবং ক্ষণে ক্ষণে সবিদ্যুৎ জলধরের ন্যায় গভীর গর্জ্জন করিতে লাগিলেন। ভীমপরাক্রম ভীমসেনের গভীর-গর্জ্জনে প্রতিবোধিত ব্যাঘ্রগণ গুহা পরিত্যাগ করিল, বনবাসিগণ লুক্কায়িত হইতে লাগিল, পক্ষিগণ ত্ৰস্ত হইয়া উৎপতিত হইতে লাগিল, মৃগযূথ পলায়নপরায়ণ হইল, ভলুকগণ বৃক্ষ পরিত্যাগ করিল, সিংহসমুদয় গুহা ত্যাগ করিয়া প্রস্থান করিতে লাগিল, হস্তিগণ সাতিশয় বিত্ৰাসিত হইয়া করেণুগণ-সমভিব্যাহারে সেই বন পরিত্যাগপূর্ব্বক বানান্তরে প্রস্থান করিল। বরাহ, মৃগ, সিংহ, মহিষ, ব্যাঘ্ৰ, গোমায়ু, গবয় প্রভৃতি বনচরগণ চীৎকার করিতে লাগিল; চক্ৰবাক, দাত্যূহ, হংস, কারণ্ডব, শুক, পুংস্কোকিল ও ক্ৰৌঞ্চগণ বিচেতনপ্রায় হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল এবং অন্যান্য ভীষণাকার জন্তুসমুদয় ভয়বিভ্রান্তচিত্তে শকৃম্মূত্ৰ [বিষ্ঠা-মূত্র] পরিত্যাগপূর্ব্বক মুখবাদান করিয়া ভয়ঙ্কর রব করিতে লাগিল।

অনেকগনেক কারিগণ করেণুগণের উত্তেজনাপরতন্ত্র হইয়া এবং সিংহ ও ব্যাঘ্রগণ সাতিশয় সংক্রুদ্ধ হইয়া ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইল। তখন তিনি ক্ৰোধপরায়ণ হইয়া অনেকানেক গজকে গজের আঘাতে, সিংহগণকে সিংহের আঘাতে ও অন্যান্য পশুদিগকে চপেটাঘাতে বিনাশ করিতে লাগিলেন। এইরূপে সিংহ, ব্যাঘ্র, তরক্ষু [নেকড়ে বাঘ] প্রভৃতি বহুতর জন্তুগণ ভীমসেনের ভীষণ আঘাতে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল; হতাবশিষ্ট পশুগণ প্রাণভয়ে শকৃম্মূত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদার তাহাদিগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক সিংহনাদে চতুর্দ্দিক মুখরিত করিয়া বনে প্রবেশ করিলেন।

তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে গন্ধমাদনসানুতে এক বহুযোজন-বিস্তৃত সুরম্য কদলীবন দেখিতে পাইলেন। মারুতবেগগামী মারুততনয় মদস্রাবী গজের ন্যায় বিবিধ বৃক্ষ ভগ্ন করিয়া সেই বনে গমন করিলেন। তিনি বৃহৎ বৃহৎ তালবৃক্ষের ন্যায় সমুন্নত কদলীস্তম্বসমুদয় উৎপাটনপূর্ব্বক বেগে চতুর্দ্দিকে নিক্ষেপপূর্ব্বক দর্পিত নৃসিংহের ন্যায় শব্দ করিতে লাগিলেন। রুরু, বানর, সিংহ, মহিষ প্রভৃতি বহুবিধ জন্তুগণ ভীমসেনের শব্দ-শ্রবণে বিত্ৰস্ত হইয়া জলাশয়ে গমন করিতে লাগিল। জন্তুগণের শব্দ ও ভীমসেনের গভীরধ্বনি-শ্রবণে বনান্তরগত মৃগপক্ষিগণও বিত্ৰাসিত হইয়া উঠিল। সহস্ৰ সহস্ৰ জলচর পক্ষিগণ মৃগবিহঙ্গমকুলের ধ্বনি শ্রবণ করিয়া সহসা আর্দ্র পক্ষে উৎপতিত হইল।

ভীমসেনের কনকপদ্ম-সরোবরদর্শন

ভরতবংশাবতংস ভীমসেন সেই সমুদয় জলচর পক্ষিগণকে সন্দর্শন করিয়া তাহাদিগের অনুসরণক্ৰমে ক্ৰমে ক্রমে এক সুমহৎরম্য সরোবর নিরীক্ষণ করিলেন। ঐ সরোবর মন্দমারুতকম্পিত কাঞ্চনময় কদলীবৃক্ষদ্বারা সতত বীজ্যমান হইতেছে। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন সেই প্রভূতপদ্ম-পরিপূর্ণ সরোবরে অবতীর্ণ হইয়া উদ্দাম মহাগজের ন্যায় যথেচ্ছ ক্রীড়া করিতে লাগিলেন। বহুক্ষণের পর জলক্রীড়া সমাপনপূর্ব্বক সরোবর হইতে সমুত্থিত হইয়া বেগে সেই বহু পাদপসঙ্কীর্ণ অরণ্যমধ্যে প্ৰবেশ করিলেন। তথায় মহাবেগে শঙ্খনাদ ও বাহু আস্ফোটনদ্বারা দশদিক প্রতিধ্বনি করিতে লাগিলেন। সেই শঙ্খধ্বনি ও ভীমসেনের গভীর গর্জ্জনে গুহা হইতে ঘোরতর প্রতিশব্দ সমুত্থিত হইল, শৈলগুহামধ্যে সুষুপ্ত সিংহগণ সেই বজ্রনির্ঘোষসদৃশ আস্ফোট-শব্দ শ্রবণ করিয়া ভয়ানক ধ্বনি করিতে লাগিল। কুঞ্জরগণ সিংহনাদ-শ্রবণে সাতিশয় সন্ত্রস্ত হইয়া ঘোরতর চীৎকার আরম্ভ করিল এবং করিকুলের ভীষণ-শব্দে সমুদয় পর্ব্বত পরিপূর্ণ হইল।

হনূমানের সহিত ভীমসেনের সাক্ষাৎকার

কপিকুলগ্রগণ্য হনূমান ঐ কদলীবনে বাস করিতেন; তিনি সেই কুঞ্জারকুলানির্মুক্ত সুমহৎ নিনাদ-শ্রবণে প্রতিবোধিত হইয়া স্বীয় ভ্ৰাতা ভীমসেনের আগমনবার্ত্তা জানিতে পারিলেন। ঐ কদলীবনে এক অতিসঙ্কীর্ণ স্বৰ্গগমনের পথ ছিল। পবননন্দন হনূমান পাছে স্বীয় ভ্রাতা বৃকোদর ঐ পথে গিয়া শাপগ্ৰস্ত বা পরাভবপ্রাপ্ত হয়েন, এই ভাবিয়া সেই স্বৰ্গমার্গ অবরোধ করিয়া শয়ান হইয়া নিদ্রিতপ্রায় রহিলেন; ক্ষণে ক্ষণে জৃম্ভণ ও শত্রুধ্বজের ন্যায় সমুচ্ছ্রিত লাঙ্গুলের অস্ফোটন করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত হনূমানের অশনিনির্ঘোষসদৃশ লাঙ্গুলাস্ফোটনশব্দে পর্ব্বত প্রচলিত হইল; গুহাসমুদয় প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। এবং শৃঙ্গসকল বিঘূর্ণিত হইয়া চতুর্দ্দিকে-নিপতিত হইতে লাগিল। সেই লাঙ্গুলাস্ফোটনশব্দ মত্ত বাণরগণের ঘোরতর নিস্বন অন্তর্হিত করিয়া সমুদয় গিরিসানুমধ্যে 
বিচরণ করিতে লাগিল ।
 

ভীমপরাক্রম ভীমসেন সেই শব্দ-শ্রবণে লোমাঞ্চিতকলেবর হইয়া উহার কারণ অবগত হইবার মানসে সেই কদলীবনের চতুর্দ্দিকে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তথায় এক সুবিস্তৃত শিলাতলে শয়ান, বিদ্যুৎসম্পাতের ন্যায় চঞ্চল, দুষ্প্রেক্ষ্য [দুর্নিরীক্ষ্য—যাহা সহজে দেখিতে পারা যায় না] ও পিঙ্গলবৰ্ণ বানরাধিপতি হনূমানকে নিরীক্ষণ করিলেন। তাঁহার গ্ৰীবা পীন ও হ্রস্ব; স্কন্ধদ্বয় সাতিশয় বিপুল; মধ্যদেশ অতিক্ষীণ; লাঙ্গুল ঈষদাভূগ্মাগ্ৰ, দীর্ঘলোমে আকীর্ণ ও ধ্বজের ন্যায় উচ্ছ্রিত, ওষ্ঠ হ্রস্ব, জিহ্বা তাম্রবর্ণ, ভ্রূ চঞ্চল, কলেবর রক্তবর্ণ, দৰ্শন-সমুদয় বিবৃত্ত, শুক্ল ও তীক্ষাগ্ৰবদন রশ্মিমান চন্দ্রের ন্যায়; উহার অভ্যন্তরে শুক্ল দন্ত-সমুদয় সন্নিবেশিত থাকতে বোধ হয় যেন, কেশরোৎকরসংমিশ্র [কেশর ও কলিকাযুক্ত] অশোক-সমুদয় সংস্থাপিত রহিয়াছে।

মহাবল-পরাক্রান্ত ভীমসেন সেই কদলীবনমধ্যস্থ, শিখাবান্‌ বানররাজ হিমাচলের ন্যায় স্বৰ্গমার্গ অবরোধ করিয়া রহিয়াছেন দেখিয়া নিৰ্ভয়চিত্তে বেগে গমনপূর্ব্বক বজনির্ঘোষসদৃশ সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তত্রস্থ যাবতীয় মৃগ-পক্ষিগণ ভীমের ভীষণ ধ্বনি-শ্রবণে সাতিশয় বিত্ৰস্ত হইল। মহাবল-পরাক্রান্ত হনূমান তৎশ্রবণে লোচনদ্বয় ঈষদুন্মীলন করিয়া অবজ্ঞাপূর্ব্বক ভীমসেনের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক সহাস্য-বদনে তাহাকে কহিতে লাগিলেন, “আমি পীড়িত, এই স্থানে সুখে নিদ্রা যাইতেছিলাম; তুমি কি নিমিত্ত আমাকে জাগরিত করিলে? তুমি জ্ঞানবান, তন্নিমিত্ত প্রাণীগণের প্রতি দয়া করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। আমরা তিৰ্য্যগ্‌যোনিসম্ভূত, ধর্ম্মের বিষয় কিছুমাত্র অবগত নহি, মনুষ্যগণ ধীশক্তি-সম্পন্ন, তাঁহারা জন্তুগণের প্রতি দয়া করিয়া থাকেন। তোমার ন্যায় বুদ্ধিমান ব্যক্তিদিগের দেহ, বাক্য ও চিত্তের দোষজনক ধর্ম্মঘাতী কর্ম্মে প্রবৃত্ত হওয়া নিতান্ত অন্যায়। বোধ হয়, তুমি ধর্ম্মভিজ্ঞ নহ। অথবা পণ্ডিতগণের সেবা কর নাই, এই নিমিত্ত অল্পবুদ্ধিত্বপ্রযুক্ত পশুগণকে পীড়া প্রদান করিতেছ। তুমি কে? কি নিমিত্ত এই মানুষভাবিবর্জ্জিত নির্জ্জন অরণ্যে আগমন করিয়াছ? কোথায় বা গমন করিবে? এই উদ্যানের পরেই ঐ অগম্য পর্ব্বত রহিয়াছে, সিদ্ধিলাভ ব্যতীত উহাতে গমন করা অসাধ্য। উহা দেবমাৰ্গ, মনুষ্যলোক উহাতে কোনক্রমেই গমন করিতে সমর্থ হয় না। আমি কারুণ্যপরতন্ত্র হইয়া তোমাকে নিষেধ করিতেছি, তুমি নিরস্ত হও; ইহার পর আর গমন করিতে পরিবে না; অদ্য তোমার এই স্থানে থাকাই শ্ৰেয়ঃ। হে মনুজশ্রেষ্ঠ! যদি আমার এই হিতকর বাক্য তোমার গ্রাহ্য হয়, তবে এই সমুদয় সুধাসোদর [মিষ্টমধু—যাহার অভ্যন্তর মিষ্ট]-ফলমূল ভক্ষণ করিয়া এস্থান হইতে প্রতিনিবৃত্ত হও; অকারণ মৃত্যু প্রার্থনা করিও না।”