১০৪. সূর্য্যগতিরোধে চিন্ধ্যাচলের কলেবরবৃদ্ধি

১০৪তম অধ্যায়

সূর্য্যগতিরোধে চিন্ধ্যাচলের কলেবরবৃদ্ধি

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন! বিন্ধ্যাচল কি নিমিত্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সহসা এতাদৃশ প্রবৃদ্ধ হইল, তাহা সবিস্তর শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে।”

লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! সূৰ্যদেব প্রত্যহ উদয় ও অস্তগমন-সময়ে অদ্রিরাজ সুমেরুকে প্ৰদক্ষিণ করিতেন; তদর্শনে বিন্ধ্যগিরি ঈর্ষ্যাপরবশ হইয়া সূৰ্য্যকে কহিল, ‘ভাস্কর! তুমি প্রতিদিন যেমন মেরুকে প্ৰদক্ষিণ কর, সেইরূপ আমাকেও প্ৰদক্ষিণ করিতে হইবে।” সহস্ররশ্মি কহিলেন, “হে নগেন্দ্র! আমি স্বেচ্ছাক্রমে সুমেরুকে প্ৰদক্ষিণ করি না; বিশ্বনির্ম্মাতাদিগের আদিষ্টপথে পরিভ্রমণ করিতেছি।’ ভূধর দিনকরবাক্যে অমর্ষপূৰ্ণ হইয়া চন্দ্ৰসূৰ্য্যের গতিরোধ করিবার মানসে সহসা অত্যুন্নত হইয়া উঠিল।

“দেবগণ বিন্ধ্যাচলের উচ্ছ্রায় [উন্নতমস্তকে বৃদ্ধি]-সন্দর্শনে উৎকলিকাকুল [অত্যন্ত উদ্বিগ্ন] হইয়া তৎসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক নানা উপায়দ্বারা তাহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন, কিন্তু অদ্রিরাজ কিছুতেই তাঁহাদিগের অনুরোধ শ্রবণ করিল না। তখন দেবগণ অগস্ত্যাশ্রমে উপনীত হইয়া মহর্ষির নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত কীর্ত্তন করিলেন।

‘হে দ্বিজোত্তম! অদ্য বিন্ধ্যাচল রোষপরবশ হইয়া চন্দ্ৰ-সূৰ্য্য ও নক্ষত্ৰগণের গতিরোধ করিয়াছে, এক্ষণে আপনা ব্যতীত কেহই তাহাকে নিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইবে না; অতএব আপনি তাহাকে নিবারণ করুন।”

অগস্ত্যকর্ত্তৃক বিন্ধ্যগতিরোধ

“মহর্ষি অগস্ত্য সুরগণের অনুরোধে বিন্ধ্যাচলসন্নিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, “হে ভূধরবর! কোন বিশেষ কাৰ্য্যাতিপাতবশতঃ আমি দক্ষিণদিকে গমন করিব, অতএব তুমি আমাকে এক্ষণে পথ প্ৰদান কর; কিন্তু আমার প্রত্যাগমনপ্রতীক্ষায় কালক্ষেপ করিতে হইবে। অনন্তর আমি প্রতিনিবৃত্ত হইলে তুমি স্বেচ্ছাক্রমে বৰ্দ্ধিত হইতে পরিবে।” মহামুনি অগস্ত্য বিন্ধ্যগিরিকে এইরূপে নিয়মবদ্ধ করিয়া দক্ষিণাভিমুখে প্ৰস্থান করিলেন; অদ্যাপি প্রত্যাগত হয়েন নাই, সুতরাং অচলপতিকেও তদাবস্থায় অবস্থিতি করিতে হইল। হে মহারাজ! যে নিমিত্ত বিন্ধ্যাচল অত্যুন্নত ও গ্রহনক্ষত্রের মাৰ্গবিরোধক হইতে সমর্থ হইল না, তাহা আনুপূর্ব্বিক কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে কিরূপে দেবগণ কালকেয়গণকে নিহত করিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করুন।

“ভগবান মৈত্রাবারুণি দেবগণের স্তুতিবাদ শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে সুরগণ! আপনারা কি নিমিত্ত এ স্থানে আগমন করিয়াছেন এবং কিরূপ বর প্রার্থনা করেন, আদেশ করুন।” দেবতারা কহিলেন, “মহাত্মন! আমাদিগের অভিলাষ যে, আপনি মহার্ণবের সমুদয় সলিল পান করেন; তাহা হইলে আমরা কালকেয় সুরারিদিগকে সবংশে নিহত করিতে সমর্থ হই।” মহর্ষি তাঁহাদিগের প্রার্থনা-পূরণে অঙ্গীকার করিয়া কহিলেন, ‘যে বিষয় আপনাদিগের অভিলষিত এবং জগতের হিতকর ও সুখপ্রদ তাহা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য।’ অনন্তর তিনি তপঃসিদ্ধ ঋষিবৃন্দ ও সমাগত দেবগণসমভিব্যাহারে জলধিতীরে গমন করিলেন। মনুষ্য, উরগ, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ ও কিম্পপুরুষেরা সেই অদ্ভুত ব্যাপার সন্দর্শনার্থ কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া অগস্ত্যের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। তাঁহারা ক্ৰমে ক্রমে বিবিধ যাদোগণসঙ্কুল, বহুবিধমীনসমাকীর্ণ গভীর নিঃস্বন, অগাধ জলধিতীরে উপনীত হইলেন। তরঙ্গমালা বাতাভিঘাতে বিভিন্ন ও বারংবার উন্নতানত হওয়াতে বোধ হইল, যেন সরিৎপতি। নৃত্য করিতেছে এবং সলিলরাশি কন্দরোদরে স্থলিত ও ফেনিল হওয়াতে বোধ হইল, যেন সমুদ্র হাস্য করিতেছে।”