১২০. দুর্য্যোধনের বিরুদ্ধে সাত্যকির সাতিশয় রোষপ্রকাশ

১২০তম অধ্যায়

দুর্য্যোধনের বিরুদ্ধে সাত্যকির সাতিশয় রোষপ্রকাশ

সাত্যকি কহিলেন, “হে রাম! এক্ষণে পরিতাপের সময় নয়। রাজা যুধিষ্ঠির এ বিষয়ে কিছুমাত্র বাঙনিম্পত্তি না করিলেও আমরা অবিলম্বেই ইহার সমুচিত প্রতিকার করিব! মেদিনীমণ্ডলে সহায়সম্পন্ন ব্যক্তিরা স্বয়ং কোন কর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন না; যেমন শৈব্য প্রভৃতি বীরপুরুষেরা রাজা যযাতির সহায়তা করিয়াছিলেন, তদ্রূপ কাৰ্য্যকাল উপস্থিত হইলে লোকে তাহাদিগের সাহায্য করিয়া থাকে। যাঁহারা অনুমতি করিলে শতশত লোক কার্য্যকরিতে প্ৰবৃত্ত হয়, তাহারাই সনাথ, তাঁহাদিগকে অনাথের ন্যায় আর কষ্টভোগ করিতে হয় না। তবে আমি, বলদেব, কৃষ্ণ এবং প্ৰদ্যুম্ন, এই সকল ত্ৰৈলোক্যনাথ যাঁহাদিগের সহায়, সেই পাণ্ডবেরা অনাথের ন্যায় কি নিমিত্ত অরণ্যে বাস করিতেছেন?

“অদ্য যাদবসেনা নানা অস্ত্ৰ-শস্ত্র ধারণ ও বর্ম্ম পরিধান করিয়া যুদ্ধযাত্রা করুক, সবান্ধব ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা যাদববলাভিভূত হইয়া অবশ্যই শমন-সদনে গমন করিবে। বাসুদেবসদৃশ পার্থ ও আমার সখা ও গুরুর স্বরূপ, তাঁহাকে এক্ষণে আহ্বান করিবার আবশ্যকতা নাই। তিনি তপানুষ্ঠান করুন। ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্ৰ যেমন বৃত্ৰাসুরকে সংহার করিয়াছিলেন, তুমিও সেইরূপ শত্রুরাজ্য আক্রমণপূর্ব্বক সানুচর ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে বিনাশ কর। লোকে শত্রু-বিনাশের নিমিত্ত সুপুত্র ও গুরু-নিয়ত-বশংবদ শিষ্য কামনা করেন, শত্রু-বিনাশের নিমিত্তিই সকলে অতি দুরূহ 
কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়। আমি আশীবিষ-বিষাগ্নিসদৃশ নিশিত শস্ত্রসঙঘাতদ্বারা শত্রুর শরবর্ষণ নি
র্য্যাকরণপূর্ব্বক তাহার শিরশ্ছেদন করিব। অনন্তর শাণিত খড়্গাঘাতে সানুচর দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি সমস্ত কৌরবকুল নিমূল করিব।

“যুগাবসানে প্ৰলয়-হুতাশন যেমন সংসারকে ভস্মসাৎ করে, আমি কৌরব যোদ্ধৃবর্গকে সেইরূপ ভস্মীভূত করিব, তখন মহাবীরেরা আমাকে নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় হৃষ্টচিত্ত ও পুলকিত হইবে। কৃপ, দ্রোণ, বিকর্ণও কর্ণ ইহারা কখনই প্ৰদ্যুম্নবিনিমুক্ত শাণিত শর সহ্য করিতে সমর্থ হইবেন না; আমি অর্জ্জুনসূত অভিমন্যুর বলবীৰ্য্য-সমুদয় ও প্ৰদ্যুম্নের পরাক্রম অবগত আছি। শাম্বও সসূত দুঃশাসনকে বাহুদ্বারা বলপূর্ব্বক পীড়িত ও উত্তমরূপ শাস্তি প্ৰদান করিবে। রণমদমত্ত জাম্ববতীপুত্রের বল নিতান্ত অসহ্য; এই বালক শম্বরাসুরের সৈন্য-সমুদয় সংহার করিয়াছিল; এই বালক রণক্ষেত্রে মহাবীর অশ্বচক্রের প্ৰাণবিনাশ করিয়াছে। কাহার সাধ্য এই মহারথ শাম্বের সমক্ষে রণক্ষেত্রে রথ আনয়ন করে? যেমন কৃতান্তের ক্রোড়ে প্রবেশ করিয়া মানবগণ নিষ্ক্রান্ত হইতে পারে না, সেইরূপ সমরসাগরে মহাবীর শাম্বের সম্মুখীন হইয়া কেহই জীবিত থাকিতে বা প্রত্যাগত হইতে পারে না; বাসুদেব দ্রোণ, ভীষ্ম, সসন্তান সোমদত্ত ও সমস্ত সৈন্যগণকে বাণবহ্নি দ্বারা দগ্ধ করিবেন। এই ত্ৰৈলোক্যমধ্যে গৃহীতায়ুধ চক্ৰধর অপ্রমিততেজাঃ কৃষ্ণের অসাধ্য কি আছে? মহাবীর অনিরুদ্ধ হতোত্তমাঙ্গ চেতনশূন্য ধার্ত্তরাষ্ট্রগণদ্বারা এই সুবিস্তীর্ণ পৃথিবীকে আস্তীর্ণ করিবে। গদ, উন্মুক, বাহুক, ভানুনীথ, কুমার, নিশঠ, রণোৎকট সারণ, চারুদেষ্ণ ইহাঁরা কুলোচিত কর্ম্মসকল সম্পাদন করুন। সাত্বত ও শূরসেন যোদ্ধৃপ্রধান বৃষ্ণি, ভোজ ও অন্ধকগণের সহিত সমবেত হইয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে রণস্থলে সংহারপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে যশোরাশি বিস্তীর্ণ করুন। ধর্ম্মপরায়ণ রাজা যুধিষ্ঠির যতদিন পৰ্য্যন্ত দূতকৃত প্রতিজ্ঞাসাগর উত্তীর্ণ হইতে না পারেন, তাবৎ অভিমন্যু এই পৃথিবী শাসন করুন। অস্মৎপ্রযুক্ত বিশিখদ্বারা হতশত্রু মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণশূন্য সূতপুত্রবিহীন রাজ্যের উপভোগী করাই আমাদিগের নিতান্ত কর্ত্তব্য ও যশস্য।”

বাসুদেব কহিলেন, “হে মহাভাগ! আপনি যেসকল বাক্য কহিলেন, তাহা সমুদয় সত্য; উহাতে অণুমাত্ৰও সন্দেহ নাই; কিন্তু ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অন্যের জয়লব্ধা পৃথিবীকে কদাচ গ্ৰহণ করিবেন না। মহারাজ যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব বা দ্রৌপদী ইঁহারা কাম, ভয় বা লোভদ্বশংবদ হইয়া কদাচ স্বধর্ম্মপরিচুত্যুত হইবেন না। কিন্তু যখন পাঞ্চালপতি, কেকয়, চেদিপতি ও আমরা সকলে সমবেত হইয়া বিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক যুদ্ধ করিব, তখন অবশ্যই সমুদয় শত্রু বিনষ্ট হইবে। তবে অপ্রতিম-যোদ্ধা বৃকোদর, ধনঞ্জয় ও মাদ্রীসূত ইহারা কি নিমিত্ত ধরা শাসন করিতে বাসনা করিতেছেন না?”

যুধিষ্ঠিরের যুদ্ধে উপেক্ষা—সত্যপালনে দৃঢ়তা

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ভ্ৰাতঃ! তুমি যে-সকল কথা কহিলে, উহা নিতান্ত বিচিত্র নহে; কিন্তু আমি কেবল সত্যই প্ৰতিপালন করিব; রাজ্যরক্ষায় আমার তাদৃশ অভিলাষ নাই; কৃষ্ণ আমাকে সবিশেষ অবগত আছেন; আমিও তাঁহাকে সম্যক বিদিত আছি। যৎকালে তিনি বিক্রমপ্রকাশের যথার্থ অবসর নির্দেশ করিবেন, তখন তুমি ও কেশব সুযোধনকে যুদ্ধে পরাজিত করিবে। হে যাদববীরগণ! তোমরা এক্ষণে প্ৰতিগমন কর; তোমাদিগের ধর্ম্মে যেন অচলা শ্রদ্ধা থাকে। এক্ষণে সকলের সহিত সাক্ষাৎ হইল; পুনরায় সকলকে একত্র সমবেত ও সুখে কালাতিপাত করিতে অবলোকন করিব।”

অনন্ত যাদবেরা পরস্পর আমন্ত্রণ, বৃদ্ধগণকে অভিবাদন ও শিশুদিগকে আলিঙ্গন করিয়া স্ব স্ব গৃহে প্রতি গমন করিলেন। এদিকে পাণ্ডবেরা তীৰ্থপৰ্যটনে বিনিৰ্গত হইলেন। পরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ ও লোমশের সহিত বিদর্ভরাজপরিবর্দ্ধিত অতি পবিত্ৰ তীৰ্থ সোমরসমিশ্রিত-জলশালিনী পয়োষ্ণী নদীতে গমনপূর্ব্বক হৃষ্টচিত্ত ব্ৰাহ্মণবর্গকর্ত্তৃক সংম্ভূয়মান হইয়া তথায় বাস করিতে লাগিলেন।