১২৬. মান্ধাতার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণন

১২৬তম অধ্যায়

মান্ধাতার জন্মবৃত্তান্ত বর্ণন

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! ত্ৰিলোক-বিশ্রুত নৃপসত্তম যুবনাশ্বনন্দন মান্ধাতা কিরূপে জন্মগ্রহণ করেন? সেই মহীপাল কিরূপে স্বৰ্গলোকে সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্টগতিলাভ করিলেন ও সেই ভূপতিসত্তম কি নিমিত্তই বা মান্ধাতা নামে বিখ্যাত হইলেন? ইহা শ্রবণ করিতে আমার সাতিশয় বাসনা হইয়াছে; অতএব আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক সেই ধীমান মান্ধাতার চরিত্র-কীর্ত্তন করুন।

লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! মহাত্মা যুবনাশ্বতনয় যে নিমিত্ত লোকমধ্যে মান্ধাতা-নামে বিখ্যাত হইলেন, তদ্বিষয় কীর্ত্তন করিতেছি, সাবধানে শ্রবণ করুন। ইক্ষাকুবংশে যুবনাশ্বনামে এক মহীপতি ছিলেন, তিনি সহস্ৰ অশ্বমেধানুষ্ঠান ও অন্যান্য বহুবিধ ভূরিদক্ষিণ প্রধান প্রধান যজ্ঞ করিয়াছিলেন, তথাপি তিনি সন্তানমুখদর্শনজনিত-সুখসম্ভোগে বঞ্চিত ছিলেন। কিয়দ্দিনানন্তর তিনি স্বীয় অমাত্যহস্তে সমস্ত রাজ্যভার ন্যস্ত করিয়া স্বয়ং শাস্ত্রদৃষ্ট [শাস্ত্ৰবিহিত] বিধির অনুসারে আত্মসংযম করিয়া বনে বাস করিতে লাগিলেন। “তিনি একদা রজনীযোগে উপবাসক্লেশে সাতিশয় ক্লিষ্ট ও পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হইয়া ভৃগুর আশ্রমে প্রবেশ করিলেন। ঐ যামিনীতে মহাত্মা ভৃগুনন্দন মহারাজ যুবনাশ্বের পুত্ৰ-নিমিত্ত এক যজ্ঞ করিয়াছিলেন। যজ্ঞস্থলে মন্ত্রপূত সলিল এক মহৎ কলসে সন্নিবেশিত ছিল। মহর্ষিগণ, রাজমহিষী কলাসস্থ জলপান করিয়া শক্ৰতুল্য পুত্র প্রসব করিলেন, এই স্থির করিয়া যজ্ঞবেদীর উপর ঐ কলস সংস্থাপনপূর্ব্বক অচেতনপ্রায় হইয়া নিদ্রা যাইতেছিলেন। পিপাসা শুষ্ককণ্ঠ নরপতি যুবনাশ্ব রাত্ৰিজাগরণ-শ্ৰান্ত মহর্ষিগণকে অতিক্রমপূর্ব্বক আশ্রমমধ্যে প্রবেশ করিয়া বারংবার পানীয় প্রার্থনা করিলেন, কিন্তু পিপাসায় কণ্ঠ শুষ্ক হওয়াতে তাঁহার স্বর শকুনির স্বরের ন্যায় অবিস্পষ্ট হইয়াছিল, তন্নিমিত্ত তিনি বারংবার উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিলেও কেহ তাঁহার প্রার্থনায় কৰ্ণপাত করিলেন না। তখন তিনি ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে করিতে তত্ৰত্য বেদীসন্নিবেশিত বারিপূর্ণ কলস অবলোকন করিলেন এবং তৎক্ষণাৎ দ্রুতবেগে তথায় গমনপূর্ব্বক সেই কুম্ভমধ্যস্থ সুশীতল জলপান করিয়া পরম পরিতৃপ্ত হইলেন।

“কিয়ৎক্ষণ পরে মহর্ষি ভার্গব ও অন্যান্য মুনিগণ জাগরিত হইয়া দেখিলেন, কলস জলশূন্য রহিয়াছে। তখন তাঁহারা সকলে একত্র মিলিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, ইহা কাহার কর্ম্ম?” মহারাজ যুবনাশ্ব তাঁহাদের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “মহর্ষিগণ! আমি পিপাসিত হইয়া এই জল পান করিয়াছি।” তখন ভগবান ভার্গব কহিলেন, “হে রাজন! জল পান করা অতিশয় গহিত হইয়াছে। আমি আপনার পুত্রের নিমিত্তই দারুণ তপানুষ্ঠানদ্বারা এই কুম্ভস্থ জলমধ্যে ব্ৰহ্মস্থাপন করিয়াছিলাম। আমার অভিলাষ ছিল যে, আপনার পত্নী এই জলপান করিয়া মহাবল-পরাক্রান্ত তপোবলসংযুক্ত এক পুত্র প্রসব করিবেন এবং ঐ পুত্ৰ স্বীয় বলপ্রভাবে ইন্দ্রকেও নিহত করিতে পরিবে; কিন্তু আপনি স্বয়ং সেই জলপান করিয়া নিতান্ত অন্যায় কাৰ্য্য করিয়াছেন। জানিলাম, দৈববল অখণ্ডনীয়। এই জলপানে যে ফল হইবে, আমরা কোনক্রমেই তাহার অন্যথা করিতে সমর্থ হইব না। আপনি পিপাসিত হইয়া আমার তপোবীৰ্য্যসস্তুত বিধিমন্ত্রপুরস্কৃত জলপান করিয়াছেন, এই নিমিত্ত আপনিই পূর্বোেক্তরূপ পুত্র প্রসব করিবেন। আমরা যাহাতে আপনার শত্ৰুসদৃশ সন্তান সমুৎপন্ন হয় ও গর্ভধারণজন্য দুঃখভোগ করিতে না হয়, এরূপ এক পরমাদ্ভূত যজ্ঞানুষ্ঠান করিব।”

“অনন্তর ক্ৰমে ক্ৰমে শত বৎসর পরিপূর্ণ হইলে মহাত্মা যুবনাশ্ব-মহীপতির বামপার্শ্ব ভেদ করিয়া সূৰ্য্যসম প্রভাসম্পন্ন মহাতেজঃ এক কুমার বহির্গত হইল। তপস্যার কি আশ্চৰ্য্য প্রভাব! ঈদৃশ ব্যাপারেও মহীপতি যুবনাশ্বের মৃত্যু হইল না। তখন মহাতেজঃ শত্রু ঐ বালক-সন্দর্শনার্থ আগমন করিলে দেবগণ কহিলেন, “হে সুররাজ! এই পুরুষগর্ভসভূত বালক কি পান করিবে?” তখন দেবরাজ ইন্দ্ৰ সেই বালকমুখে আপনার প্রদেশিনী [তর্জ্জনী, অঙ্গুষ্ঠ] প্ৰদানপূর্ব্বক কহিলেন, “এই বালক “মাং ধাস্যতি” অর্থাৎ আমার এই প্রদেশিনীর রস পান করিবে।” এই নিমিত্ত দেবগণ ঐ বালকের নাম মান্ধাতা রাখিলেন। ঐ শিশু শক্রের প্রদেশিনীপ্রাপ্ত হইয়া ত্রয়াদশ বিতস্তিপরিমাণে বর্দ্ধিত হইল। সুররাজ শতক্ৰতু মনে মনে সঙ্কল্প করিবামাত্র ঐ বালক সমুদয় বেদ, ধনুর্ব্বেদ, দিব্যাস্ত্ৰসকল, আজগবনামক ধনু, স্বর্গোদ্ভব শরসমুদয় এবং অভেদ্য কবিচপ্রাপ্ত হইলেন।

পরে যুবনাশ্বতনয় সুররাজকর্ত্তৃক অভিষিক্ত হইয়া ধর্ম্মপ্রভাবে ত্ৰিলোক বিজয় করিলেন, তাহাঁর আজ্ঞা অপ্রতিহত হইল এবং নানাবিধ রত্নজাত স্বয়ং তাঁহার সমীপে উপস্থিত হইতে লাগিল। এই বসুসম্পূর্ণ বসুন্ধরা তাঁহারই ভোগ্য হইল। তিনি প্রভূতদক্ষিণ বিবিধ যজ্ঞসকল সম্পন্ন করিয়া পরিশেষে চয়ন-ক্রতুর অনুষ্ঠানদ্বারা অপৰ্য্যাপ্ত পুণ্যপ্রাপ্ত হইয়া ইন্দ্রের অৰ্দ্ধাসন লাভ করিলেন। সেই ধর্ম্মপরায়ণ মহীপাল সাতিশয় শাসনদ্বারা একদিনেই এই সসাগরা ধরা পরাজয় করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রভূত-দক্ষিণ যজ্ঞসমূহের চৈত্য-সমুদয়দ্বারা সমস্ত মহীমণ্ডল ব্যাপ্ত হইয়াছিল। তিনি ব্রাহ্মণগণকে দশসহস্ৰ-পদ্ম গোলাপ প্ৰদান করিয়াছিলেন। সেই মহাত্মা দ্বাদশবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টির সময় শস্যবৃদ্ধির নিমিত্ত দেবরাজ ইন্দ্রের সমক্ষে স্বয়ং জলবর্ষণ করিয়াছিলেন। তিনি সোমকুলসমুৎপন্ন মহামেঘের ন্যায় গর্জ্জনকারী গান্ধারাধিপতিকে নিশিত শরদ্বারা সংহার করিয়াছিলেন। সেই অমিততেজাঃ ভূপতি চতুবিধ প্রজাপালন ও তপস্যাদ্বারা সমুদয় লোককে তাপিত ও অস্থির করিয়াছিলেন। সেই সূৰ্য্যসদৃশ তেজঃসম্পন্ন মহীপতির এই দেব-যজনস্থান; এই পরমপবিত্র প্রদেশ কুরুক্ষেত্রের মধ্যভাগ। হে মহারাজ! আমি তোমার জিজ্ঞাসানুসারে মান্ধাতার আলোকসামান্য জন্ম প্রভৃত সমুদয় চরিত্র কীর্ত্তন করিলাম।”

কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির মহর্ষি লোমশের বাক্যশ্রবণানন্তর মহীপাল সোমকের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলেন।