১১৯. পাণ্ডবদুঃখদর্শনে বলরামের খেদোক্তি

১১৯তম অধ্যায়

পাণ্ডবদুঃখদর্শনে বলরামের খেদোক্তি

জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! সর্ব্বশাস্ত্ৰবিশারদ যাদব ও পাণ্ডবগণ প্রভাসে সমবেত হইয়া কিরূপ কথোপকথন ও কোন্‌ কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন? বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! যাদবগণ অতিপবিত্ৰ প্ৰভাস-তীর্থে পরস্পর সমবেত হইয়া পাণ্ডবদিগকে বেষ্টন করিয়া উপবেশন করিলেন, এই অবসরে বিশাল হলধারী মৃণালধবল বলদেব বনমালী কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! যখন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির শিরে জটাভার-ধারণ ও চীর-পরিধান করিয়া বনবাসে অশেষ ক্লেশে কালব্যাপন করিতেছেন আর দুর্ম্মতি দুৰ্য্যোধন এই বিশাল বিশ্বরাজ্যের অধিপতি হইয়া পরমসুখে প্রজাপালন করিতেছে, তখন বসুন্ধরা এখনও বিদীর্ণ হইয়া তাহাকে বিবরসাৎ করিলেন না কেন? হা ধর্ম্ম! তোমাকে আর কেহই শ্রেয়স্কর বলিয়া গণ্য করিবে না ও অধর্ম্মকে পরাভাবের হেতু বলিয়া স্বীকার করিবে না। অতঃপর নির্বোধ ব্যক্তিরা ধর্ম্ম অপেক্ষা অধর্ম্মকেই গুরুতর ও শ্ৰেয়স্কর জ্ঞান করিবে। দুৰ্য্যোধনের শ্ৰীবৃদ্ধি এবং ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্যনাশ ও বনবাস-জন্য যুধিষ্ঠিরানুরক্ত প্ৰজাগণকে কিংকর্ত্তব্যতা-বিষয়ে পরস্পর মন্ত্রণা করিতে নিরীক্ষণ করিয়া দুৰ্য্যোধন-বশংবদ জনগণের শঙ্কা জন্মিল। এই বদন্যবর ধর্ম্মপরায়ণ সত্যমতি রাজা যুধিষ্ঠির রাজ্যচ্যুত ও সুখভ্রষ্ট হইলেন, কিন্তু অধার্ম্মিক দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন কি নিমিত্ত অভ্যুদয়লাভ করিতেছে, তাহা বলিতে পারি না। ভীষ্ম, কৃপ, দ্রোণ ও বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র ইহারা নিরপরাধ পাৰ্থদিগকে বনবাসে প্রেরণ করিয়া কিরূপে সুখভোগ করিতেছেন? হে কেশব! সেই সমস্ত অধর্ম্মরুচি ভরতকুলপ্রধান লোকদিগকে ধিক! সেই বৃদ্ধ রাজা নিষ্পাপ পুত্রদিগকে রাজ্যচ্যুত করিয়া পরকালে পিতৃলোকের নিকট ‘আমি পুত্ৰগণের সহিত সম্যকরূপে ব্যবহার করিয়াছি’, ইহা কিরূপে মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করিবেন? কি প্রকার কুকাৰ্য্য করিয়া ইহকালে অন্ধ হইয়া জন্মপরিগ্রহ করিয়াছেন, তাহার বিন্দু-বিসর্গও অনুধাবন করিতেছেন না। ধৃতরাষ্ট্র মহানুভব ভীষ্মাদির অবমাননা করিয়া তাঁহাদিগের অসম্মতিতে ও অক্ষুব্ধ-চিত্তে পাণ্ডবদিগকে নির্ব্বাসিত করিয়াছেন। বোধ হয় বিচিত্ৰবীৰ্য্যতনয় শ্মশানভূমিতে সুজাত, সুবৰ্ণসদৃশ দুনিমিত্তসূচক কোন পার্থিব বস্তু প্রত্যক্ষ করিয়া থাকিবেন, এই নিমিত্তই তিনি পাণ্ডবগণের প্রতি নৃশংস ব্যবহার করিতেছেন; উহা তাহার আসন্ন বিপৎপাতের কারণ, তাহাতে সন্দেহ নাই।

“যে মহাবীর নিরায়ুধ হইয়া রণক্ষেত্রে বিপক্ষগণের অসংখ্য সৈন্য সংহার করিয়া থাকেন, যাঁহার গম্ভীর-গর্জ্জন শ্রবণ করিবামাত্র শত্রুসৈন্যেরা অতিমাত্র ভীত হইয়া বিণ্মূত্র পরিত্যাগ করে, সেই বৃকোদর এক্ষণে ক্ষুৎপিপাসাক্লান্ত ও পথশ্রান্ত হইয়া ঘোর অরণ্যবাসের ক্লেশপরম্পরা স্মরণপূর্ব্বক নিঃসংশয়েই সমুদয় সংহার করিবেন। যাহার তুল্য এই পৃথিবীতে আর বীর নাই, সেই বৃকোদার শীতবাতাতপে একান্ত কৰ্শিতাঙ্গ হইয়া অচিরকালমধ্যে সমস্ত শত্রু নাশ করিবেন। যিনি পূর্ব্বে একরথে সানুচর সমস্ত প্রাচ্য-মহীপালগণকে পরাজয় করিয়া নির্ব্বিঘ্নে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন, অদ্য সেই মহাবীর বৃকোদার চীরবাস ধারণ করিয়া বনচারী হইয়াছেন। যিনি পূর্ব্বে সমুদ্রের উপকূলে সমাগত সমস্ত দাক্ষিণাত্যনৃপতিকে বশীভূত করিয়াছিলেন, সেই সহদেব আজি তাপস বেশধারী হইয়াছেন। যিনি পূর্ব্বে পাশ্চাত্য-মহীপালগণকে যুদ্ধে পরাভব করিয়াছিলেন, এক্ষণে সেই নকুল জটাচীরধারী ও মলিনকলেবর হইয়া সুলভ বন্য ফলমূলে জীবিকানির্ব্বাহ করিতেছেন। যিনি দ্রুপদরাজের অতি-সমৃদ্ধ যজ্ঞবেদী হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছেন চিরসুখোচিত সেই দ্রৌপদীই বা আজি কিরূপে বনবাস-দুঃখ সহ্য করিতেছেন? ধর্ম্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারের আত্মজেরা চিরকাল সুখভোগ করিয়া এক্ষণে বনে বনে কিরূপে অশেষ ক্লেশে কালব্যাপন করিতেছেন! সানুচর সপত্নীক রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে পরাজিত হইয়াছেন ও দুর্ম্মতি দুৰ্য্যোধন পরিবদ্ধিত হইতেছে! হায়! সশৈলী ধরা এখনও কেন রসাতলে প্রবিষ্ট হইল না?”