১৪৯. জয়দ্ৰথবধে পাণ্ডবপ্রীতি-কৃষ্ণাভিনন্দন

১৪৯তম অধ্যায়

জয়দ্ৰথবধে পাণ্ডবপ্রীতি-কৃষ্ণাভিনন্দন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাত্মা হৃষীকেশ সাতিশয় আহ্লাদিতচিত্তে ধর্ম্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠিরের নিকট আগমনপূর্ব্বক তাঁহার পাদবন্দন করিয়া কহিতে লাগিলেন, হে নরোত্তম! আজ আপনার পরম সৌভাগ্য। আজ ভাগ্যক্রমে আপনার শত্রু বিনষ্ট হইয়াছে, মহাবীর অর্জ্জুনও প্রতিজ্ঞা হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছেন। অরাতিপাতন ধর্ম্মনন্দন কেশবের বাক্যশ্রবণে পরম আহ্লাদিত হইয়া স্বীয় রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক আনন্দাশ্রুপূর্ণলোচনে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে আলিঙ্গন করিলেন; তৎপরে নেত্ৰজল অপনীত করিয়া বাসুদেব ও ধনঞ্জয়কে কহিতে লাগিলেন, হে বীরদ্বয়! আজ ভাগ্যক্রমে পাপাত্মা নরাধম সিন্ধুরাজ নিহত হইয়াছে; তোমার প্রতিজ্ঞাভার হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছ; আমি যারপরনাই প্রীতি লাভ করিয়াছি এবং অরাতিগণও শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়াছে। হে মধুসূদন! তুমি ত্রিলোকগুরু, তুমি সহায় থাকিলে ত্রিলোকমধ্যে কোন কাৰ্য্যই দুষ্কর হয় না। হে গোবিন্দ! পূর্ব্বকালে পাকশাসন [ইন্দ্র] যেরূপ তোমার প্রসাদে দানবগণকে পরাজিত করিয়াছেন, তদ্রূপ আমরাও তোমারই প্রসাদে অরাতিগণকে পরাজিত করিয়াছি। হে বার্ষ্ণেয়! তুমি যাহাদিগের প্রতি পরিতুষ্ট থাক, তাহাদের পক্ষে পৃথিবীপরাজয়ও অতি তুচ্ছ; ত্রিলোকবিজয়ও তাহাদিগের দুষ্কর হয় না। হে জনার্দ্দন! তুমি ত্ৰিদশেশ্বর, তুমি যাহাদের নাথ, তাহাদের পাপের লেশমাত্রও থাকে না এবং কদাচ সংগ্রামে পরাজয় হয় না। তোমার প্রসাদেই সুররাজ রণক্ষেত্রে দানবদল দলনপূর্ব্বক ত্রিলোকমধ্যে জয়লাভ করিয়া সুরগণের ঈশ্বর হইয়াছেন। তোমার অনুগ্রহেই দেবগণ অমরত্ব লাভ করিয়া অক্ষয় স্বর্গভোগ করিতেছেন। তোমার প্রসাদেই এই সচরাচর পৃথিবীস্থ সমুদয় লোক স্ব স্ব ধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক নিত্য জপহোমাদির অনুষ্ঠানে তৎপর রহিয়াছে। পূর্ব্বকালে সমস্ত একার্ণবময় [জলময়—একমাত্র সমুদ্রে পরিণত] হইয়া গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল; কেবল তোমার কৃপাতেই পুনরায় ব্যস্ত হইয়াছে। তুমি সর্ব্বলোকের স্রষ্টা, পরমাত্মা, অব্যয় পুরাণপুরুষ, দেবদেব, সনাতন, পরাৎপর ও পরমপুরুষ; তোমার আদি নাই, নিধনও নাই। তুমি একবার যাহাদিগের নয়নে নিপতিত হও, তাহারা কখনই মুগ্ধ হয় না। তুমি ভক্ত-জনগণকে আপদ হইতে উদ্ধার করিয়া থাক, যে ব্যক্তি তোমার শরণাপন্ন হয়, সে পরমৈশ্বৰ্য্য লাভ করে। হে পরমাত্মন্! তুমি চারিবেদে গীত হইয়া থাক, আমি তোমাকে প্রাপ্ত হইয়া যারপরনাই ঐশ্বৰ্য্য ভোগ করিতেছি। হে নরেশ্বর! তুমি পরমেশ্বর, তিৰ্য্যগণের ঈশ্বর এবং ঈশ্বরেরও ঈশ্বর; অতএব তোমাকে নমস্কার। হে মাধব! তুমি জয়লাভে পরিবর্দ্ধিত হও। হে সর্ব্বাত্মন্‌! হে পৃথুলোচন! তুমি সমস্ত লোকের আদি কারণ। তুমি ধনঞ্জয়ের সখা ও সর্ব্বদা তাহার হিতসাধনে রত আছ, ধনঞ্জয়ও তোমাকে প্রাপ্ত হইয়া অপার সুখলাভ করিয়া থাকে।’

“হে মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির এইরূপ কহিলে পর কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন উভয়ে পরম আহ্লাদিত হইয়া তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে রাজন! আপনার ক্রোধাগ্নিপ্রভাবেই পাপাত্মা সিন্ধুরাজ ও বিপুল কৌরবসৈন্য দগ্ধ হইয়াছে। আপনার কোপেই কৌরবগণ নিহত হইয়াছে, হইতেছে ও হইবে। হে বীর। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন আপনাকে কোপান্বিত করিয়াই বন্ধুবান্ধবগণসমভিব্যাহারে সমরাঙ্গনে প্রাণত্যাগ করিবে। পূর্ব্বে দেবতারাও যাঁহাকে পরাভূত করিতে সমর্থ হয়েন নাই, আজি সেই কুরুপিতামহ ভীষ্ম আপনার কোপপ্রভাবেই শরশয্যায় শয়ন করিয়াছেন। আপনি যাহাদিগের দ্বেষ্টা, তাহাদিগকে অবশ্যই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে হয়, তাহারা কখনই সংগ্রামে জয়লাভ করিতে পারে না। আপনি যাহাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েন, তাহাদিগের রাজ্য, প্রাণ, প্রিয় পুত্র ও বিবিধ সুখভোগ অচিরাৎ বিনষ্ট হইয়া যায়। হে রাজসধর্ম্মপরায়ন ভূপাল! আপনি যখন ক্রুদ্ধ হইয়াছেন, তখন কৌরবগণ বন্ধুবান্ধবগণের সহিত বিনষ্ট হইবে।’

শত্রুজয়ী ভীম-সাত্যকির অভিনন্দন

“হে মহারাজ! মহাত্মা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন যুধিষ্ঠিকে এইরূপ কহিতেছেন, এমন সময় অরাতিশরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ মহাধনুর্দ্ধর মহাবীর ভীমসেন ও মহাবীর সাত্যকি তথায় সমুপস্থিত হইয়া পরমগুরু যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদনপুর্ব্বক পাঞ্চালগণে পরিবেষ্টিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ক্ষিতিতলে দণ্ডায়মান রহিলেন। মহাত্মা ধর্ম্মরাজ মহাবীর ভীমসেন ও সাত্যকিকে হৃষ্টচিত্তে কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান অবলোকন করিয়া তাঁহাদিগকে অভিনন্দনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, হে বীরদ্বয়। আজ তোমরা ভাগ্যক্রমে দ্রোণরূপ গ্রাহ ও হার্দ্দিক্য-মকরযুক্ত কৌরবসৈন্যরূপ মহাসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছ। আজ ভাগ্যক্রমে পৃথিবীস্থ ভূপতিগণ এবং দ্রোণ ও কৃতবর্ম্মা তোমাদের নিকট পরাজিত হইয়াছেন। ভাগ্যবলে তোমরা বিকীর্ণ অস্ত্রদ্বারা কর্ণকে পরাভূত ও শল্যকে পরাঙ্মুখ করিয়াছ। হে যুদ্ধবিশারদ মহারথদ্বয়! আমি ভাগ্যক্রমে তোমাদিগকে সমরাঙ্গন হইতে কুশলে প্রত্যাগত দেখিলাম। তোমরা আমার আজ্ঞা প্রতিপালন ও সম্মান করিয়া থাক এবং কদাচ সংগ্রামে পরাঙ্মুখ হও না; তোমরা আমার প্রাণতুল্য।’

“হে মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির ভীমসেন ও সাত্যকিকে এইরূপ কহিয়া আনন্দাশ্রুপূর্ণনেত্রে তাঁহাদিগকে আলিঙ্গন করিলেন। তখন, পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যগণ তাঁহাদিগকে হৃষ্ট দেখিয়া পরমাহ্লাদিতচিত্তে সংগ্রামে মনোনিবেশ করিল।”