১৩৯. ভীম-কর্ণের পুনঃ সমর–কর্ণনিপীড়ন

১৩৯তম অধ্যায়

ভীম-কর্ণের পুনঃ সমর–কর্ণনিপীড়ন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর কর্ণ তিনবাণে ভীমসেনকে বিদ্ধ করিয়া বহুবিধ বিচিত্র শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন কর্ণের বাণে বিদ্ধ হইয়া ভিদ্যমান অচলের ন্যায় কিঞ্চিৎমাত্রও ব্যথিত হইলেন না, তিনি তৈলধৌত নিশিত কর্ণিদ্বারা কর্ণের কর্ণদেশ ভেদপূর্ব্বক অম্বরস্বলিত সূৰ্য্যজ্যোতির ন্যায় তাহার সুচারু কুণ্ডল ভূতলে পাতিত করিলেন এবং অম্লানমুখে অন্য ভল্লদ্বারা তাহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া পুনরায় ললাটদেশে আশীবিষোপম দশ নারাচ প্রয়োগ করিলেন। সর্পগণ যেমন বল্মীকমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ ভীমনিক্ষিপ্ত নারাচনিকর সূতপুত্রের ললাটে প্রবিষ্ট হইল। তিনি পূর্ব্বে মস্তকে নীলোৎপলময়ী মালা ধারণ করিয়া যেরূপ শোভা পাইতেন, এক্ষণে ললাটবিদ্ধ নারাচদ্বারা তদ্রূপ শোভা পাইতে লাগিলেন। মহাবীর কর্ণ এইরূপে ভীমের শরে গাঢ়বিদ্ধ ও রুধিরাক্তকলেবর হইয়া তৎক্ষণাৎ রথকূবর অবলম্বনপূর্ব্বক নয়নদ্বয় নির্মীলিত করিয়া রহিলেন এবং অল্পকালমধ্যে পুনরায় চৈতন্যলাভপূর্ব্বক ক্রোধভরে মহাবেগে ভীমসেনের রথাভিমুখে ধাবমান হইয়া তাঁহার উপর গৃধ্রপক্ষবিশিষ্ট শত বাণ পরিত্যাগ করিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন কর্ণের বলবীর্য্যের বিষয় কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া তাঁহাকে অনাদরপূর্ব্বক তাঁহার উপর উগ্র শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন; কর্ণও রোষপরবশ হইয়া নয়শরে ভীমসেনের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন।

“এইরূপে সেই শালসদৃশ পরাক্রান্ত মহাবীরদ্বয় প্রতিচিকীর্ষাপরতন্ত্র হইয়া বারিধারাবর্ষী মেঘদ্বয়ের ন্যায় বিবিধ শরজাল বর্ষণ ও তলশব্দ প্রয়োগ করিয়া পরস্পরকে শঙ্কিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবাহু ভীমসেন ক্ষুরপ্রদ্বারা কর্ণের শরাসন ছেদন করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। মহারথ কর্ণ অবিলম্বে সেই ছিন্নচাপ পরিত্যাগ করিয়া অন্য সুদৃঢ় শরাসন গ্রহণ করিলেন। তৎকালে কৌরব, সৌবীর ও সৈন্ধব সৈন্যগণকে নিহত, রাশি রাশি বর্ম্ম, ধ্বজ ও শস্ত্রদ্বারা পৃথিবী সমাচ্ছন্ন এবং চতুর্দ্দিকে গজারোহী, অশ্বারোহী ও রথারোহিগণকে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার সর্ব্বশরীর ক্রোধে প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। তখন তিনি সেই শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক সরোষনয়নে ভীমসেনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া অসংখ্য শরবর্ষণ করিয়া শরৎকালীন মধ্যাহ্নগত ময়ুখমালী [কিরণশালী] দিনকরের ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিলেন। তাঁহার ভীষণ কলেবর ভীমের শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়া কিরণাবৃত সূর্যের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তিনি যে কোন সময় শরসমূহ গ্রহণ, কখন সন্ধান, কখন আকর্ষণ ও কখনই বা বিসৰ্জন করিতেন, তাহার কিছুই লক্ষিত হইত না। তিনি দুইহস্তে বাণবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে তাঁহার ভীষণ শরনিকর হুতাশনচক্রের ন্যায় মণ্ডলাকারে প্রকাশ পাইতে লাগিল। তাঁহার কার্মুকনিক্ষিপ্ত সুবর্ণপুঙ্খ নিশিত অসংখ্য শরজাল আকাশমার্গে সমুত্থিত হইয়া সমুদয় দিক, বিদিক ও সূৰ্য্যপ্রভা সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল এবং ক্রৌঞ্চপক্ষীর ন্যায় শ্রেণীবদ্ধ হইয়া আকাশপথে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিল। অধিরথনন্দন কর্ণ পুনরায় সুবর্ণভূষিত শিলাধৌত, গৃধ্রপক্ষযুক্ত, বেগবান বাণ বর্ষণ করিতে লাগিলেন। সেই সুবর্ণনির্মিত শরজাল নিরন্তর ভীমসেনের রথে পতিত হইল। ঐ সমুদয় শর আকাশপথে গমনসময়ে শলভসমূহের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তিনি এরূপ লঘূহস্তে শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন যে, ঐ শরসকল এক দীর্ঘ শরের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। জলধর যেমন বারিধারা বর্ষণ করিয়া ভূধরকে আচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ মহাবীর কর্ণ ক্রুদ্ধ হইয়া সায়কবর্ষণে ভীমসেনকে সমাচ্ছন্ন করিলেন।

“হে মহারাজ! ঐ সময় আপনার পুত্রগণ সৈন্য সামন্তসমভিব্যাহারে বৃকোদরের বলবীর্য্য, পরাক্রম ও কাৰ্য্য দর্শন করিতে লাগিলেন। ঐ মহাবীর উদ্ধৃত সাগরসদৃশ ভীষণ শরজাল লক্ষ্য না করিয়া ক্রোধভরে কর্ণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তাঁহার সুবর্ণপৃষ্ঠ মণ্ডলীকৃত ইন্দ্রায়ুধসদৃশ শরাসন হইতে সুবর্ণপুঞ্জ শরজাল বিনির্গত হইয়া আকাশমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করাতে বোধ হইল যেন নভোমণ্ডলে মালা লম্বমান রহিয়াছে।

“তখন মহাবীর কর্ণের আকাশে উত্থিত শরজাল ভীমসেনের শরে আহত হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিল। ভীমসেন ও কর্ণের কনকপুঙ্খ, সরলগামী অগ্নিস্ফুলিঙ্গসদৃশ শরজালে নভোমণ্ডল পরিব্যাপ্ত হইল তখন প্রভাকরের প্রভানাশ ও সমীরণের গতিরোধ হইয়া গেল এবং কোন পদার্থই নয়নগোচর হইল না। ঐ সময় সূতপুত্র কর্ণ মহাত্মা বৃকোদরের বলবীৰ্য্য অগ্রাহ্য করিয়া তাঁহাকে অসংখ্যশরে সমাচ্ছন্ন করিয়া সমধিক পরাক্রম প্রকাশ করিতে লাগিলেন; ভীমসেনও তাঁহার উপর সহস্র সহস্র শর নিক্ষেপ করিলেন। ঐ বীরদ্বয়বিসৃষ্ট শরনিকর সমীরণের ন্যায় পরস্পর সঙ্ঘটিত হইতে লাগিল। সেই শরনিকরের সঙ্ঘর্ষণে নভোমণ্ডলে হুতাশন প্রাদুর্ভূত হইল। তখন মহাবীর কর্ণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভীমসেনকে সংহার করিবার নিমিত্ত কর্ম্মারপরিমার্জিত নিশিত শরজাল নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর ভীম সমধিক পরাক্রম প্রকাশপূর্ব্বক শরদ্বারা অন্তরীক্ষে কর্ণনিক্ষিপ্ত প্রত্যেক শর তিন তিন খণ্ডে ছেদন করিয়া, তাঁহাকে ‘থাক্ থাক্‌’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন। পরে তিনি পুনর্ব্বার দহনোন্মুখ হুতাশনের ন্যায় রোষপ্রদীপ্ত হইয়া সুতীক্ষ্ণ শরনিকর বর্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন সেই বীরদ্বয়ের গোধানিৰ্মিত অঙ্গুলিত্রের আঘাতে চটাচট শব্দ সমুত্থিত হইল। ভয়ঙ্কর তলশব্দ, সিংহনাদ, রথঘর্ঘর রব ও জ্যাশব্দে সমরভূমি পরিপূর্ণ হইয়া গেল। অন্যান্য যোদ্ধারা পরস্পর বধাভিলাষী কর্ণ ও ভীমের পরাক্রম দর্শনমানসে সংগ্রামে বিরত হইলেন। দেবর্ষি, সিদ্ধ ও গন্ধৰ্ব্বগণ তাঁহাদিগকে সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। বিদ্যাধরগণ তাঁহাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিলেন।

“অনন্তর মহাবীর ভীমসেন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অস্ত্রপ্রয়োগপূর্ব্বক কর্ণের অস্ত্রসমুদয় নিবারণ করিয়া তাঁহাকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণও ভীমের শরজাল নিবারণ করিয়া তাঁহার প্রতি আশীবিষসদৃশ নয় নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। ভীমসেন নয়বাণে নভোমণ্ডলে সেই নয় নারাচ ছেদনপূর্ব্বক কর্ণকে “থাক থাক’ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন এবং তৎপরে ক্রোধভরে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া যমদণ্ডসদৃশ এক ভীষণ শর নিক্ষেপ করিলেন। প্রবলপ্রতাপ কর্ণ সেই ভীমবিসৃষ্ট শর উপস্থিত না হইতে হইতেই হাস্যমুখে তিনশরে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর পুনর্ব্বার ভয়ঙ্কর শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। কর্ণও স্বীয় অস্ত্রবল প্রকাশপূর্ব্বক নিতান্ত নির্ভীকের ন্যায় ঐ সমস্ত শর প্রতিগ্ৰহ করিলেন। পরে তিনি রোষাবিষ্ট হইয়া সন্নতপর্ব্ব শরজালে ভীমের তূণীর, ধনুর্জ্যা এবং অশ্বগণের রশ্মি ও যোক্ত্র ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে তাঁহার অশ্বগণকে বিনাশ করিয়া সারথিকে পাঁচশরে বিদ্ধ করিলেন। ভীমসারথি কর্ণশরে সমাহত হইয়া সত্বর তথা হইতে মহাবীর যুধামন্যুর রথে গমন করিল।

“তখন কালানলসন্নিভ মহাবীর কর্ণ রোষাবিষ্ট হইয়া হাস্যমুখে ভীমের ধ্বজ ও পতাকা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ভীমসেন তদ্দর্শনে ক্রোধে একান্ত অধীর হইয়া এক কনকসমলঙ্কৃত শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক বিঘূর্ণিত করিয়া কর্ণের রথের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। মিত্রার্থে সংগ্রামপ্রবৃত্ত সূতনন্দন সেই মহোল্কাসদৃশ মহাশক্তি আগমন করিতে দেখিয়া দশশরে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর মৃত্যু ও জয়ের অন্যতর লাভ করিতে অভিলাষী হইয়া এক সুবর্ণখচিত চর্ম্ম ও খড়্গ গ্রহণ করিলেন। কর্ণ হাস্যমুখে তৎক্ষণাৎ বহুসংখ্যকশরে সেই চর্ম্ম ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন ভীমসেন ক্রোধভরে সত্বর কর্ণের রথাভিমুখে ভয়ঙ্কর অসি নিক্ষেপ করিলেন। ভীমনিক্ষিপ্ত অসি কর্ণের জ্যাসমবেত কার্মুক ছেদন করিয়া অম্বরতলপরিভ্রষ্ট রোষাবিষ্ট ভুজঙ্গের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। তখন কর্ণ ভীমকে বিনাশ করিবার বাসনায় হাস্য করিয়া এক সুদৃঢ় জ্যাসম্পন্ন শত্রুবিনাশন শরাসন গ্রহণ করিয়া সুতীক্ষ্ণ রুক্মপুঙ্খ সহস্র সহস্র শর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।

ভীমের বিশৃঙ্খল যুদ্ধে কর্ণের কটূক্তি

“মহাবীর ভীম এইরূপে কর্ণশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া তাঁহার অন্তঃকরণ একান্ত ব্যথিত করিয়া অন্তরীক্ষে উত্থিত হইলেন। কর্ণ সেই বিজয়াভিলাষী ভীমের অসাধারণ কাৰ্য্য অবলোকনপূর্ব্বক রথে লীন হইয়া তাঁহাকে বঞ্চিত করিলেন। ভীম তাঁহাকে রথমধ্যে লীন ও ব্যাকুলেন্দ্রিয় নিরীক্ষণ করিয়া তাঁহার ধ্বজ গ্রহণপূর্ব্বক ভূতলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কৌরব ও চারণগণ ভীমকে পতগরাজ গরুড় যেমন ভুজঙ্গ সংহার করিবার নিমিত্ত যত্নবান্ হয়, তদ্রূপ রথ হইতে কর্ণকে বিনাশ করিতে উদ্যত দেখিয়া তাঁহার ভূয়সী প্রশংসা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। এইরূপে ভীম আপনার রথ পরিত্যাগ করিয়া ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম প্রতিপালনপূর্ব্বক যুদ্ধার্থে কর্ণসন্নিধানে অবস্থান করিতে লাগিলেন; মহাবীর কর্ণও রোষভরে যুদ্ধাৰ্থ সমুপস্থিত ভীমের সন্নিধানে আগমন করিলেন। তখন সেই মহাবলপরাক্রান্ত বীরদ্বয় সমবেত হইয়া পরস্পর স্পর্ধা প্ৰকাশপূর্ব্বক বর্ষাকালীন জলপটলের ন্যায় তর্জ্জনগর্জ্জন করিতে লাগিলেন। দেবাসুরসংগ্রামের ন্যায় তাঁহাদের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। তখন মহাবীর কর্ণ অস্ত্রবলে ভীমসেনকে শস্ত্রবিহীন করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। ভীমসেন তদ্দর্শনে ভীত হইয়া অর্জ্জুননিপাতিত পর্ব্বতোপম করিসৈন্য অবলোকনপূর্ব্বক, কর্ণ রথ লইয়া কদাচ তন্মধ্যে প্রবেশ করিতে সমর্থ হইবে না, এই ভাবিয়া তাঁহার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তৎপরে রথদুর্গে প্রবিষ্ট হইয়া প্রাণরক্ষা করিবার নিমিত্ত কর্ণকে আর প্রহার করিলেন না এবং আত্মরক্ষা করিবার বাসনায় হনুমান যেমন মহৌষধিসম্পন্ন গন্ধমাদন উত্তোলন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ধনঞ্জয়শরাহত এক হস্তী উত্তোলিত করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহাবীর কর্ণ বিশিখজালে সেই হস্তী ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিলেন। ভীমসেন তদ্দর্শনে একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া মাতঙ্গের ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গ্রহণপূর্ব্বক কর্ণের প্রতি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তিনি চক্র, অশ্ব প্রভৃতি যে সমস্ত বস্তু রণস্থলে নিপতিত দেখিতে পাইলেন, তৎসমুদয়ই কর্ণের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কর্ণ নিশিতশরনিকরে ভীমনিক্ষিপ্ত সেই সমস্ত বস্তু তৎক্ষণাৎ ছেদন করিয়া ফেলিলেন।

“অনন্তর ভীম কর্ণকে সংহার করিবার বাসনায় বজ্রসার সুদারুণ মুষ্টি উদ্যত করিলেন; কিন্তু তাঁহাকে বিনাশ করিতে সমর্থ হইয়াও অর্জ্জুনের পূর্ব্বপ্রতিজ্ঞা রক্ষা করিবার নিমিত্ত তৎকালে সূতপুত্রকে সংহার করিলেন না। তখন মহাবীর কর্ণ নিশিত শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক ভীমকে নিতান্ত ব্যাকুল ও বারংবার মোহে অভিভূত করিতে লাগিলেন, কিন্তু তৎকালে আৰ্য্যা কুন্তীর বাক্য স্মরণ করিয়া সেই নিরস্ত্র ভীমসেনের প্রাণসংহার করিলেন না। অনন্তর তিনি ধাবমান হইয়া ধনুষ্কোটিদ্বারা ভীমের অঙ্গ স্পর্শ করিলেন। ভীম তৎক্ষণাৎ কর্ণের কার্মুক কাড়িয়া লইয়া তাঁহার মস্তকে আঘাত করিতে লাগিলেন। তখন কর্ণ ক্রোধে আরক্তলোচন হইয়া হাস্যমুখে কহিলেন, “হে তুবরক! তুমি মূঢ়, উদরপরায়ণ, সংগ্রামকাতর ও বালক। তুমি অস্ত্রবিদ্যা কিছুমাত্র অবগত নহ; রণস্থল তোমার উপযুক্ত স্থান নহে। যে স্থানে বহুবিধ ভক্ষ্য, ভোজ্য ও পানীয় আছে, তুমি সেই স্থানেরই যোগ্য। তুমি অরণ্যমধ্যে পুষ্প ও ফলমূল আহার করিয়া ব্রত ও নিয়মপ্রতিপালনে অভ্যস্ত; যুদ্ধ করা তোমার কাৰ্য্য নহে। মুনিব্রত ও যুদ্ধ পরস্পর অনেক ভিন্ন। হে বৃকোদর! তুমি বনবাসনিরত। অতএব রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক বনগমন করা তোমার বিধেয়। তুমি আহারের নিমিত্ত স্বীয় গৃহে সুদ, ভৃত্য ও দাসগণের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করিয়া তাড়না করিতে পার; যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া তোমার সাধ্য নহে। তুমি মুনিজনের ন্যায় বনে গমনপূর্ব্বক ফল আহরণ কর। ফলমূলাহার ও অতিথিসৎকারই তোমার উপযুক্ত কাৰ্য্য; শস্ত্র গ্রহণ করা তোমার উচিত নহে।’

“হে মহারাজ! সূতপুত্র ভীমসেনকে এইরূপ উপহাস করিয়া, তিনি বাল্যাবস্থায় যে সকল অপ্রিয় কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তাহাও তাঁহার কর্ণগোচর করিতে লাগিলেন এবং তৎপরে সেই রণক্লান্ত বৃকোদরকে ধনুষ্কোটিদ্বারা স্পর্শ করিয়া পুনরায় হাসিতে হাসিতে কহিলেন, ‘ওহে ভীম! মাদৃশ ব্যক্তির সহিত যুদ্ধ করা তোমার বিধেয় নহে। আমার সদৃশ ব্যক্তির সহিত যুদ্ধ করিতে হইলে এইরূপ এবং অন্যরূপ অবস্থাও ঘটিয়া থাকে। অতএব যে স্থানে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন বিদ্যমান আছেন, তুমি সেই স্থানে গমন কর; তাঁহারা তোমাকে রক্ষা করিবেন। অথবা তুমি বালক, তোমার যুদ্ধে প্রয়োজন কি? অবিলম্বে গৃহে গমন কর।’

“মহাবীর ভীমসেন কর্ণের সেই নিদারুণ বাক্য শ্রবণে হাস্য করিয়া সর্ব্বসমক্ষে তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে মূঢ় কর্ণ! আমি তোমাকে অনেকবার পরাজিত করিয়াছি। তবে কেন তুমি. বৃথা, আত্মশ্লাঘা করিতেছ? পূর্ব্বতন লোকেরা দেবরাজ ইন্দ্রেরও জয় পরাজয় অবলোকন করিয়াছেন। হে দুষ্কুলোদ্ভব! তুমি একবার আমার সহিত মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও; তাহা হইলে আজই আমি সমস্ত রাজগণসমক্ষে মহাবলপরাক্রান্ত বৃহৎকায় কীচকের ন্যায় তোমাকে সংহার করিব।’ তখন মতিমান্ কর্ণ ভীমের অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া সমস্ত ধনুর্দ্ধরসমক্ষে মল্লযুদ্ধ করিতে নিরস্ত হইলেন।

ভীমনিন্দায় ক্রুদ্ধ অর্জ্জুনের কর্ণ-আক্রমণ

“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর কর্ণ ভীমসেনকে রথবিহীন করিয়া কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের সমক্ষে আত্মশ্লাঘা আরম্ভ করিলে কপিধ্বজ অর্জ্জুন কেশবের বাক্যানুসারে কর্ণের উপর শাণিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। পার্থবিসৃষ্ট, কনকসমলঙ্কৃত, গাণ্ডীববিনির্গত, ভুজঙ্গাকার শরসমুদয় ক্রৌঞ্চপর্ব্বতগামী হংসের ন্যায় কর্ণের শরীরমধ্যে প্রবেশ করিল। ভীম ইতিপূর্ব্বে মহাবীর কর্ণের শরাসন ছেদন করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনি অর্জ্জুনশরে দৃঢ়তর আহত হইয়া রথারোহণে সত্বর ভীমের নিকট হইতে পলায়ন করিতে লাগিলেন; মহাবীর ভীমসেনও সাত্যকির রথে আরোহণ করিয়া সমরাঙ্গনে ভ্রাতা সব্যসাচীর অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় অন্তকের ন্যায় ক্ৰোধারুণলচনে অতি সত্বর কর্ণকে লক্ষ্য করিয়া নারাচ নিক্ষেপ করিলের। গাণ্ডীবনির্মুক্ত নারাচ ভুজগললালুপ গরুড়ের ন্যায় অন্তরীক্ষ হইতে কর্ণের উপর পতনোন্মুখ হইল। ঐ সময় মহারথ অশ্বত্থমা ধনঞ্জয়হস্ত হইতে কর্ণকে উদ্ধার করিবার বাসনায় মহাবীর শরদ্বারা আকাশমার্গেই সেই নারাচ দ্বিখণ্ড করিয়া ফেলিলেল। মহাবীর অর্জ্জুন তদ্দর্শনে রোষপরবশ হইয়া চতুঃষষ্টিশরে দ্রোণপুত্রকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, “হে দ্রোণতনয়! পলায়ন না করিয়া ক্ষণকাল রণস্থলে অবস্থান কর’, শরনিপীড়িত অশ্বত্থমা অর্জ্জুনের বাক্য শ্রবণ না করিয়া সত্বর মত্তমাতঙ্গসমাকীর্ণ রণসঙ্কুল সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত কৌন্তয় গাণ্ডীবনির্ঘোষে অন্যান্য সুবর্ণপৃষ্ঠ কার্মুকের নিঃস্বন তিরোহিত করিয়া পশ্চাদ্ভাগে অনতিদূরে প্রস্থিত অশ্বত্থমাকে শরনকিরে ত্রাসিত করিয়া কঙ্কপত্রালঙ্কৃত নারাচসমূহে নর, বারণ ও অশ্বগণের দেহ বিদারণপূর্ব্বক সমস্ত সৈন্য বিনষ্ট করিতে লাগিলেন।”