১৩৪. ভীমকর্ণের তুমুল যুদ্ধ

১৩৪তম অধ্যায়

ভীমকর্ণের তুমুল যুদ্ধ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহারথ কর্ণ ভীমসেনের ভীষণ শরপ্রভাবে পুনরায় রথশূন্য ও পরাজিত হইয়া সত্বর অন্য রথে আরোহণপূর্ব্বক ভীমসেনকে বাণবিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মাতঙ্গদ্বয় যেমন মিলিত হইয়া বিশাল দশনাগ্রদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিয়া থাকে, তদ্রূপ সেই বীরদ্বয় আকর্ণাকৃষ্ট শরনিকর। পরিত্যাগপূর্ব্বক পরস্পরকে প্রহার করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবীর কর্ণ ভীমের প্রতি শরনিক্ষেপপূর্ব্বক সিংহনাদ করিয়া পুনরায় শরনিকরে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন তাঁহাকে প্রথমতঃ দশশরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় বিংশতিশরে বিদ্ধ করিলেন। কর্ণ ভীমের বক্ষঃস্থলে নয় বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক এক শাণিতসায়কে তাঁহার ধ্বজ বিদ্ধ করিয়া গর্জ্জন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীম যেমন অঙ্কুশদ্বারা হস্তীকে ও কশাঘারা অশ্বকে প্রহার করিয়া থাকে, তদ্রূপ ত্ৰিষষ্টিসায়কে কর্ণকে বিদ্ধ করিলেন।

“এইরূপে মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ ভীমসেনশরে গাঢ় বিদ্ধ হইয়া রোষকষায়িতলোচনে সৃক্কণীলেহনপূর্ব্বক ভীমের সংহারার্থ ইন্দ্রনির্মুক্ত বজ্রের ন্যায় সর্ব্বদেহবিদারণক্ষম একবাণ নিক্ষেপ করিলেন। সেই বিচিত্রপুঙ্খ শিলীমুখ কর্ণের কার্মুক হইতে নির্মুক্ত হইয়া ভীমের দেহ ভেদপূর্ব্বক ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইল। তখন মহাবীর বৃকোদর সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইয়া অবিচারিতমনে এক চতুর্হস্তপরিমিত, ষট্‌কোণসম্পন্ন, সুবর্ণমণ্ডিত, অশনিসদৃশ, গুরুতর গদা গ্রহণপূর্ব্বক সুররাজ যেমন অসুরগণকে সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ সেই গদাঘাতে কর্ণের অশ্বগণকে নিপাতিত করিলেন; তৎপরে শরনিকরে তাঁহার সারথিকে সংহারপূর্ব্বক ক্ষুরদ্বারা ধ্বজছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন কর্ণ নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া সেই অশ্বহীন সারথিহীন ও ধ্বজশূন্য রথপরিত্যাগ করিয়া শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক ভূতলে অবস্থান করিতে লাগিলেন। আমরা তাঁহাকে রথশূন্য হইয়াও শরনিবারণে উদ্যত দেখিয়া একান্ত বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে তাঁহার অসাধারণ বলবীৰ্য্য অবলোকন করিতে লাগিলাম।

কর্ণসাহায্যকারী দুর্মুখবধ-কর্ণপলায়ন

“ঐ সময় মহারাজ দুৰ্য্যোধন কর্ণকে রথশূন্য নিরীক্ষণ করিয়া দুর্মুখকে কহিলেন, ‘হে দুর্মুখ! ভীমসেন কর্ণকে রথভ্রষ্ট করিয়াছে, অতএব তুমি অবিলম্বে উহাকে রথে আরোপিত কর।’ দুর্মুখ দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণে সত্বর কর্ণের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া অস্ত্রজাল বিস্তারপূর্ব্বক ভীমকে নিবারণ করিতে লাগিলেন; তখন মহাবীর ভীম দুর্মুখকে কর্ণের সাহায্যে প্রবৃত্ত দেখিয়া সন্তুষ্ট মনে সৃক্কণীলেহন করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎপরে শরপ্রয়োগপূর্ব্বক কর্ণকে নিবারণ করিয়া, অবিলম্বে দুর্মুখের প্রতি ধাবমান হইয়া নতপর্ব্ব সুমুখ নয়বাণে তাঁহাকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। দুর্মুখ বিনষ্ট হইলে মহাবীর কর্ণ তাঁহার রথে আরোহণপূর্ব্বক প্রদীপ্ত দিবাকরের ন্যায় শোভামান হইলেন এবং দুর্মুখকে শোণিতলিপ্তকলেবর, ভিন্নমর্ম্ম ও ধরাসনে শয়ান অবলোকনপূর্ব্বক মুহূর্ত্তকাল যুদ্ধে নিরস্ত হইয়া অপূর্ণলোচনে তাঁহাকে প্রদক্ষিণ ও অতিক্রম করিয়া দীর্ঘ ও উষ্ণ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন। ইত্যবসরে মহাবীর ভীমসেন কর্ণের প্রতি চতুর্দ্দশ নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। সেই ভীমনিক্ষিপ্ত রুধিরপায়ী হেমচিত্রিত সুবর্ণপুঙ্খ নারাচসমুদয় দশদি উল্লসিত করিয়া তাঁহার কবচ ভেদ ও শোণিতপানপূর্ব্বক ভূতলে প্রবেশপূর্ব্বক, বিলমধ্যে অর্দ্ধপ্রবিষ্ট ক্রোধোদ্ধত উরগসমূহের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তখন মহাবীর কর্ণ অবিচারিতচিত্তে সুবর্ণখচিত ভয়ঙ্কর চতুর্দ্দশ নারাচদ্বারা ভীমসেনকে বিদ্ধ করিলেন। ঐ সমস্ত নারাচ ভীমের দক্ষিণভুজ ভেদ করিয়া, পক্ষিগণ যেমন কুঞ্জমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ ধরণীতলে প্রবিষ্ট হইল। দিনকর অস্তগত হইলে তাঁহার ভাস্বর অংশুজাল যেরূপ শোভাপ্রাপ্ত হয়, সেই কর্ণনিক্ষিপ্ত নারাচনিকর ধরাতলে প্রবেশ করিয়া সেইরূপ শোভা পাইতে লাগিল। মহাবীর ভীম ঐ সকল মর্ম্মভেদী নারাচে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া জলধারাস্রাবী অচলের ন্যায় অনবরত রুধিরক্ষরণ করিতে লাগিলেন। তখন তিনি পতগরাজ গরুড়ের তুল্য বেগশালী তিনশরে কর্ণকে এবং সাতশরে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। মহাযশাঃ কর্ণ ভীমের বাহুবলে নিতান্ত নিপীড়িত ও একান্ত বিহুল হইয়া সমর পরিহারপূর্ব্বক বেগগামী তুরঙ্গসমুদয় সঞ্চালনপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীম সুবর্ণখচিত শরাসন বিস্ফারিত করিয়া প্রজ্বলিত হুতাশনের ন্যায় রণস্থলে অবস্থান করিলেন।”