১২৬. অর্জ্জুনাদির অনুসন্ধানে যুধিষ্ঠিরের ভীমপ্রেরণ

১২৬তম অধ্যায়

অর্জ্জুনাদির অনুসন্ধানে যুধিষ্ঠিরের ভীমপ্রেরণ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে পাণ্ডবগণের ব্যূহ আলোড়িত হইলে তাঁহারা পাঞ্চাল ও সোমকদিগের সহিত অতিদূরে গমন করিলেন। সেই যুগান্তকালতুল্য ভয়ঙ্কর লোকক্ষয়কর লোমহর্ষণ সংগ্রামে মহাবলপরাক্রান্ত দ্রোণ বারংবার সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলে এবং পাঞ্চালগণ হীনবীৰ্য্য ও পাণ্ডবেরা নিতান্ত নিপীড়িত হইলে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কাহারও আশ্রয়লাভে কৃতকার্য্য হইলেন না। তিনি কিরূপে সমস্ত রক্ষা হইবে, নিরন্তর এই চিন্তা করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি মহাবীর অর্জ্জুনকে নিরীক্ষণ করিবার নিমিত্ত আকুলচিত্তে চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, কিন্তু ধনঞ্জয় বা বাসুদেবকে কোনক্রমেই দেখিতে পাইলেন না; কেবল অর্জ্জুনের বানরলাঞ্ছিত ধ্বজদণ্ড সন্দর্শন ও গাণ্ডীবনির্ঘোষ শ্রবণ করিতে লাগিলেন। তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে বৃষ্ণিপ্রবর মহাবীর সাত্যকিকে নিরীক্ষণ করিলেন; কিন্তু তৎকালে নরোত্তম বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে অবলোকন না করিয়া কিছুতেই শান্তিলাভ করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন তিনি লোকনিন্দাভয়ে নিতান্ত ভীত হইয়া সাত্যকির রথের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক চিন্তা করিতে লাগিলেন, আমি মিত্রগণের অভয়প্রদ মহাবীর সাত্যকিকে অর্জ্জুনের নিকট প্রেরণ করিয়াছি। পূৰ্ব্বে আমার মন কেবল অর্জ্জুনের নিমিত্তই ব্যাকুল ছিল, কিন্তু এক্ষণে অর্জ্জুন ও সাত্যকি এই উভয়ের জন্যই ব্যাকুলিত হইতেছে। আমি সাত্যকিকে অর্জ্জুনের নিকট প্রেরণ করিয়া এক্ষণে তাঁহার পদানুসরণে কাহাকে প্রেরণ করিব? যদি আমি সাত্যকির অনুসন্ধান না করিয়া যত্নসহকারে ভ্রাতা অর্জ্জুনের অন্বেষণ করি, তাহা হইলে লোকে আমাকে এই বলিয়া নিন্দা করিবে যে, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সাত্যকিকে পরিত্যাগ করিয়া ভ্রাতার অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলেন। অতএব এক্ষণে আমি এই লোকাপবাদপরিহারের নিমিত্ত মহাবীর বৃকোদরকে সাত্যকির নিকট প্রেরণ করি। অরিনিসূদন অর্জ্জুনের প্রতি আমার যেরূপ প্রীতি আছে, বৃষ্ণিপ্রবীর সাত্যকির প্রতিও তদ্রূপ। আমি তাঁহাকে অতি গুরুতর ভারবহনে নিয়োগ করিয়াছি। তিনিও মিত্রের উপরোধেই হউক বা গৌরবলাভের অভিলাষেই হউক, সাগরমধ্যগামী মকরের ন্যায় কৌরবসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন। ঐ সাত্যকির সহিত সমরে প্রবৃত্ত অপরাঙ্মুখ বীরগণের তুমুল কোলাহল শ্রুতিগোচর হইতেছে। অতএব এক্ষণে অবসরোচিত কার্য্য অবধারণপূর্ব্বক অর্জ্জুন ও সাত্যকির নিকট ভীমসেনকে প্রেরণ করাই আমার কৰ্ত্তব্য। এই ভূলে ভীমের অসাধ্য কিছুই নাই। সে একাকী স্বীয় বাহুবলে পৃথিবীর সমুদয় বীরগণের সহিত সংগ্রাম করিতে পারে। আমরা তাহার ভুজবীর্য্যপ্রভাবে বনবাস হইতে প্রতিনিবৃত্ত ও সমরে অপরাজিত হইয়াছি। অতএব ঐ মহাবীর অর্জ্জুন ও সাত্যকির নিকট গমন করিলে তাহারা অবশ্যই সহায়সম্পন্ন হইবে। সাত্যকি ও অর্জ্জুন সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ; বিশেষতঃ বাসুদেব স্বয়ং তাহাদিগকে রক্ষা করিতেছেন। তাহাদের নিমিত্ত চিন্তা করা একান্ত অনুচিত; কিন্তু আমার মন নিতান্ত উৎকণ্ঠিত হইয়াছে। এক্ষণে স্বীয় উৎকণ্ঠা দূর করাও আমার অবশ্যকর্ত্তব্য; অতএব আমি ভীমসেনকে সাত্যকির পদানুসরণে প্রেরণ করি; তাহা হইলে সাত্যকির প্রতীকারবিধান করা যাইবে।

“ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির মনে মনে এইরূপ অবধারণ করিয়া সারথিকে কহিলেন, ‘হে সারথে! তুমি আমাকে ভীমের রথাভিমুখে লইয়া চল।’ অশ্ববিদ্যাকোবিদ সারথি ধর্ম্মরাজের বাক্য শ্রবণ করিয়া ভীমের সমীপে তাঁহার সুবর্ণখচিত রথ সমানীত করিল। যুধিষ্ঠির ভীমের সন্নিকৃষ্ট হইয়া, প্রকৃত অবসর বিবেচনা করিয়া তাহাকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ভীম! যে স্ত্রীর একমাত্র রথে আরোহণপূর্ব্বক দেব, গন্ধৰ্ব্ব ও দৈত্যগণকে পরাজয় করিয়াছিল, আমি তোমার সেই অনুজ অর্জ্জুনের ধ্বজদণ্ড নিরীক্ষণ করিতেছি না।’ ধর্ম্মরাজ ভীমকে এই কথা বলিয়া শোকে নিতান্ত কাতর হইয়া মোহাবিষ্ট হইলেন। মহাবীর ভীম ধর্ম্মরাজকে একান্ত মোহাবিষ্ট অবলোকন করিয়া কহিলেন, ‘হে ধর্ম্মরাজ। আমি আপনার এরূপ মোহ কদাচ দর্শন ও শ্রবণ করি নাই। পূর্ব্বে আমরা দুঃখে অতিশয় কাতর হইলে আপনিই আমাদিগকে প্রবোধ দিতেন। অতএব হে রাজেন্দ্র! এক্ষণে আপনি শোক পরিত্যাগপূর্ব্বক উত্থিত হউন এবং আজ্ঞা করুন, আমি কি করে অনুষ্ঠান করিব? এই ভূমণ্ডলে আমার অসাধ্য কিছুই নাই। অনন্তর ধর্ম্মরাজ ভীমের বাক্য শ্রবণ করিয়া কৃষ্ণসর্পের ন্যায় দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক অপূৰ্ণলোচনে ম্লানবদনে কহিতে লাগিলেন, ‘হে ভীম! যখন রোষাবিষ্ট বাসুদেবের মুখমারতে পূরিত পাঞ্চজন্যশঙ্খের নির্ঘোষ শ্রুতিগোচর হইতেছে, তখন আজ নিশ্চয়ই তোমার অনুজ অর্জ্জুন নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে শয়ান করিয়াছে এবং বাসুদেব অর্জ্জুনকে বিনষ্ট দেখিয়া স্বয়ং যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। হে বৃকোদর! পাণ্ডবগণ যে মহাবীরের বলবীৰ্য্য আশ্রয় করিয়া জীবিত রহিয়াছে, যে মহাবীর বিপদ্‌কালে আমাদের প্রধান অবলম্বন, সেই মহাবলপরাক্রান্ত, মত্তমাতঙ্গবিক্রম, প্রিয়দর্শন অর্জ্জুন জয়দ্রথবধার্থ অনেকক্ষণ কৌরবসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছে, এখনও প্রত্যাগত হইতেছে না; এই আমার শোকের মূল কারণ। মহাবীর ধনঞ্জয় ও সাত্যকির নিমিত্ত আমার শোক ঘৃতপরিবর্দ্ধিত হুতাশনের ন্যায় বারংবার উদ্দীপিত হইতেছে। আমি অর্জ্জুনের বানরলাঞ্ছিত ধ্বজ দর্শন করিতেছি না বলিয়া মোহে অভিভূত হইতেছি। নিশ্চয় বোধ হইতেছে, সমরবিশারদ বাসুদেব অর্জ্জুনকে নিহত দেখিয়া স্বয়ং যুদ্ধ করিতেছেন। মহারথ সাত্যকি অর্জ্জুনের অনুগমন করিয়াছেন। আমি তাঁহার অদর্শনেও বিমোহিত হইতেছি। হে কৌন্তেয়! আমি তোমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা; যদি আমার বাক্য প্রতিপালন করা তোমার কর্ত্তব্য বলিয়া বিবেচনা হয়, তাহা হইলে যে স্থানে ধনঞ্জয় ও সাত্যকি রহিয়াছে, তুমি সেইস্থানে গমন কর। তুমি সাত্যকিকে অর্জ্জুন অপেক্ষাও স্নেহাস্পদ বিবেচনা করিবে। সেই মহাবীর আমার প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত নিতান্ত দুর্গম, সামান্য লোকের অগম্য, একান্ত ভয়ঙ্কর স্থানে সব্যসাচীর নিকট গমন করিয়াছে। হে বীর! এক্ষণে তুমি শীঘ্র গমন কর; কৃষ্ণ, অর্জ্জুন ও সাত্যকিকে নিরাপদ দেখিলে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক আমাকে সঙ্কেত করিও।’ ”