১৩০. দ্রোণসমীপে দুৰ্য্যোধনের জয়োপায় প্রার্থনা

১৩০তম অধ্যায়

দ্রোণসমীপে দুৰ্য্যোধনের জয়োপায় প্রার্থনা

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে সেই সমস্ত সেনা নিপাতিত এবং অর্জ্জুন, সাত্যকি ও ভীমসেন সিন্ধুরাজের প্রতি ধাবমান হইলে আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন কৰ্ত্তব্যবিষয়ে বহুবিধ চিন্তা করিয়া অবিলম্বে দ্রোণনিকটে গমন করিতে লাগিলেন। তাহার রথ মন ও পবনের ন্যায় মহাবেগে দ্রোণসমীপে উত্তীর্ণ হইল। তখন কুরুরাজ রোষে লোহিতলোচন হইয়া দ্রোণাচাৰ্য্যকে কহিলেন, ‘হে গুরো! মহাবীর অর্জ্জুন, ভীমসেন ও সাত্যকি এবং পাণ্ডবপক্ষীয় অনেক মহারথ সংগ্রামে অপরাজিত হইয়া জয়দ্রথের সমীপে গমন করিয়াছে এবং তথায় আমাদিগের প্রভূত সেনা পরাভূত করিয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিতেছে। হে মহাত্মন্! আপনি কিরূপে সাত্যকি ও ভীমসেনের নিকটি পরাভূত হইলেন? ইহলোকে আপনার ঈদৃশ পরাজয় সমুদ্রশোষণের ন্যায় নিতান্ত বিস্ময়কর হইয়াছে। লোকে সাত্যকি, অর্জ্জুন ও ভীমের হস্তে আপনার পরাজয় হইয়াছে শ্রবণ করিয়া আপনাকে যথোচিত নিন্দা করিতেছে। ধনুৰ্ব্বেদপরায়ণ দ্রোণাচার্য্য কিরূপে সমরে পরাজিত হইলেন বলিয়া আপনার উপর অশ্রদ্ধাপ্রদর্শনে প্রবৃত্ত হইয়াছে। আমি অতিশয় মন্দভাগ্য। যখন তিনজন মহারথ আপনাকে অতিক্রমপূর্ব্বক গমন করিয়াছে, তখন এই সমরে আমার অবশ্যই মৃত্যু হইবে। যাহা হউক, যাহা হইয়াছে, তাহার নিমিত্ত আর অনুতাপের প্রয়োজন নাই। এক্ষণে সিন্ধুরাজের রক্ষাৰ্থ সময়োচিত উপায় উদ্ভাবনপূর্ব্বক তদনুরূপ কাৰ্য্য করুন।’

দুর্য্যোধনের প্রতি সতিরস্কার উপায় কথন

“দ্রোণাচাৰ্য্য কহিলেন, “হে মহারাজ! আমি অনেক চিন্তা করিয়া যেরূপ কৰ্ত্তব্য অবধারণ করিয়াছি, তাহা শ্রবণ কর। পাণ্ডবপক্ষীয় তিন মহারথ সম্প্রতি অতিক্রান্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের নিমিত্ত পশ্চাদ্বর্ত্তী প্রদেশে যেরূপ ভয় হইবার সম্ভাবনা, অন্যান্য যোধগণের নিমিত্ত অগ্রবর্তী প্রদেশেও তদ্রূপ ভয়ের সম্ভাবনা আছে; কিন্তু যেখানে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন রহিয়াছেন, তথায় অধিক ভয়ের আশঙ্কা হইতেছে। যাহা হউক, অর্জ্জুনের হস্ত হইতে সিন্ধুরাজের রক্ষা করা আমার সর্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। সাত্যকি এবং বৃকোদর সিন্ধুরাজের প্রতি গমন করিয়াছেন, অতএব তাঁহার রক্ষাৰ্থ বিশেষ যত্ন করা আমাদের নিতান্ত আবশ্যক। হে মহারাজ! তুমি পূর্ব্বে শকুনির বুদ্ধি শুনিয়া যে দূতক্রীড়া করিয়াছিলে, এক্ষণে তাহার পরিণাম উপস্থিত হইয়াছে। তৎকালে সেই সভায় জয় অথবা পরাজয় হয় নাই; এক্ষণে আমরা এই যুদ্ধরূপ ক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হইয়াছি, ইহার ত’ জয় অথবা পরাজয় লাভ হইবে? শকুনি কুরুসভায় অসংখ্য কৌরবগণের সমক্ষে পূর্ব্বে যেসকল অক্ষ লইয়া ক্রীড়া করিয়াছিল, সেই সমস্ত অক্ষ এক্ষণে তোমাদিগের তনুচ্ছিদ দুরাসদ শররূপে পরিণত হইয়াছে। এক্ষণে সেনাগণকে দুরোদর, শরসমুদয়কে অক্ষ এবং জয়দ্রথকে পণস্বরূপ জ্ঞান কর। অদ্য সিন্ধুরাজকে পণ রাখিয়া শত্রুগণের সহিত আমাদের দূতক্রীড়া হইতেছে; অতএব প্রাণপণে সৰ্ব্বতোভাবে জয়দ্রথকে রক্ষা করিতে যত্ন করা তোমাদের নিতান্ত আবশ্যক। সিন্ধুরাজের জীবনরক্ষা ও প্রাণনাশ আমাদের জয় ও পরাজয়ের কারণ। অতএব যেখানে ধনুর্ধারী বীরগণ জয়দ্রথের রক্ষার নিমিত্ত নিযুক্ত রহিয়াছেন, তুমি অবিলম্বে তথায় গমনপূর্ব্বক সেই রক্ষকগণকে রক্ষা কর। আমি এইস্থানে থাকিয়া অপরাপর সৈন্যগণকে প্রেরণ এবং পাণ্ডবসৃঞ্জয়সমবেত পাঞ্চালগণকে নিবারণ করিব।

ব্যূহপথে দুৰ্য্যোধনসহ যুধামন্যুপ্রমুখের যুদ্ধ

“অনন্তর দুৰ্য্যোধন আচার্য্যের বাক্যানুসারে উগ্রকর্ম্মসম্পাদনে সমুদ্যত হইয়া পদানুগসমভিব্যাহারে মহাবেগে প্রস্থান করিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবপক্ষীয় চক্ররক্ষক পাঞ্চালদেশীয় যুধামন্যু ও উত্তমৌজা সেনাগণের পার্শ্ব দিয়া অর্জ্জুনের নিকট গমন করিতেছিলেন। হে মহারাজ! পূর্ব্বে মহাবীর ধনঞ্জয় কৌরবসৈন্যগণের সহিত যুদ্ধ করিবার মানসে তাহাদের মধ্যে প্রবিষ্ট হইলে ঐ চক্ররক্ষকদ্বয় তাঁহার অনুগমনের চেষ্টা করিয়াছিলেন; তৎকালে মহাবীর কৃতবর্ম্মা উহাদিগকে নিবারিত করেন। এক্ষণে কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন ঐ দুইজনকে সেনাগণের পার্শ্ব দিয়া অর্জ্জুনের সমীপে গমনোদ্যত অবলোকন করিয়া সত্বর তাঁহার সহিত তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। ক্ষত্রিয়প্রধান প্রসিদ্ধ মহারথ সেই বীরদ্বয়ও তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন যুধামন কঙ্কপত্রালঙ্কৃত ত্রিংশৎশরে দুৰ্য্যোধনকে, বিংশতিশরে তাঁহার সারথিকে ও চারিশরে তাঁহার চারি অশ্বকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর দুৰ্য্যোধন যুধামন্যুর শরাঘাতে ক্রুদ্ধ হইয়া একবাণে তাঁহার ধ্বজ ও একবাণে ধনু ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে ভল্লদ্বারা সারথিকে রথ হইতে নিপাতিত করিয়া নিশিতশরচতুষ্টয়ে অশ্বচতুষ্টয় বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর যুধামন্যু সরোষনয়নে দুর্য্যোধনের বক্ষঃস্থল লক্ষ্য করিয়া সত্বর ত্রিংশৎ শর পরিত্যাগপূর্ব্বক গর্জ্জন করিতে লাগিলেন; উত্তমৌজাও রোষিত হইয়া হেমবিভূষিত শরনিকরে কুরুরাজের সারথিকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। তখন দুৰ্য্যোধন উত্তমৌজার পাষ্ণিসারথি ও অশ্বচতুষ্টয় সংহার করিলেন। মহাবীর উত্তমৌজা এইরূপে হতাশ ও হতসারথি হইয়া অবিলম্বে ভ্রাতা যুধামন্যুর রথে আরোহণপূর্ব্বক শরজালে দুৰ্য্যোধনের অশ্বগণকে তাড়িত করিতে লাগিলেন। অশ্বগণ উত্তমৌজার শরে তাড়িত হইয়া অবিলম্বে ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। ঐ সময় যুধামন্যু উৎকৃষ্ট শর পরিত্যাগপূর্ব্বক কুরুরাজের তূণীর ও শরাসন ছেদন করিলেন। তখন মহাবীর দুর্য্যোধন সেই অশ্বসারথিবিবর্জিত রথ হইতে অবরোহণ করিয়া গদা গ্রহণপূর্ব্বক পাঞ্চালদেশীয় বীরদ্বয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। তাঁহারা অরাতিজেতা ক্রুদ্ধ কুরুরাজকে আগমন করিতে দেখিয়া অবিলম্বে রথ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। তখন দুৰ্য্যোধন গদাপ্রহারে তাঁহাদিগের সেই হেমমণ্ডিত রথ, অশ্ব, সারথি ও ধ্বজের সহিত প্রোথিত করিয়া অবিলম্বে মদ্ররাজরথে আরোহণ করিলেন। পাঞ্চালদেশীয় রাজপুত্রদ্বয়ও অন্য দুই রথে আরূঢ় হইয়া অর্জ্জুনের নিকট গমন করিতে লাগিলেন।”