১৪৬. অর্জ্জুনের ভীষণ কৌরবাক্ৰমণ

১৪৬তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের ভীষণ কৌরবাক্ৰমণ

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় কার্মুক আকর্ষণ করিলে আপনার পক্ষীয় সৈন্যগণ অন্তকের সুস্পষ্ট উৎক্রোশশব্দ [গ্রাসার্থ উচ্চরবে আহ্বান] সদৃশ, দেবরাজের অতি গভীর অশনিনির্ঘোষতুল্য টঙ্কারধ্বনি শ্রবণ করিয়া যুগান্তবাতাহত উত্তালতরঙ্গমালাসঙ্কুল, মীনমকরসমাকীর্ণ সমুদ্রজলের ন্যায় অতিশয় উদ্ভ্রান্ত হইয়া নিতান্ত উদ্বিগ্ন হইল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় এককালে দশদিকে বিচিত্র অস্ত্রজাল বিস্তারপূর্ব্বক ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে লাগিলেন। তিনি যে কখন শরগ্রহণ, কখন শরসন্ধান, কখন শরাকর্ষণ আর কখনই বা শর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন, তাহার হস্তলাঘবপ্রযুক্ত তাহা কিছুতেই লক্ষিত হইল না। অনন্তর তিনি নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কৌরবসৈন্যগণের ত্রাসোৎপাদনপূর্ব্বক দুরাসন [অনিবার্য্য] ঐন্দ্ৰাস্ত্র প্রয়োগ করিলেন। সেই অস্ত্রের প্রভাবে অসংখ্য অগ্নিমুখ সুপ্রদীপ্ত দিব্যাস্ত্র প্রাদুর্ভূত হইতে লাগিল। ঐ সমুদয় সূর্যাগ্নিসন্নিভ অস্ত্র অন্তরীক্ষে সমুখিত হওয়াতে আকাশমণ্ডল অসংখ্য মহোল্কাপরিবৃতের ন্যায় দুর্নিরীক্ষা হইয়া উঠিল। হে মহারাজ! কৌরবেরা ইতিপূর্ব্বে বহু সহস্র সায়ক নিক্ষেপপূর্ব্বক রণস্থলে যে গাঢ় অন্ধকার সমুৎপাদিত করিয়াছিলেন, অন্যান্য বীরগণ মনেও উহা নিবারণ করিবার কল্পনা করিতে সমর্থ নহেন, কিন্তু দিবাকর যেমন প্রাতঃকালে স্বীয় করজালদ্বারা গাঢ় অন্ধকার বিনাশ করেন, তদ্রূপ মহাবীর ধনঞ্জয় পরাক্রম প্ৰকাশপূর্ব্বক মন্ত্রপূত দিব্যাস্ত্রপ্রভাবে সেই শরান্ধকার অনায়াসে দূরীভূত করিলেন এবং নিদাঘসূৰ্য্য যেমন করজালদ্বারা পল্বল-সলিল বিনাশ করেন, তদ্রূপ শরসকলদ্বারা কৌরবসৈন্যগণকে নিধন করিতে লাগিলেন। সূর্য্যকিরণ যেমন ধরাতলে নিপতিত হয়, তদ্রূপ অর্জ্জুনবিসৃষ্ট শসমুদয় কৌরবপক্ষীয় বীরগণের উপর নিপতিত হইয়া প্রিয়সুহৃদের ন্যায় তাহাদের হৃদয়ে প্রবেশ করিল। ফলতঃ তৎকালে যে যে শরাভিমানী যোদ্ধা ধনঞ্জয়সমীপে গমন করিলেন, তৎসমুদয়কেই তাঁহার শরানলে পতঙ্গবৃত্তি লাভ করিতে হইল।

“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন অরাতিগণের জীবন ও কীৰ্ত্তি বিলোপ করিয়া মূর্ত্তিমান্ মৃত্যুর ন্যায় রণস্থলে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তিনি কাহারও কিরীটমণ্ডিত মস্তক, কাহারও অঙ্গদযুক্ত বিপুলভুজ এবং কাহারও বা কুণ্ডলালঙ্কৃত কর্ণ ছেদন করিয়া সাদিগণের প্রাসযুক্ত, নিষাদিগণের তোমরযুক্ত, পদাতিগণের চর্ম্মযুক্ত, রথীগণের কার্মুকযুক্ত ও সারথিগণের প্রতোদযুক্ত বাহুসমুদয় খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন এবং দীপ্ত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক স্ফুলিঙ্গযুক্ত প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় শোভমান হইলেন। ঐ দেবরাজপ্রতিম সৰ্ব্বশাস্ত্রবিশারদ মহাবীর রথারোহণে একেবারে চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিয়া কখন মহাস্ত্রনিক্ষেপ, কখন রথমার্গে নৃত্য, কখন জ্যাশব্দ, বা তলধ্বনি করিতে লাগিলেন। অন্যান্য নরপতিরা যত্নবান হইয়াও মধ্যাহ্নকালীন সুর্যের ন্যায় ঐ প্রতাপশালী বীরকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইলেন না। তিনি সশর শরাসন ধারণ করিয়া বারিধারাবর্ষী ইন্দ্রায়ুধসমাযুক্ত বর্ষাকালীন জলধরের ন্যায় বিরাজমান হইলেন।

“এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন নিতান্ত দুস্তর ভয়ঙ্কর অস্ত্রজাল বিস্তার করিলে কাহার মস্তক ছিন্ন, কাহার বাহু নিকৃত্ত, কাহার ভুজদণ্ড পাণিশূন্য এবং কাহারও বা পাণিতল অঙ্গুলিবিযুক্ত হইয়া গেল; মদমত্ত মাতঙ্গগণের দন্ত ও শুণ্ড খণ্ড খণ্ড হইল; অশ্বসকল ছিন্নগ্রীব ও রথসমূহ চূর্ণ হইতে লাগিল এবং যোদ্ধৃগণ কেহ ছিন্নাস্ত্র, কেহ ছিন্নপাদ ও কেহ কেহ ভগ্নসন্ধি হইয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িল। হে মহারাজ! ঐ সময়ে সমরভূমি মৃত্যুর আবাসস্থানের ন্যায় ও পশুঘাতে রুদ্রের আক্রীড় ভূমির ন্যায় ভীরুজনের নিতান্ত ভয়াবহ হইল। মাতঙ্গগণের খণ্ডিত শুণ্ডসমুদয় ইতস্ততঃ নিক্ষিপ্ত থাকাতে রণস্থল ভুজগকূলে সমাকুল বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। অসংখ্য মস্তক সমন্তাৎ বিকীর্ণ হওয়াতে বোধ হইল যেন, রণভূমি পদ্মমাল্যে বিভূষিত হইয়াছে। চতুর্দ্দিকে রাশি রাশি বিচিত্র উষ্ণীষ, মুকুট, কেয়ূর, অঙ্গদ, কুণ্ডল, সুবর্ণবর্ম্ম, হস্তী ও অশ্বগণের অলঙ্কার এবং শত শত কিরীট নিপতিত থাকাতে সমরভূমি নববধূর ন্যায় শোভা ধারণ করিল।

“হে মহারাজ! ঐ সময় সমরাঙ্গনে ভীষণ বৈতরণীনদীর ন্যায় ভীরুগণের ভয়াবহ এক অগাধ বিচিত্র ধ্বজপতাকাপরিশোভিত শোণিতনদী প্রবাহিত হইল। মজ্জা ও মেদ উহার কম; কেশনিচয় শাদ্বল ও শৈবাল; মস্তক ও বাহুসকল তটস্থিত পাষাণখণ্ড; ছত্র এবং চাপসমূহ তরঙ্গ; রথসমুদয় ভেলা; অশ্বসকল তীরভূমি; কাক ও কঙ্কসমুদয় মহান; গোমায়ুসকল মকর এবং গৃধ্রুকুল উহার গ্রাহসমূহের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। ঐ নদীর মধ্যে অসংখ্য নরকলেবর, গজদেহ, গ্রীবা, অস্থি, রথ, চক্র, যুগ, ঈষা, অক্ষ, কূবর, ভুজগাকার প্রাস, শক্তি, অসি, পরশু ও বিশিখসকল বিকীর্ণ থাকাতে উহা নিতান্ত দুর্গম হইয়া উঠিল। উহার উভয় কূলে শিবাগণ অতি ভীষণ রব এবং অসংখ্য ভূত, প্রেত ও পিশাচগণ নৃত্য করিতে আরম্ভ করিল। গতাসু যোধগণের স্পন্দনহীন শত শত দেহ উহার স্রোতে প্রবাহিত হইতে লাগিল।

“মহারাজ! মূর্ত্তিমান্ অন্তকের ন্যায় অর্জ্জুনের এইরূপ অদ্ভুত বিক্রমদর্শনে কৌরবগণের মনে অভূতপূর্ব্ব ভয়ের সঞ্চার হইল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় স্বীয় অস্ত্রদ্বারা বীরগণের অস্ত্রসমুদয় ছেদনপূর্ব্বক অতি রৌদ্র কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া আপনাকে রৌদ্রকর্ম্মা বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে লাগিলেন। তিনি রথীগণকে অতিক্রম করিলে কোন বীরই মধ্যাহ্নকালীন প্রচণ্ড মাত্তণ্ডের ন্যায় তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইল না। তাহার গাণ্ডীব ধনু হইতে শরসমূহ নির্গত হইলে আকাশমণ্ডল বকপংক্তি পরিশোভিত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। এইরূপে সিন্ধুরাজবধার্থী কৃষ্ণসারথি অর্জ্জুন নারাচ নিক্ষেপপূর্ব্বক সমস্ত রথীদিগকে মুগ্ধ করিয়া চতুর্দ্দিকে শরবর্ষণপূর্ব্বক দ্রুতবেগে সমরাঙ্গনে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার শরাসনবিমুক্ত শরনিকর যেন অন্তরীক্ষে ভ্রমণ করিতে লাগিল। ঐ সময় তিনি যে কখন কার্মুক গ্রহণ, কখন শরসন্ধান আর কখনই বা শর নিক্ষেপ করিলেন, তাহা কিছুই লক্ষিত হইল না।

অর্জ্জুনের জয়দ্রথ-অনুসন্ধান—যুদ্ধ

“মহাবীর অর্জ্জুন এইরূপ শরনিকরে দিঙ্মণ্ডল সমাচ্ছন্ন ও সমস্ত রথীদিগকে একান্ত ব্যাকুলিত করিয়া জয়দ্রথের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহাকে চতুঃষষ্টিশরে বিদ্ধ করিলেন। কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধৃগণ ধনঞ্জয়কে সৈন্ধবাভিমুখে সমুপস্থিত দেখিয়া জয়দ্রথের জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক সমরে নিবৃত্ত হইতে লাগিলেন। হে মহারাজ! আপনার পক্ষীয় যেসমস্ত মহাবীর অর্জ্জুনের সম্মুখীন হইয়াছিলেন, অর্জ্জুননির্মুক্ত শরনিকর তাঁহাদের উপর নিপতিত হইয়া প্রাণসংহার করিল। মহাবীর অর্জ্জুন এইরূপে অনলসঙ্কাশ শরজালদ্বারা আপনার সেই চতুরঙ্গ বল একান্ত ব্যাকুলিত ও সমরাঙ্গন কবন্ধসমাকুল করিয়া জয়দ্রথের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং অশ্বত্থামাকে পঞ্চাশৎ, কর্ণকে দ্বাত্রিংশৎ, কৃপাচার্য্যকে নয়, শল্যকে যোড়শ ও সিন্ধুরাজকে চতুঃষষ্টিশরে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। সিন্ধুরাজ ধনঞ্জয়শরাঘাতে অঙ্কুশাহত মাতঙ্গের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার বিক্রম কিছুতেই সহ্য করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন তিনি ধনঞ্জয়ের রথ লক্ষ্য করিয়া অবিলম্বে আশীবিষসদৃশ কৰ্ম্মারপরিমার্জিত কঙ্কপত্রালঙ্কৃত শরনিকর আকর্ণ সন্ধানপূর্ব্বক পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তৎপরে বাসুদেবকে তিন ও ধনঞ্জয়কে ছয়নারাচে বিদ্ধ করিয়া আটশরে তাঁহার অশ্ব ও এক শরে ধ্বজদণ্ড বিদ্ধ করিলেন। অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন সৈন্ধবপ্রেরিত সুতীক্ষ্ণ শরনিকর নিরাস করিয়া শরযুগলদ্বারা যুগপৎ জয়দ্রথের সারথির মস্তক ও সুসজ্জিত অগ্নিশিখাসদৃশ বরাহধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন।

সূৰ্য্যাবরণের জন্য কৃষ্ণের যোগমায়াবিস্তার

“ঐ সময় বাসুদেব দিবাকরকে অতি সত্বর অস্তাচলশিখরে আরোহণ করিতে দেখিয়া অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, হে ধনঞ্জয়! ঐ দেখ, মহাবলপরাক্রান্ত ছয়জন মহারথ জয়দ্রথকে মধ্যস্থলে সংস্থাপনপূর্ব্বক অবস্থান করিতেছেন; জয়দ্রথও প্রাণরক্ষাৰ্থ নিতান্ত ভীত হইয়াছে। তুমি ঐ ছয়রথীকে পরাজয় না করিয়া প্রাণপণে যত্ন করিলেও জয়দ্রথকে সংহার করিতে সমর্থ হইবে না। অতএব আমি সূৰ্য্যকে আবরণ করিবার নিমিত্ত যোগমায়া প্রকাশ করিব; তাহার প্রভাবে দুরাত্মা সিন্ধু রাজ দিবাকরকে অস্তগত নিরীক্ষণপূর্ব্বক আপনার জীবনলাভ ও তোমার বধসাধন হইল বিবেচনা করিয়া হর্ষভরে কদাচ আত্মগোপন করিবে না। সেই সুযোগে তুমি উহাকে অনায়াসে বিনাশ করিতে সমর্থ হইবে; কিন্তু তৎকালে সূর্য্যদেব অস্তগত হইলেন মনে করিয়া তুমি সৈন্ধবসংহারে কদাচ উপেক্ষা প্রদর্শন করিও না।’ তখন অর্জ্জুন তাহাই হইবে বলিয়া তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণের বাক্য স্বীকার করিলেন।

“অনন্তর মহাত্মা কৃষ্ণ যোগমায়াপ্রভাবে অন্ধকার সৃষ্টি করিলেন। দিবাকর তিরোহিত হইল। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ অর্জ্জুনবিনাশার্থ সাতিশয় হর্ষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। সূর্যের অদর্শনে সৈনিকপুরুষগণের আনন্দের আর পরিসীমা রহিল না। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ আনন উন্নমিত করিয়া দিবাকরের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন বাসুদেব পুনরায় অর্জ্জুনকে কহিলেন, “হে অর্জ্জুন! ঐ দেখ, জয়দ্রথ নিঃশঙ্কচিত্তে দিবাকরের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছে, উহাকে সংহার করিবার এই উপযুক্ত অবসর। অতএব তুমি অবিলম্বে উহার মস্তকচ্ছেদন করিয়া আপনার প্রতিজ্ঞা সফল কর।

অর্জ্জুনের জয়দ্ৰথরক্ষক কৃপাদির আক্রমণ

“মহাত্মা কেশব এইরূপ কহিলে প্রবলপ্রতাপ অর্জ্জুন সূৰ্য্য ও অনলসদৃশ শরনিকরে কৌরবসৈন্যগণকে বিনাশ করিয়া কৃপাচার্য্যকে বিংশতি, কর্ণকে পঞ্চাশৎ, শল্যকে ছয়, দুৰ্য্যোধনকে ছয়, বৃষসেনকে আট, সিন্ধুরাজকে ষষ্টি এবং অন্যান্য কৌরবসৈন্যদিগকে অসংখ্যশরে বিদ্ধ করিয়া মহাবীর জয়দ্রথের প্রতি ধাবমান হইলেন। জয়দ্ৰথরক্ষক বীরগণ প্রজ্বলিত পাবকসদৃশ অর্জ্জুনকে অভিমুখে উপস্থিত দেখিয়া অত্যন্ত সংশয়ারূঢ় হইলেন এবং জয়লাভার্থ তাহার উপর শরধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন জয়শীল মহাবাহু অর্জ্জুন অরাতিগণের শরজালে সমাচ্ছন্ন হইয়া রোষাবিষ্টমনে তাহাদের বিনাশবাসনায় অতি ভীষণ শরজাল বিস্তার করিলেন। কৌরবপক্ষীয় সৈন্যেরা অর্জ্জুনের শরনিকরে সমাহত হইয়া সিন্ধুরাজকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল; তক্কালে ভয়ে দুইজনে একত্র গমন করিতে সাহসী হইল না। মহারাজ! তখন আমরা সেই মহাযশস্বী অর্জ্জুনের কি অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিলাম! তিনি যেরূপ যুদ্ধ করিলেন, সেরূপ যুদ্ধ আর কুত্রাপি হয় নাই, হইবেও না। রুদ্র যেমন প্রাণীগণকে বিনাশ করেন, তদ্রূপ ধনঞ্জয় গজ ও গজারোহী, অশ্ব ও অশ্বারোহী এবং সারথিদিগকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। সেই সময়ে কোন হস্তী, অশ্ব বা মনুষ্যকে অর্জ্জুনশরে অনাহত অবলোকন করিলাম না। ঐ সময় সকলেই রজোরাশি ও অন্ধকারপ্রভাবে দৃষ্টিহীন হইয়া ঘোরতর মোহপ্রাপ্ত হইল। কেহ কাহাকে বিদিত হইতে সমর্থ হইল না। কালপ্রেরিত অসংখ্য সৈন্য অর্জ্জুনশরে মর্ম্মপীড়িত হইয়া কেহ ভ্রাম্যমাণ, কেহ স্খলিতপদ, কেহ পতিত, কেহ অবসন্ন এবং কেহ বা ম্লান হইতে লাগিল। হে মহারাজ! সেই প্রলয়কালসদৃশ মহাদুস্তর অতি ভীষণ সংগ্রামসময়ে ধরাতল রুধিরসিক্ত এবং বায়ু প্রবলবেগে প্রবাহিত হইলে পার্থিব রজোরাশি নিরাকৃত হইয়া গেল। রথচক্ৰসকল নাভিদেশ পর্য্যন্ত রুধিরে নিমগ্ন হইলে আরোহিবিহীন বেগবান্ কুঞ্জর ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ ও রুধিরনিমগ্ন হইয়া আর্ত্তনাদ করিয়া স্বপক্ষীয় বল মর্দ্দনপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল। সাদিবিহীন অশ্বগণ এবং পদাতিসমুদয় অনশরে সমাহত হইয়া প্রাণভয়ে ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। বীরগণ বর্মুবিহীন হইয়া ভয়ে সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক মুক্তকেশে, রুধিরাক্তগাত্রে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ গাঢ় আঘাতে বিনষ্ট হইয়া সমরভূমিতে নিপতিত রহিল এবং অনেকে নিহত হস্তীসমুদয়মধ্যে বিলীন হইয়া প্রাণরক্ষা করিল।

জয়দ্রথের শিরচ্ছেদে কৃষ্ণের সতর্কীকরণ

“হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় এইরূপে কৌরবসৈন্য বিদ্রাবিত করিয়া সিন্ধুরাজের রক্ষক কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য্য, শল্য, বৃষসেন এবং দুৰ্য্যোধনকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তিনি লঘুহস্ততাযুক্ত যে কখন শরগ্রহণ, কখন শরসন্ধান আর কখনই বা শরনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন, তাহা কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না; কেবল তাঁহার মণ্ডলাকার কার্মুক ও সমন্তাৎ সমাকীর্ণ শরজালই আমাদের নেত্রপথে পতিত হইল। অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন অবিলম্বে কর্ণ ও বৃষসেনের শরাসন ছেদনপূর্ব্বক ভল্লাস্ত্রদ্বারা শল্যের সারথিকে রথ হইতে নিপাতিত করিয়া অসংখ্য শরনিপাতে অশ্বত্থামা ও কৃপাচাৰ্য্যকে গাঢ়তর বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন কৌরবপক্ষীয় মহারথগণকে একান্ত ব্যাকুলিত করিয়া অনলসন্নিভ, অশনিসম, দিব্যমন্ত্রপূত, নিরন্তর গন্ধমাল্যে অর্চিত, এক ভয়ঙ্কর শর তূণীর হইতে উদ্ধার করিয়া বিধিপূর্ব্বক বজ্রাস্ত্রের সহিত সংযোজিত করিয়া সত্বর গাণ্ডীবশাসনে সন্ধান করিলেন। নভোমণ্ডলস্থ প্রাণীগণ তদ্দর্শনে মহানাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। তখন বাসুদেব পুনরায় সত্বর ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! দিবাকর অস্তাচলশিখরে আরোহণ করিতেছেন; অতএব তুমি শীঘ্র দুরাত্মা সিন্ধুরাজের শিরচ্ছেদন কর; কিন্তু আমি সিন্ধুরাজবধবিষয়ে এই উপদেশ প্রদান করিতেছি, তুমি অবহিত হইয়া শ্রবণ কর।’

জয়দ্রথের প্রতি বৃদ্ধক্ষত্রের বরপ্রয়োগবৃত্তান্ত

জয়দ্রথের পিতা ত্রিলোকবিশ্রুত মহারাজ বৃদ্ধক্ষত্র বহুকালের পর জয়দ্রথকে লাভ করেন। জয়দ্রথের জন্মকালে এই দৈববাণী তাঁহার পিতার কর্ণগোচর হইয়াছিল, ‘হে রাজন! তোমার আত্মজ এই জীবলোকে সূৰ্য্য ও চন্দ্রবংশীয়দিগের ন্যায় কুল, শীল ও ইন্দ্রিয়নিগ্রহ প্রভৃতি সদ্‌গুণে ভূষিত হইবেন এবং সকল বীরপুরুষেরাই প্রতিনিয়ত ইহার সৎকার করিবে; কিন্তু কোন এক ক্ষত্রিয়প্রধান সুপ্রসিদ্ধ শত্রু ক্রোধাবিষ্ট হইয়া যুদ্ধকালে ইহার শিরচ্ছেদন করিবেন।’ বৃদ্ধ সিন্ধুরাজ বৃদ্ধক্ষত্র এই দৈববাণী শ্রবণ করিবামাত্র পুত্রস্নেহে অতিমাত্র কাতর হইয়া বহুক্ষণ চিন্তা করিয়া জ্ঞাতিদিগকে কহিলেন, ‘যে ব্যক্তি ঘোরতর সংগ্রামকালে আমার এই একান্ত দুর্ভরভারবাহী পুত্রের মস্তক ধরণীতলে নিপাতিত করিবে, তাহার মস্তক তৎক্ষণাৎ শতধা বিদীর্ণ হইয়া ভূতলে নিপতিত হইবে, সন্দেহ নাই। মহারাজ বৃদ্ধক্ষত্র এই বলিয়া জয়দ্রথকে রাজ্যে অভিষেক করিয়া বনগমনপূর্ব্বক তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন। হে অর্জ্জুন! তিনি এক্ষণে এই কুরুক্ষেত্রের বহির্ভাগে স্যমন্তপঞ্চকনামক তীর্থে অতি কঠোর তপস্যা করিতেছেন; অতএব তুমি ভয়ঙ্কর দিব্যাস্ত্রপ্রভাবে জয়দ্রথের কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক ছেদন করিয়া অবিলম্বে তাঁহার অঙ্কে নিপাতিত কর। যদি তুমি স্বয়ং ইহার মস্তক ভূতলে নিক্ষেপ কর, তাহা হইলে নিঃসন্দেহ তোমারও মস্তক শতধা বিদীর্ণ হইয়া ভূতলে নিপতিত হইবে। হে ধনঞ্জয়! দিব্যাস্ত্রপ্রভাবে এরূপ অলক্ষিতভাবে জয়দ্রর মস্তক উহার পিতার অঙ্কে নিপাতিত করিবে, যেন তিনি কোনমতেই ঐ বিষয় বিদিত হইতে সমর্থ না হয়েন। হে অর্জ্জুন! এই ত্রিলোকমধ্যে তোমার অসাধ্য কিছুই নাই।

জয়দ্রথশিরচ্ছেদ বৃদ্ধক্ষনিধন

“মহাবীর অর্জ্জুন কৃষ্ণের এই কথা শ্রবণ করিয়া সৃক্কণীলেহনপূর্ব্বক সেই সৈন্ধববধার্থে কৃতসন্ধান ভীষণ শর পরিত্যাগ করিলেন। শ্যেনপক্ষী যেমন বৃক্ষাগ্র হইতে শকুন্তকে হরণ করিয়া থাকে, তদ্রুপ সেই গাণ্ডীবনির্মুক্ত অশনিসদৃশ শর জয়দ্রথের মস্তক হরণ করিল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় শত্রুগণের শোকোদ্দীপন ও মিত্রগণের হর্ষবর্দ্ধন করিবার নিমিত্ত ঐ ছিন্নমস্তক ধরাতলে নিপতিত না হইতে হইতেই শরনিকরদ্বারা পুনর্ব্বার উর্ধ্বে উত্থাপিত করিয়া স্যমন্তপঞ্চকের বহির্ভাগে উপনীত করিলেন। ঐ সময় মহারাজ বৃদ্ধক্ষত্র সন্ধ্যোপাসনা করিতেছিলেন। ধনঞ্জয় জয়দ্রথের সেই কুণ্ডলালঙ্কৃত ছিন্নমুণ্ড অলক্ষিতরূপে তাঁহার অঙ্কদেশে নিপাতিত করিলেন। মহারাজ বৃদ্ধক্ষত্র জপসমাপনান্তে আসন হইতে উত্থিত হইবামাত্র জয়দ্রথের সেই ছিন্নমস্তক ভূতলে নিপতিত হইল; তখন বৃদ্ধক্ষত্রের মস্তকও শতধা বিদীর্ণ হইয়া গেল। তদ্দর্শনে সকলেই অতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

জয়দ্রথবধান্তে সূর্যের পুনঃপ্রকাশে কৌরবক্রন্দন

“হে মহারাজ! এইরূপে অর্জ্জুনশরে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ নিহত হইলে মহাত্মা কৃষ্ণ অন্ধকার প্রতিসংহার করিলেন। তখন আপনার পুত্রগণ সেই বাসুদেবকৃত মায়াজালবিস্তারের বিষয় সম্যক অবগত হইলেন। হে রাজন্! আপনার জামাতা সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ এই প্রকারে আট-অক্ষৌহিণী সেনা বিনষ্ট করিয়া পরিশেষে অর্জ্জুনশরে কলেবর, পরিত্যাগ করিলেন। তদ্দর্শনে আপনার পুত্রগণের নেত্রযুগল হইতে শোকাবেগপ্রভাবে অনর্গল অশ্রুজল নিপতিত হইতে লাগিল। মহাবীর ধনঞ্জয় পাঞ্চজন্যশঙ্খ প্রধ্নাপিত করিতে আরম্ভ করিলেন। ভীমসেন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রতিবোধিত করিয়াই যেন সিংহনাদদ্বারা রোদসী প্রতিধ্বনিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। যুধিষ্ঠির সেই সিংহনাদবণে অর্জ্জুনশরে সিন্ধুরাজ নিহত হইয়াছেন অনুমান করিয়া বাদ্যধ্বনিদ্বারা স্বপক্ষীয় যোদ্ধাদিগকে আনন্দিত করিয়া সংগ্রাম করিবার বাসনায় দ্রোণের সহিত সমাগত হইলেন। ঐ সময় দিবাকর অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইলে সোমকদিগের সহিত দ্রোণাচার্য্যের লোমহর্ষণ ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। সোমকেরা ভারদ্বাজকে বিনাশ করিবার বাসনায় পরমপ্রযত্নসহকারে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ সিন্ধুরাজবধজনিত জয়লাভে উন্মত্তপ্রায় হইয়া দ্রোণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয়ও সিন্ধুরাজকে সংহার করিয়া আপনার পক্ষীয় মহারথগণের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন।”