১৪৮. অর্জ্জুনের কর্ণতিরস্কার-বৃষসেনবধ-প্রতিজ্ঞা

১৪৮তম অধ্যায়

অর্জ্জুনের কর্ণতিরস্কার-বৃষসেনবধ-প্রতিজ্ঞা

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমার এবং পাণ্ডবপক্ষীয় বীরপুরুষগণ রণস্থলে তদবস্থাপন্ন হইলে মহাবীর ভীম কি করিল, তদ্‌বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! রথবিহীন মহাবীর ভীমসেন কর্ণের বাক্যে অতিমাত্র কাতর হইয়া রোষাবিষ্টচিত্তে ধনঞ্জয়কে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভ্রাতঃ! কর্ণ তোমার সাক্ষাতেই আমাকে তুবরক, অদ্মর [ঔদরিক উদরসর্ব্বস্ব, পেটুক], অস্ত্রমূঢ় [অস্ত্রবিদ্যায় অনিপুণ] ও সংগ্রামকাতর বলিয়া বারংবার কটুক্তি প্রয়োগ করিয়াছে। আমি পুর্ব্বে তোমার সমক্ষে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, যে দুরাত্মা আমাকে ঐ প্রকার কটুক্তি করিবে, সে আমার বধ্য। হে পার্থ! তুমিও কর্ণবধের নিমিত্ত পূর্ব্বে প্রতিজ্ঞা করিয়াছ, অতএব এক্ষণে যাহাতে আমাদের উভয়ের সত্য প্রতিপালিত হয়, তাহার চেষ্টা কর।

“অমিতপরাক্রম মহাবীর অর্জ্জুন ভীমসেনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কর্ণের অভিমুখে গমনপূর্ব্বক তাহাকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে সূতপুত্র! তুমি নিতান্ত পাপাশয়, অদূরদর্শী ও আত্মশ্লাঘাপরায়ণ। যাহা হউক, আমি যাহা কহিতেছি, তাহাতে কর্ণপাত কর। যুদ্ধে বীরপুরুষগণের জয় ও পরাজয় এই উভয়ই হইয়া থাকে। রণস্থলে ইন্দ্রকেও কখন জয়শালী ও কখন পরাজিত হইতে হয়। তুমি মহাবীর সাত্যকিকর্ত্তৃক বিরথ, বিকলেন্দ্রিয় ও মৃতপ্রায় হইলে তিনি তোমাকে আমার বধ্য স্মরণ করিয়া জীবিতাবস্থায় পরিত্যাগ করিয়াছেন। এক্ষণে তুমি ভীমসেনকে রথশূন্য করিয়া তাঁহার প্রতি দুৰ্বাক্য প্রয়োগ করিয়া নিতান্ত অধর্ম্ম করিতেছ। শত্রুকে পরাজয় করিয়া আত্মশ্লাঘা, পরগ্লানি বা অরাতির প্রতি দুৰ্বাক্য প্রয়োগ করা বীরপুরুষের কর্ত্তব্য নহে। তুমি সূতপুত্র ও অল্পজ্ঞানসম্পন্ন; এই নিমিত্তই সততই সদ্‌ব্রতপরায়ণ মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেনের প্রতি কটুক্তি করিয়াছ। মহাবীর ভীমসেন সমুদয় সৈন্যগণের, কেশবের ও আমার সমক্ষে তোমাকে অনেকবার রথবিহীন করিয়াছেন; কিন্তু তিনি কিছুমাত্র পুরুষবাক্য প্রয়োগ করেন নাই। যাহা হউক, তুমি ভীমসেনের প্রতি বারংবার কটুক্তি প্রয়োগ এবং আমার সমক্ষে অন্যান্য বীরগণের সহিত সমবেত হইয়া অভিমন্যুকে বিনাশ করিয়া যে গর্ব্ব প্রকাশ করিতেছ, অবিলম্বেই তাহার ফলভোগ করিবে। হে দুর্ম্মতে! তুমি আত্মবিনাশের নিমিত্তই অভিমন্যুর শরাসন ছেদন করিয়াছিলে। আমি তোমাকে তোমার ভৃত্য ও বলবাহনের সহিত বিনাশ করিব, সন্দেহ নাই। হে রাধানন্দন! এক্ষণে তোমার মহাভয়াবহ সময় উপস্থিত হইয়াছে। অতএব যাহা কৰ্ত্তব্য থাকে, তাহা এই সময়েই অনুষ্ঠান কর। আমি এই অস্ত্র স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আজ তোমার সমক্ষে তোমার পুত্র বৃষসেনকে সংহার করিব। আর যে সমুদয় ভূপতি মোহবশতঃ আমার সম্মুখে আগমন করিবেন, তাঁহাদিগকেও আমার শরে শমনভবনে গমন করিতে হইবে। হে আত্মাভিমানী অজ্ঞান! দুর্ম্মতি দুৰ্য্যোধন নিশ্চয়ই তোমাকে রণে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় অনুতাপ করিবে।

অর্জ্জুনের প্রতি কৃষ্ণের উৎসাহবাণী

“এইরূপে মহাবীর ধনঞ্জয় কর্ণের পুত্রকে বিনাশ করিতে প্রতিজ্ঞা করিলে রথীগণ তুমুল কোলাহল করিতে লাগিলেন। ঐ ভয়াবহ সময়ে দিবাকর করনিকর সঙ্কোচ করিয়া অস্তাচলশিখরে আরোহণ করিলেন। তখন মহাত্মা হৃষীকেশ ধনঞ্জয়কে আলিঙ্গন পূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! তুমি ভাগ্যবলে জয়দ্রথবধরূপ প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করিয়াছ; ভাগ্যবলে বৃদ্ধক্ষত্র পুত্রের সহিত নিহত হইয়াছেন। হে অর্জ্জুন! এই ধাৰ্তরাষ্ট্রসৈন্যমধ্যে মহাবীর কার্ত্তিকেয় অবতীর্ণ হইলেও তাঁহাকে অবসন্ন হইতে হয়, সন্দেহ নাই। যাহা হউক, এই জগতীতলে তোমা ভিন্ন আর কোন ব্যক্তিকেই এই সৈন্যগণের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ বলিয়া বিবেচনা হয় না। তোমার তুল্য বা তোমা হইতে সমধিক বলবীৰ্য্যসম্পন্ন মহাপ্রভাব মহীপালগণ মহাবাহু দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে কৌরবসৈন্যমধ্যে সমবেত হইয়াছেন। তাঁহারা তোমাকে ক্রোধাবিষ্ট অবলোকন ও তোমার সন্নিধানে আগমন করিয়াও তোমার সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়েন নাই। তোমার বলবীৰ্য্য রুদ্র, শক্র ও অন্তকের সদৃশ; অদ্য তুমি যেরূপ পরাক্রম প্রকাশ করিলে, এইরূপ পরাক্রম প্রদর্শন করিতে কেহই সমর্থ নহে। হে মহাবীর! এক্ষণে তুমি জয়দ্রথকে সংহার করাতে আমি তোমার যেরূপ প্রশংসা করিতেছি, দুরাত্মা কর্ণ অনুচরগণসমভিব্যাহারে তোমার শরনিকরে নিহত হইলে আমি পুনরায় তোমাকে এইরূপ প্রশংসা করিব।’

তখন মহাবীর অর্জ্জুন বাসুদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে মাধব! আমি তোমার অনুকম্পাতেই অদ্য এই অমরগণেরও দুস্তর প্রতিজ্ঞাসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছি। হে মধুসূদন! তুমি যাহাদের নাথ, তাহাদের জয়লাভ হওয়া আশ্চৰ্য্য নহে। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তোমার প্রসাদেই সমগ্র পৃথিবী অধিকার করিবেন। হে, কৃষ্ণ! আমাদের সমস্ত কাৰ্য্যের ভার তোমাতেই সমর্পিত আছে; সুতরাং এক্ষণে এই জয়লাভ তোমারই হইল। আমরা তোমার কিঙ্কর, আমাদিগকে উত্তেজিত করা তোমার কর্ত্তব্যই হইতেছে।

“মহাবীর মধুসূদন অর্জ্জুনকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া হাস্যমুখে তাঁহাকে সেই ভয়ঙ্কর সংগ্রামস্থল প্রদর্শনপূর্ব্বক মন্দভাবে অশ্বসঞ্চালন করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! ঐ দেখ, মহাবলপরাক্রান্ত পার্থিবগণ যুদ্ধে জয় ও বিপুল যশোলাভের অভিলাষে তোমার সহিত সংগ্রাম করিয়া তোমার শরনিকরে সমাহত ও সমরাঙ্গনে শয়ান রহিয়াছে। ঐ তাহাদিগের শস্ত্র ও আভরণসকল ইতস্ততঃ বিকীর্ণ রহিয়াছে; রথসকল চূর্ণ, অশ্ব ও হস্তিগণ বিনষ্ট ও বর্ম্মসকল ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছে। ঐ সকল ভূপালের মধ্যে কাহারও প্রাণবিয়োগ হইয়া গিয়াছে এবং কেহ কেহ এখনও জীবিত আছেন। হে অর্জ্জুন! ঐ সমস্ত অবনীপালগণ গতজীবিত হইয়াও স্ব স্ব প্রভাবে সজীবের ন্যায় লক্ষিত হইতেছেন। ঐ দেখ, উহাদের অসংখ্য বাহন, সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকর ও অন্যান্য বিবিধ অস্ত্রশস্ত্রদ্বারা রণস্থল সমাচ্ছন্ন হইয়াছে এবং বর্ম্ম, মণিহার, কণ্ঠসূত্র, অঙ্গদ, নিষ্ক ও অন্যান্য নানাবিধ ভূষণদ্বারা রণভূমির অপূর্ব্ব শোভা হইয়াছে। রাশি রাশি অনুকর্ষ, তূণীর, পতাকা, ধ্বজদণ্ড, অলঙ্কার, আসন, ঈষাদণ্ড, চক্র, বিচিত্র অক্ষ, যুগ, যোক্ত্র, শর, শরাসন, চিত্রকম্বল, পরিঘ, অঙ্কুশ, শক্তি, ভিন্দিপাল, শূল, পরশু, প্রাস, তোমর, কুন্ত, ষষ্টি, শতঘ্নী, ভূশুণ্ডী, খড়ঙ্গ, মুষল, মুদগর, গদা, কুণপ, সুবর্ণমণ্ডিত কশা, করীদিগের ঘণ্টা, বিবিধ অলঙ্কার এবং মহামূল্য নানাবিধ বসন-ভূষণ ইতস্ততঃ বিকীর্ণ থাকাতে রণস্থল শরৎকালীন গ্রহনক্ষত্রপরিপূর্ণ নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতেছে। অবনীপালগণ পৃথিবীলাভার্থ নিহত হইয়া, নিদ্রিত পুরুষেরা যেমন মনোরমা প্রিয়তমাকে আলিঙ্গন করিয়া থাকে, তদ্রূপ পৃথিবীকে আলিঙ্গন করিয়া শয়ান রহিয়াছেন। ঐ দেখ, যেমন পর্ব্বতসমুদয়ের গুহামুখ হইতে গৈরিকধাতুধারা প্রবাহিত হয়, তদ্রূপ শরনিকরসমাহত, ক্ষিতিতলে বিলুণ্ঠমান, ঐরাবতসদৃশ মাতঙ্গগণের শস্ত্ৰক্ষত অঙ্গ -প্রত্যঙ্গ হইতে শোণিত বিনির্গত হইতেছে। সুবর্ণালঙ্কারে অলঙ্কৃত অশ্বগণ নিহত এবং রথীসকল ধ্বজ, পতাকা, অক্ষ, চক্র, কূবর, যুগ ও ঈষাবিহীন হইয়া ভূতলে নিপতিত হইয়াছে। শরাসনচর্ম্মধারী সহস্র সহস্র পদাতি ধূলিধূসরিতকেশ হইয়া রুধিরলিপ্ত কলেবরে পৃথিবী আলিঙ্গনপূর্ব্বক শয়ান রহিয়াছে। ঐ দেখ, তোমার শরজালে নিপতিত কুঞ্জর, রথ ও অশ্বকুলসমাকুল দুর্নিরীক্ষ্য সমরভূমি মধ্যে অনবরত রুধির, বসা ও মাংস নিপতিত হওয়াতে প্রভূত কর্দ্দম সমুৎপন্ন হইয়াছে। অসংখ্য নিশাচর, কুক্কুর, বৃক, পিশাচ উহাতে নিরন্তর আমোদপ্রমোদ করিতেছে। হে ধনঞ্জয়! তুমি এই সংগ্রামস্থলে যেরূপ যশস্কর কার্য্যানুষ্ঠান করিয়াছ, ইহা কেবল তোমার ও দৈত্যদানবসংহারকারী সুররাজ ইন্দ্রেরই সাধ্যায়ত্ত। ঐ দেখ, অসংখ্য চামর, ছত্র, ধ্বজ, অশ্ব, হস্তী, রথ, বিচিত্র কম্বল, বলগা, কুথ [হস্তিপৃষ্ঠাবরণ চিত্রকম্বল] ও মহামূল্য বরূথসকল ইতস্ততঃ বিকীর্ণ থাকাতে রণস্থল বিচিত্র বস্তুসমাচ্ছন্নের ন্যায় শোভা পাইতেছে। সহস্র সহস্র বীর সুসজ্জিত মাতঙ্গ হইতে নিপতিত হইয়া বজ্রভগ্ন পর্ব্বতশিখর হইতে নিপতিত সিংহের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছে। ঐ দেখ, সাদিগণ অশ্বের সহিত ও পদাতিগণ কার্মুকের সহিত নিপতিত হইয়া অনবরত রুধিরধারা ক্ষরণ করিতেছে। হে মহারাজ! এইরূপে বাসুদেব হৃষ্ট অনুচরগণ সমভিব্যাহারে অর্জ্জুনকে সমরস্থল প্রদর্শনপূর্ব্বক পাঞ্চজন্যশঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন।”