১৩১. ভীমকর্ণসমর-কর্ণপলায়ন

১৩১তম অধ্যায়

ভীমকর্ণসমর-কর্ণপলায়ন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে সেই লোমহর্ষণ তুমুল সংগ্রামে সমুদয় বীরগণ নিতান্ত নিপীড়িত ও ব্যাকুল হইলে, অরণ্যে মত্তমাতঙ্গ যেমন মত্তদ্বিপের প্রতি ধাবমান হয়, সেইরূপে মহাবীর কর্ণ যুদ্ধার্থী ভীমসেনসমীপে সমুপস্থিত হইলেন।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়। অর্জ্জুনরথের পাশে মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন ও কর্ণের কিরূপ সংগ্রাম হইল? রাধানন্দন ভীমসেনকর্ত্তৃক পূর্ব্বে পরাজিত হইয়াও কি কারণে পুনরায় তাহার নিকট যুদ্ধার্থ আগমন করিল? আর ভীমসেনই বা কি করিয়া সেই প্রসিদ্ধ মহারথ সূতপুত্রের অভিমুখগমনে প্রবৃত্ত হইল? ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ভীষ্মদেব ও দ্রোণাচাৰ্য্যকে অতিক্রম করিয়া অবধি ধনুর্দ্ধর কর্ণ ভিন্ন আর কাহাকেও ভয় করে না। কর্ণের ভয়ে তাহার শয়ন পৰ্য্যন্ত পরিত্যক্ত হইয়াছে। বৃকোদর কিরূপে সেই রথীশ্রেষ্ঠ সূতপুত্রের সহিত যুদ্ধ করিল; অর্জ্জুনের রথাভিমুখে কর্ণ ও ভীমের কিরূপ সংগ্রাম হইল? পূর্ব্বে মহাবীর কর্ণ কুন্তীর নিকট ভীমসেনকে আপনার ভ্রাতা বলিয়া অবগত হইয়াছে এবং অর্জ্জুন ভিন্ন আর কোন পাণ্ডবকে বিনষ্ট করিব না, বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছে। তবে এক্ষণে কি নিমিত্ত ভীমের সহিত সংগ্রাম করিল? ভীমই বা কর্ণের পূর্ব্বকৃত বৈর স্মরণ করিয়া কিরূপে তাহার সহিত সংগ্রাম করিতে সাহসী হইল? হে সঞ্জয়! আমার পুত্র মূঢ় দুৰ্য্যোধন নিরন্তর আশা করিয়া থাকে যে, কর্ণ সমস্ত পাণ্ডবকে পরাজিত করিবে। ফলতঃ দুৰ্য্যোধন কেবল কর্ণের উপর নির্ভর করিয়াই জয়াশা করিয়া থাকে, সেই কর্ণ কিরূপে ভীমকৰ্ম্মা ভীমসেনের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল? আমার পুত্রগণ যাহাকে আশ্রয় করিয়া মহারথগণের সহিত শত্রুতা করিয়াছে, যে বীর একরথে সসাগরা পৃথিবী পরাজিত করিয়াছে, যে ধনুর্দ্ধর সহজকবচ ও কুণ্ডল ধারণপূর্ব্বক জন্মগ্রহণ করিয়াছে, ভীমসেন সেই মহাবীর কর্ণকর্ত্তৃক পূর্ব্বকৃত অসংখ্য অপকার স্মরণ করিয়াও কিরূপে তাহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল? যাহা হউক, এক্ষণে বীরদ্বয়ের কিরূপ যুদ্ধ ও কাহারই বা জয়লাভ হইল, তৎসমুদয় আদ্যোপান্ত আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে নররাজ! ভীমসেন মহারথ কর্ণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয়ের নিকট গমন করিতে বাসনা করিলেন। মহাবীর কর্ণ তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া মহাবেগে তাঁহার নিকট গমনপূর্ব্বক জলধর যেমন বৃষ্টিদ্বারা ভূধরকে আচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ কঙ্কপত্রবিশিষ্ট শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহাকে আবৃত করিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিয়া কহিলেন, “হে পাণ্ডুতনয়! তুমি শত্রুদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে পার, ইহা আমি স্বপ্নেও অবগত নহি। যাহা হউক, তুমি অর্জ্জুনদর্শনমানসে আমার নিকট হইতে পলায়ন করিয়া কি কুন্তীপুত্রের উপযুক্ত কর্ম্ম করিতেছ? পলায়ন করিও না; এই স্থানে থাকিয়া চতুর্দ্দিক হইতে আমার প্রতি শরবর্ষণ কর।’ মহাবীর ভীমসেন কর্ণের সেই প্রকার আহ্বানশ্রবণে ক্রুদ্ধ হইয়া অৰ্দ্ধমণ্ডলাকারে পরিভ্রমণপূর্ব্বক শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার সহিত যুদ্ধারম্ভ করিলেন। বৰ্মধারী কর্ণ সেই দ্বৈরথযুদ্ধে সৰ্ব্বশস্ত্রবিশারদ ভীমসেনের সরল শরজালে সমাচ্ছন্ন হইলেন। বৃকোদর প্রথমতঃ কৌরবপক্ষীয় অসংখ্য বীরকে বিনাশ করিয়া বিবাদ শেষ করিবার মানসে কর্ণের প্রতি সুতীক্ষ্ণ বিবিধ বাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবল কর্ণ স্বীয় অস্ত্রমায়াপ্রভাবে মত্তদ্বিরদগামী ভীমসেনের শরবর্ষণ নিবারণ করিলেন। হে মহারাজ! মহাবীর সূতপুত্র রীতিমত যুদ্ধবিদ্যাশিক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি, সমরে আচার্য্যের ন্যায় পর্য্যটন ও হাস্যপূর্ব্বক ক্রোধপূর্ণ বৃকোদরকে অবমাননা করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন কর্ণের হাস্য সহ্য করিতে না পারিয়া, যুধ্যমান বীরগণের সমক্ষে মহামাতঙ্গের উপরে যেমন অঙ্কুশাঘাত করে, তদ্রূপ সূতপুত্রের বক্ষঃস্থলে বৎসদন্তসমুদয় নিক্ষেপপূর্ব্বক পুনরায় সুপুঙ্খ সুশাণিত একবিংশতি শরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ ভীমসেনের কনকজালজড়িত পবনসদৃশ বেগবান্ অশ্বগণকে পাঁচ পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিয়া বাণজাল বর্ষণপূর্ব্বক নিমেষাৰ্দ্ধমধ্যে বৃকোদরকে সারথি, রথ ও ধ্বজের সহিত আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে তিনি ক্রোধভরে চতুঃষষ্টিশরে ভীমের সুদৃঢ় কবচ ভেদ করিয়া মৰ্ম্মভেদী নারাচাস্ত্রে তাঁহাকে আহত করিলেন। মহাবাহু বৃকোদর সেই কর্ণকার্মুকনিঃসৃত শরসমুদয় লক্ষ্য না করিয়া অসম্ভ্রান্তচিত্তে তাঁহার সহিত প্রতিযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি কর্ণের আশীবিষোপম শরজালে বিদ্ধ হইয়া কিঞ্চিন্মাত্র ব্যথিত হয়েন নাই। পরিশেষে তিনি নিশিত সুতীক্ষ্ণ দ্বাত্রিংশৎ ভল্লদ্বারা কর্ণকে বিদ্ধ করিলেন; কর্ণও অবলীলাক্রমে শরবর্ষণ করিয়া জয়দ্রথবধাভিলাষী মহাবাহু ভীমসেনকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার সহিত মৃদুভাবে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন পূর্ব্ববৈর স্মরণপূর্ব্বক কর্ণের সেই অপমান সহ্য করিতে না পারিয়া ক্রোধভরে অবিলম্বে তাঁহার প্রতি শরনিকর নিক্ষেপ করিলেন। ভীমপ্রেরিত সুবর্ণপুঙ্খ শরজাল শব্দায়মান বিহঙ্গকুলের ন্যায় ধাবমান হইয়া কর্ণকে আচ্ছন্ন করিল। রথীপ্রধান রাধেয় এইরূপ শলভকুলসমাচ্ছন্নের ন্যায় ভীমসেনের শরনিকরে সমাবৃত হইয়া তাঁহার উপর সুতীক্ষ্ণ শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর বৃকোদর বহুবিধ ভল্লদ্বারা তাঁহার সেই শরজাল অর্দ্ধপথে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর কর্ণ পুনরায় শরবর্ষণদ্বারা ভীমসেনকে আচ্ছন্ন করিলেন। ভীমসেন কর্ণের শরজালে সমাবৃত হইয়া শলভসমাচ্ছন্ন শল্লকীর ন্যায় দৃষ্ট হইতে লাগিলেন। দিবাকর যেমন আপনার রশ্মিজাল অনায়াসে ধারণ করেন, তদ্রূপ ভীমসেন কর্ণনিক্ষিপ্ত শরনিকর অক্লেশে ধারণ করিলেন। কর্ণচাপচ্যুত হেমপুঙ্খ শিলাধৌত শরজালে তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ রুধিরাপ্লুত হওয়াতে তিনি বসন্তকালীন বহুকুসুমশোভিত অশোকবৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। পরিশেষে তিনি কর্ণের সমরবিচরণ সহ্য করিতে না পারিয়া ক্রোধে নয়নদ্বয় উদ্বর্ত্তনপূর্ব্বক তাঁহার উপর পঞ্চবিংশতি নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর সূতপুত্র ভীমের শরে বিদ্ধ হইয়া তীব্ৰবিষ আশীবিষসমাবৃত শ্বেতভূধরের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন চতুর্দ্দশবাণে কর্ণের বর্ম্ম ভেদপূর্ব্বক সুতীক্ষ্ণ শরনিকরে তাঁহার চাপচ্ছেদন, অশ্বচতুষ্টয় বিনাশ ও সারথিকে সংহার করিয়া অর্করশ্মিসমপ্রভ নারাচসমুদয়ে বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন। সূর্যের কিরণজাল যেমন জলধরপটল ভেদ করিয়া ভূমণ্ডলে নিপতিত হয়, তদ্রূপ ভীমনির্মুক্ত নারাচনিকর কর্ণকে বিদ্ধ করিয়া রণস্থলে পতিত হইল। হে মহারাজ! পুরুষাভিমানী কর্ণ এইরূপে ভীমসেনের শরাঘাতে ছিন্নচাপ বিকলাঙ্গ হইয়া সত্বর অন্য রথে পলায়ন করিলেন।”