১৩২. পুনর্ব্বার ভীমকর্ণের ভীষণ যুদ্ধ

১৩২তম অধ্যায়

পুনর্ব্বার ভীমকর্ণের ভীষণ যুদ্ধ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! যে কর্ণের উপর আমার পুত্রগণের মহতী জয়াশা ছিল, দুৰ্য্যোধন সেই কর্ণকে রণপরাঙ্মুখ অবলোকন করিয়া কি বলিল? মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন কিরূপে যুদ্ধ করিল এবং মহাবীর কর্ণই বা সমরাঙ্গনে ভীমসেনকে প্রজ্বলিত পাবকের ন্যায় অবলোকন করিয়া কি কার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইল?”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ পুনরায় যথাবিধি সুসজ্জিত অন্য এক রথে আরোহণপূর্ব্বক বাতোচূত মহার্ণবের ন্যায় ভীমসেনের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। ঐ সময়ে আপনার পুত্রেরা কর্ণকে রোষপরবশ অবলোকন করিয়া ভীমকে হুতাশনমুখে আহুত বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন। মহাবীর রাধেয় অতি ভীষণ জ্যানিঃস্বন ও করতলশব্দ করিয়া ভীমের রথাভিমুখে গমন করিলেন। তখন পুনরায় সূতপুত্রের সহিত ভীমের অতি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। পরস্পরবধার্থী ঐ বীরদ্বয় ক্ৰোধারুণলোচনে দগ্ধ করিয়াই যেন পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিয়া ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গদ্বয়ের ন্যায় গৰ্জন করিতে লাগিলেন। পরে তাঁহারা পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া কোপান্বিত ব্যাঘ্রদ্বয়ের ন্যায়, শীঘ্রগামী শ্যেনদ্বয়ের ন্যায় এবং সংক্রুদ্ধ শরভদ্বয়ের ন্যায় যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন।

“হে মহারাজ! পূর্ব্বে দূতক্রীড়া, বনবাস, বিরাটনগরে অবস্থান ও বহুরত্বপূর্ণ রাজ্য অপহরণ জন্য পাণ্ডবগণের যে দুঃখ হইয়াছিল, আপনি পুত্রগণের সহিত মন্ত্রণা করিয়া সপত্রা তপস্বিনী কুন্তীকে যে দগ্ধ করিতে সঙ্কল্প ও নিরন্তর পাণ্ডবগণকে ক্লেশ প্রদান করিয়াছিলেন, আপনার দুরাত্মা তনয়েরা সভামধ্যে দ্রৌপদীকে যে ক্লেশপ্রদানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, দুঃশাসন দ্রুপদতনয়ার যে কেশাকৰ্ষণ করিয়াছিলেন, কর্ণ সভামধ্যে পাণ্ডবগণের প্রতি যে নিদারুণ বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, কৌরবেরা ‘কৃষ্ণে! তোমার ষণ্ডতিলসদৃশ স্বামীরা নিহত হইয়া নিরয়গামী হইয়াছে, তুমি অন্য কাহাকে পতিত্বে বরণ কর’ বলিয়া যে আপনার সমক্ষেই দ্রৌপদীকে অপমান করিয়াছিলেন, আপনার পুত্রেরা কৃষ্ণাকে যে দাসীভাবে উপভোগ করিতে বাসনা ও পাণ্ডবগণকে কৃষ্ণাজিনধারী হইয়া যে বনে গমন করিতে আদেশ করিয়াছিলেন এবং আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন ক্রোধভরে শূন্যহৃদয় বিপন্নপাণ্ডবগণকে তৃণতুল্য বোধ করিয়া যে আস্ফালন করিয়াছিলেন, ঐ সময় সেই সমুদয় বৃত্তান্ত ভীমসেনের মনে উদিত হইতে লাগিল। তিনি বাল্যকাল অবধি যে যে দুঃখ পাইয়াছিলেন, তৎসমুদয় স্মরণ করিয়া যৎপরোনাস্তি দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া সুবর্ণপৃষ্ঠ বৃহদ্ধনু বিস্ফারণপূর্ব্বক প্রাণপণে কর্ণাভিমুখে ধাবমান হইলেন এবং রাধেয়ের রথাভিমুখে ভাস্বর, শাণিত শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক দিবাকরের করজাল আচ্ছাদিত করিয়া ফেলিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত মহাবাহু কর্ণ তদ্দর্শনে হাস্য করিয়া অতি সত্বর স্বীয় শরনিকরদ্বারা ভীমসেনের শরজাল ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাকে নিশিত নয়শরে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর বৃকোদর অঙ্কুশাহত মাতঙ্গের ন্যায় রাধেয়শরে নিবারিত হইয়া মহাবেগে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর কর্ণ সমরসমুৎসুক মত্তমাতঙ্গবিক্রম পাণ্ডুনন্দনকে বেগে সমাগত দেখিয়া তাহার প্রত্যুদগমন করিলেন এবং শতভেরীসমনিঃস্বন শঙ্খ প্রাধ্নাপিত করিয়া পরমাহ্লাদে ভীমসেনের সৈন্যসমুদয় বিক্ষোভিত করিলেন। মহাবীর বৃকোদর হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিসমবেত স্বীয় সৈন্যগণকে ছিন্নভিন্ন নিরীক্ষণ করিয়া কর্ণকে শরধারায় সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ শরনিকরে ভীমকে সমাচ্ছন্ন করিয়া স্বীয় হংসসন্নিভ শ্বেতাশ্বগণের সহিত তাঁহার ঋক্ষসবর্ণ [ভল্লুকের তুল্য বর্ণ] কৃষ্ণাশ্বগণকে সম্মিলিত করিলেন। তদ্দর্শনে কৌরবসৈন্যমধ্যে মহা হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। সেই বীরদ্বয়ের বায়ুবেগগামী কৃষ্ণ ও শ্বেতবর্ণ অশ্বগণ একত্রিত হইয়া গগণমণ্ডলস্থ সিতাসিত [শুক্ল ও কৃষ্ণ] মেঘের ন্যায় শোভা ধারণ করিল।

“হে রাজন! ঐ সময় কৌরবপক্ষীয় মহারথেরা কর্ণ ও বৃকোদরকে ক্রোধে অতিমাত্র আক্রান্ত নিরীক্ষণ করিয়া ভীতমনে কম্পিত হইতে লাগিলেন। সমরাঙ্গন যমরাজের রাজধানীর ন্যায় অতিশয় দুর্নিরীক্ষা হইয়া উঠিল। মহারথীগণ সেই জনতামধ্যে ঐ বীরদ্বয়ের কাহারও জয়পরাজয় স্থির করিতে পারিলেন না; কেবল ঐ বীরদ্বয় পরস্পর সমীপবর্তী হইয়া অস্ত্ৰযুদ্ধ করিতেছেন, এইমাত্র অবলোকন করিলেন। তখন সেই অরাতিনিপাতন মহারথদ্বয় পরস্পরের বধার্থী হইয়া পরস্পরের প্রতি বাণবর্ষণপূর্ব্বক আকাশমণ্ডল শরসমাচ্ছন্ন করিয়া বারিধারাবর্ষী জলদের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের কঙ্কপত্রবিভূষিতের [প্রদীপিতের] সুবর্ণময় শরনিকরদ্বারা গগনমণ্ডল উল্কাবিভাসিতের ন্যায় ও শরৎকালীন সরসমাচ্ছন্নের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। ঐ সময় মহাবীর কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় ভীমসেনকে কর্ণের সহিত সমরে সম্মিলিত দেখিয়া তাঁহাকে অতিভারাক্রান্ত বিবেচনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর কর্ণ ও ভীমসেন পরস্পর পরস্পরের শরনিকর নিরাকৃত করিয়া দৃঢ়তর শর প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিলে অসংখ্য অশ্ব, নর ও হস্তিসমুদয় বিগতাসু হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। তাঁহাদিগের নিপাতনে অসংখ্য কৌরবসৈন্য বিনষ্ট হইতে লাগিল। এইরূপে মনুষ্য, অশ্ব ও হস্তিসকল নিহত হইলে তাহাদিগের মৃতদেহে ক্ষণকালের মধ্যে সমরভূমি সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল।”