১০৭. কৌরবপক্ষীয় ক্ষেমধূর্ত্তি বধ

১০৭তম অধ্যায়

কৌরবপক্ষীয় ক্ষেমধূর্ত্তি বধ

হে মহারাজ! মহাবীর মেমধূৰ্ত্তি সমরক্ষেত্রে সমাগত কেকয়দেশীয় দৃঢ়বিক্রম বৃহৎক্ষত্রের বক্ষস্থলে অসংখ্য বাণ বিদ্ধ করিলেন। রাজা বৃহৎক্ষত্রও দ্রোণসৈন্য ভেদ করিবার নিমিত্ত সত্বরে তাঁহাকে নতপর্ব্ব নবতি বাণে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন ক্ষেমধূৰ্ত্তি ক্রুদ্ধ হইয়া শাণিত ভল্লাস্ত্র দ্বারা মহাত্মা বৃহৎক্ষত্রের শরাসন ছেদন করিয়া আনতপর্ব্ব শরনিকরে তাঁহার সর্ব্বশরীর বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর বৃহৎ ক্ষত্র সহাস্য মুখে অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া মহারথ ক্ষেমধূৰ্ত্তির অশ্ব, সারথি ও রথ ছেদন পূর্ব্বক শাণিত ভল্লাস্ত্র দ্বারা তাঁহার জ্বলিত কুণ্ডলমণ্ডিত মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ক্ষেমধূৰ্ত্তির কুঞ্চিত কেশবিরাজিত কিরীটমণ্ডিত ছিন্ন মস্তক সহসা ভূতলে নিপতিত হইয়া অম্বরচ্যুত জ্যোতিঃ পদার্থের ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিল। এই রূপে মহাবীর বৃহৎক্ষত্র ক্ষেমধূৰ্ত্তির প্রাণ সংহার করিয়া প্রসন্ন মনে পাণ্ডবগণের সাহায্যার্থ সহসা কৌরব সৈন্যাভিমুখে ধাবমান হইলেন।

কৌরবপক্ষীয় বীরধন্বার নিধন

মহাবীর ধৃষ্টকেতু দ্রোণকে আক্রমণ করিবার নিমিত্ত ধাবমান হইলে মহাবল পরাক্রান্ত বীরধন্বা তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। সেই বলবীৰ্য্য সম্পন্ন বীরদ্বয় বহু সহস্র শর দ্বারা পরস্পরকে বিদ্ধ করিয়া নিবিড়ারণ্যচারী মদোন্মত্ত যুথপতি মাতঙ্গদ্বয়েৰ ন্যায়, গিরিগহ্বরস্থ ক্রুদ্ধ শাৰ্দুলদ্বয়ের ন্যায় পরস্পর জিঘাংসায় ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। সিদ্ধচারণগণ বিস্ময়ৎফুল্ল লোচনে তাঁহাদের সেই অপূর্ব্ব সংগ্রাম দেখিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর বীরধন্বা ক্রুদ্ধ হইয়া অম্লান মুখে ভল্লাস্ত্র দ্বারা ধৃষ্টকেতুর শরাসন দুই খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু অবিলম্বে সেই ছিন্ন চাপ পরিত্যাগ করিয়া সুবর্ণ দণ্ড মণ্ডিত লৌহময়ী শক্তি গ্রহণ পূর্ব্বক বীরধন্বার রথ লক্ষ্য করিয়া ক্ষেপণ করিলেন। মহাবীর বীরধম্বা সেই বীরঘাতিনী শক্তির আঘাতে ভিন্নহৃদয় হইয়া সহসা রথ হইতে ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। হে মহারাজ! এইরূপে ত্ৰিগৰ্ত্তদেশীয় মহারথ বীরধম্বার মৃত্যু হইলে পাণ্ডব পক্ষীয়গণ আপনার সৈন্য-সংক্ষয় করিতে আরম্ভ করিলেন।

সহদেব কর্ত্তৃক নিরমিত্র বধ

তখন মহাবীর দুর্ম্মুখ সহদেবের প্রতি যষ্টি শর নিক্ষেপ করিয়া তাঁহাকে তর্জ্জন করত বীরনাদ করিতে লাগিলেন। মাদ্রিনন্দন তাঁহার তর্জ্জনে কোপপূর্ণ হইয়া শাণিত শর নিক্ষেপ পূর্ব্বক অবলীলাক্রমে দুর্মুখকে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন।

এবং পরিশেষে নয় বাণে তাঁহাকে গাঢ় বিদ্ধ করিয়া শাণিত ভল্লে তাঁহার কেতু, চারি বাণে চারি অশ্ব, শাণিত ভল্লে সারথির মস্তক ও তীক্ষ্ণ ক্ষুরপ্র দ্বারা তাঁহার শরাসন ছেদন পূর্ব্বক তাঁহাকে পুনরায় পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর দুর্মুখ সেই অশ্ববর্জিত স্বীয় রথ পরিত্যাগ পূর্ব্বক বিমনায়মান হইয়া নিরমিত্রের রথে সমারূঢ় হইলেন। তখন শক্ৰহন্তা সহদেব নিরমিত্রের প্রতি কোপাবিষ্ট হইয়া ভল্লাস্ত্র দ্বারা তাঁহাকে সংহার করিলেন। ত্ৰিগৰ্তরাজপুত্র নিরমিত্র সহদেবের শরাঘাতে তৎক্ষণাৎ রথ হইতে ধরাতলে পতিত ও পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। কৌরব সৈন্যগণ তদ্দর্শনে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া হাহাকার করিতে লাগিল। হে মহারাজ! দশরথাত্মজ রাম নিশাচর খরের প্রাণ সংহার করিয়া যেরূপ শোভমান হইয়াছিলেন, সহদেবও ত্ৰিগৰ্তরাজ পুত্র নিরমিত্রের জীবন নাশ করিয়া তদ্রূপ শোভা ধারণ করিলেন। ত্রিগর্তের রাজপুত্রের নিধন নিরীক্ষণ করিয়া অনবরত আৰ্তনাদ ও হাহাকার করিতে লাগিল।

সাত্যকিসহ যুদ্ধে কৌরবগণের পরাজয়

হে মহারাজ! মহাবীর নকুল আপনার পুত্র পৃথুলোচন বিকর্ণকে মুহুর্ত্ত মধ্যে পরাজিত করিয়া সকল লোককে বিস্ময়াপন্ন করিলেন। ঐ সময় মহাবীর ব্যাঘ্রদত্ত নতপর্ব্ব শরবর্ষণ করিয়া সেনা মধ্যগত সাত্যকিকে অশ্ব, ধ্বজ ও সারথির সহিত অদৃশ্য করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর সাত্যকি হস্তলাঘব প্রদর্শন পূর্ব্বক শরদ্বারা ব্যাঘ্রদত্তের শর সমুদায় নিবারণ এবং তাঁহার অশ্ব, সারথি ও ধ্বজ ছেদন পূর্ব্বক তাঁহাকে নিপাতিত করিলেন। এই রূপে মগধরাজপুত্র বিনষ্ট হইলে মগধদেশীয় বীরগণ ক্রোধভরে সাত্যকির সম্মুখীন হইয়া তাঁহার উপর অসংখ্য শর, তোমর, ভিন্দিপাল, প্রাস, মুষল, মুদগর প্রভৃতি বিবিধ অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিল। যুদ্ধদুৰ্ম্মদ সাত্যকি সহাস্য মুখে অনায়াসে সেই সকল বীরগণকে পরাজিত করিলেন। হতবশিষ্ট মাগধগণ প্রাণভয়ে সংগ্রাম বিমুখ হইয়া চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল। তদ্দর্শনে আপনার সেনাগণও সমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন পরায়ণ হইল। হে মহারাজ! এই রূপে মধুবংশাবতংস সাত্যকি আপনার সৈন্যগণকে নিপাতিত করিয়া শরাসন বিধুননপূর্ব্বক সংগ্রামে পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার সহিত সংগ্রাম করিতে আর কাহারও সাহস হইল না। তখন মহাবীর দ্রোণাচার্য্য কোপাবিষ্ট হইয়া নেত্র বিঘূর্ণনপূর্ব্বক সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইলেন।”