১৪৫. জয়দ্ৰথবধে অর্জ্জুনের সত্বরতা

১৪৫তম অধ্যায়

জয়দ্ৰথবধে অর্জ্জুনের সত্বরতা

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর ভূরিশ্রবা তদবস্থ হইয়া নিহত হইলে পুনরায় যেরূপ যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছিল, তদ্‌বৃত্তান্ত বর্ণনা কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর ভূরিশ্রবা পরলোকগমন করিলে পর মহাবাহু অর্জ্জুন বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে হৃষীকেশ! তুমি অবিলম্বে জয়দ্ৰথসমীপে রথসঞ্চালন করিয়া আমাকে সফলপ্রতিজ্ঞ [প্রতিজ্ঞাপালক] কর। হে মহাবাহোয় দিবাকর সত্বর অস্তাচলে গমন করিতেছেন। আমাকে অবিলম্বে এই জয়দ্রথবধরূপ মহৎকাৰ্য্য সম্পাদন করিতে হইবে। কৌরবপক্ষীয় মহারথগণও প্রাণপণে সিন্ধুরাজকে রক্ষা করিতেছেন। অতএব যাহাতে আমি দিবাকর অস্তাচলে গমন না করিতে করিতে জয়দ্রথকে বিনাশপূর্ব্বক স্বীয় প্রতিজ্ঞা সফল করিতে পারি, এরূপ বিবেচনা করিয়া অসঞ্চালন কর ‘ তখন অশ্বলক্ষণবিৎ মহাবাহু কেশব অবিলম্বে জয়দ্রথের রথাভিমুখে রজতপ্রতিম তুরঙ্গমগণকে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর দুৰ্য্যোধন, কর্ণ, বৃষসেন, শল্য, অশ্বত্থামা, কৃপ এবং সিন্ধু রাজ অমোঘাস্ত্র মহাবীর ধনঞ্জয়কে শরসদৃশ বেগশীল অশ্বসমুদয় সঞ্চালনপূর্ব্বক আগমন করিতে দেখিয়া সত্বর তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় সিন্ধুরাজকে সম্মুখে অবস্থিত দেখিয়া ক্রোধে প্রদীপ্তনেত্রে তাঁহাকে যেন দগ্ধ করিতে লাগিলেন।

অর্জ্জুনপ্রতিরোধে দুৰ্য্যোধনের অধ্যবসায়

“হে মহারাজ! ঐ সময় আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন ধনঞ্জয়কে জয়দ্ৰথরথের প্রতি গমন করিতে দেখিয়া কর্ণকে কহিলেন, “হে কর্ণ! এক্ষণে অর্জ্জুনের সেই যুদ্ধসময় উপস্থিত হইয়াছে। অতএব যাহাতে জয়দ্রথ বিনষ্ট হয়, পরাক্রমপ্রদর্শনপূর্ব্বক তাহার চেষ্টা কর। দিবাভাগের আর অতি অল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে; শরনিকরে অরাতির বিঘ্নবিধান করিতে আরম্ভ কর। দিনক্ষয় হইলে নিশ্চয়ই আমরা জয়লাভ করিব। সূর্যের অস্তগমন পর্য্যন্ত সিন্ধুরাজকে রক্ষা করিতে পারিলে অর্জ্জুন বিফলপ্রতিজ্ঞ [প্রতিজ্ঞাভ্রষ্ট] হইয়া অবশ্যই অনলে প্রবেশ করিবে। তাহা হইলে উহার সহোদরেরা অনুগামিগণসমভিব্যাহারে এক মুহূর্ত্তও অর্জ্জুনশূন্য পৃথিবীতে প্রাণধারণ করিতে সমর্থ হইবে না। এইরূপে পাণ্ডবগণ বিনষ্ট হইলে আমরা এই সসাগরা ধরিত্রী নিষ্কণ্টকে উপভোগ করিব। আজ কিরীটী দৈবপ্রভাবে বিপরীত বুদ্ধি হইয়া, কার্য্যাকাৰ্য্যবিবেচনা না করিয়া আত্মবিনাশের নিমিত্ত জয়দ্ৰথবধে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়াছে। হে দুর্দ্ধর্ষ! তুমি জীবিত থাকিতে অর্জ্জুন কিরূপে সূর্যের অস্তগমনসময়মধ্যেই সিন্ধুরাজকে বিনষ্ট করিবে? আমি, মদ্ররাজ, কৃপ, অশ্বত্থামা ও দুঃশাসন, আমরা সকলে মহাবীর জয়দ্রথকে রক্ষা করিলে অর্জ্জুন কিরূপে উঁহার বিনাশে সমর্থ হইবে? একে বহুসংখ্যক বীর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তাহাতে আবার দিবাকর প্রায় অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইলেন; অতএব বোধ হয়, ধনঞ্জয় কখনই জয়দ্রথের বধে কৃতকার্য্য হইতে পারিবে না। হে কর্ণ! এক্ষণে তুমি আমাকে এবং অশ্বত্থামা, শল্য, কৃপ ও অন্যান্য বীরগণকে সমভিব্যাহারে লইয়া অসামান্য যত্নসহকারে অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও।

“হে মহারাজ! মহাবীর কর্ণ দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “হে রাজা মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন শরজালে বারংবার আমার কলেবর ছিন্নভিন্ন করিয়াছে। এক্ষণে আমি রণস্থলে অবস্থান করিতে হয় বলিয়াই অবস্থান করিতেছি। আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাহার শরনিকরে একান্ত সন্তুপ্ত ও নিতান্ত অবসন্ন হইয়াছে। যাহা হউক, তোমার নিমিত্তই আমি প্রাণধারণ করিয়া আছি; অতএব যাহাতে অর্জ্জুন সিন্ধুরাজকে সংহার করিতে না পারে, সাধ্যানুসারে যুদ্ধ করিয়া তাহার চেষ্টা করিব। আমি সমরাঙ্গনে শরনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে ধনঞ্জয় কদাচ জয়দ্রথকে প্রাপ্ত হইতে সমর্থ হইবে না। হে কুরুরাজ! হিতানুষ্ঠানপরতন্ত্র ভক্তিপরায়ণ লোকে যেরূপ কাৰ্য্য করিয়া থাকে, আমিও তদনুরূপ কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইব; কিন্তু জয়পরাজয় দৈবায়ত্ত। আজ আমি তোমার প্রিয়কাৰ্য্য সংসাধন ও সিন্ধুরাজ জয়দ্রথকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত যারপরনাই যত্ন করিব। আজ সৈন্যগণ আমার ও অর্জ্জুনের লোমহর্ষণ অতি দারুণ যুদ্ধ অবলোকন করুক।’

জয়দ্রথবধার্থী অর্জ্জুনের কৌরবাক্রমণ

“হে মহারাজ! তাহারা উভয়ে এইরূপে কথোপকথন করিতেছেন, এই অবসরে মহাবীর অর্জ্জুন আপনার সৈন্য সংহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়া নিশিতভল্লদ্বারা সমরে অপরাঙ্মুখ বীরগণের অর্গলতুল্য করিশুসদৃশ ভুজদণ্ড ও মস্তকসমুদয় ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে অশ্বগ্রীবা, করিশুণ্ড ও রথের অক্ষসকল ছেদন করিয়া রুধিরলিপ্তকলেবর, প্রাসবোমরধারী অশ্বারোহীদিগকে ক্ষুরদ্বারা দুই-তিনখণ্ডে ছেদন করিতে লাগিলেন। অসংখ্য অশ্ব ও মাতঙ্গ তাঁহার শরে নিহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। ধ্বজ, ছত্র, চাপ, চামর ও মস্তকসকল চতুর্দ্দিকে পতিত হইতে লাগিল। হুতাশন যেমন প্রাদুর্ভূত হইয়া তৃণরাশি দগ্ধ করে, তদ্রূপ মহাবীর অর্জ্জুন শরানলে কৌরবসৈন্যগণকে দগ্ধ করিয়া অনতিকালমধ্যে ধরণীতল রুধিরাভিষিক্ত করিলেন। হে মহারাজ! মহাবলপরাক্রান্ত, নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ, সত্যবিক্রম অর্জ্জুন এইরূপে আপনার পক্ষীয় বহুসংখ্যক বীরগণকে সংহার করিয়া সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের নিকট সমুপস্থিত হইলেন। তিনি ভীম ও সাত্যকিকর্ত্তৃক সুরক্ষিত হইয়া প্রজ্বলিত হুতাশনের ন্যায় অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিলেন। আপনার পক্ষীয় বীরগণ অর্জ্জুনকে স্বীয় বীর্য্যপ্রভাবে তদবস্থায় অবস্থান করিতে নিরীক্ষণ করিয়া কিছুতেই সহ্য করিতে পারিলেন না। তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন, কর্ণ, বৃষসেন, শল্য, অশ্বত্থামা ও কৃপ-ইঁহারা রোষাবিষ্ট হইয়া জয়দ্রথকে সমভিব্যাহারে লইয়া অর্জ্জুনকে বেষ্টন করিলেন। সংগ্রামকোবিদ, ব্যাদিতানন অন্তকসদৃশ, নিতান্ত ভয়ঙ্কর, মহাবীর ধনঞ্জয় ধনুষ্টঙ্কার ও তলধ্বনি করিয়া সমরাঙ্গনে যেন নৃত্য করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ নির্ভীকচিত্তে তাহাকে পরিবেষ্টন ও জয়দ্রথকে পশ্চাদ্ভাগে সংস্থাপন করিয়া কৃষ্ণের সহিত উহাকে সংহার করিতে অভিলাষী হইলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় ভগবান্ ভাস্কর লোহিতবর্ণ ধারণ করিলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ তদ্দর্শনে আহ্লাদিত হইয়া সূর্য্যের অচিরাৎ অস্তগমন বাসনা করিয়া ভুজঙ্গাভোগসদৃশ ভুজদ্বারা কার্মুক আনত করিয়া অর্জ্জুনের প্রতি সূৰ্য্যরশ্মিসদৃশ শত শত সায়ক প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। সমরদুর্ম্মদ মহাবীর অর্জ্জুন তাঁহাদের প্রত্যেক শর দ্বিধা, ত্রিধা ও অষ্টধা ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন সিংহলাঙ্গুলকেতু অশ্বত্থামা আপনার শক্তি প্রদর্শন করিবার বাসনায় অর্জ্জুনকে নিবারণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন এবং দশশরে পার্থ ও সাতশরে বাসুদেবকে বিদ্ধ করিয়া জয়দ্রথের রক্ষাৰ্থ রথমার্গে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় অন্যান্য মহারথগণও মহারাজ দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে রথসমূহে অর্জ্জুনকে চতুর্দ্দিকে বেষ্টনপূর্ব্বক সিন্ধুরাজকে রক্ষা করিয়া শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক সায়কনিকর পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় সকলে মহাবীর পার্থের বাহুবল, গাণ্ডীববল ও শরজালের অক্ষয়ত্ব দর্শন করিতে লাগিল। তিনি অস্ত্রপ্রয়োগপূর্ব্বক অশ্বত্থামা ও কৃপের অস্ত্রজাল নিবারণ করিয়া সেই সিন্ধুরাজের রক্ষায় সমুদ্যত কৌরবপক্ষীয় বীরগণের প্রত্যেককে নয় নয় বাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন অশ্বত্থামা পঞ্চবিংশতি, বৃষসেন সাত, দুৰ্য্যোধন বিংশতি, কর্ণ ও শল্য তিন তিন শরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া তর্জ্জনগর্জ্জন ও শরাসন বিধূননপূর্ব্বক তাঁহার চতুর্দ্দিক বেষ্টন করিয়া বারংবার শরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন।

অর্জ্জুন-কর্ণের তুমুল যুদ্ধ

“অনন্তর সেই মহাবীরগণ অবিলম্বে পরস্পরের রথ সংশ্লিষ্ট করিয়া সূর্য্যের অচিরাৎ অস্তাচলগমনাভিলাষে ধনুঃকম্পন ও সিংহনাদ পরিত্যাগ করিয়া, জলধর যেমন পর্ব্বতের উপর জলধারা বর্ষণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ অর্জ্জুনের প্রতি সুতীক্ষ্ণ দিব্যশনিকর নিক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন কৌরবপক্ষীয় বহুসংখ্যক বীরগণকে বিনাশ করিয়া সিন্ধুরাজ জয়দ্রথের নিকট গমন করিলেন। কর্ণ তদ্দর্শনে ভীমসেন ও সাত্যকির সমক্ষেই অর্জ্জুনকে শরনিকরে নিবারণ করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুনও সর্ব্বসৈন্যগণসমক্ষে তাঁহাকে দশশরে বিদ্ধ করিলেন। তৎপরে সাত্যকি তিন, ভীম তিন ও অর্জ্জুন সাতশরে কর্ণকে বিদ্ধ করিলে কর্ণ তাঁহাদিগের প্রত্যেককেই ষষ্টিশরে বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে বহুবীরের সহিত কর্ণের ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল। ঐ সময় আমরা সূতপুত্রের আশ্চর্য্য পরাক্রম অবলোকন করিলাম। তিনি একমাত্র হইয়াও ক্রোধভরে ঐ তিন মহারথকে নিবারণ করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন শতসায়কে কর্ণের মর্ম্মস্থল আহত করিলে তিনি রুধিরদিগ্ধদেহ হইয়া পঞ্চাশৎশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন কর্ণের হস্তলাঘবদর্শনে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার কার্মুক ছেদনপূর্ব্বক সত্বর নয়বাণে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া সংহার করিবার নিমিত্ত সত্বর এক সূৰ্য্যসঙ্কাশ সায়ক নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর অশ্বত্থামা সেই অর্জ্জুনবিসৃষ্ট শর মহাবেগে আগমন করিতেছে দেখিয়া সুতীক্ষ্ণ অর্দ্ধচন্দ্রবাণে উহা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন সূতপুত্ৰ সত্বর অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া সহস্র সহস্র সায়কে পাণ্ডবপ্রধান অর্জ্জুনকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। সমীরণ যেমন শলভশ্রেণী অপসারিত করে, তদ্রূপ প্রবলপ্রতাপ অর্জ্জুন কর্ণবিসৃষ্ট সেই সমস্ত শর তৎক্ষণাৎ নিরাস করিয়া বীরগণসমক্ষে পাণিলাঘবপ্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন; কর্ণও প্রতীকারপ্রদর্শন করিবার অভিলাষে সহস্র সহস্র সায়কে অর্জ্জুনকে আচ্ছন্ন করিলেন। এইরূপে সেই বীরদ্বয় বৃষের ন্যায় নিনাদ করিয়া অজিহ্মগ সায়কনিকর পরিত্যাগপূর্ব্বক আকাশমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া আপনারাও তিরোহিত হইলেন। পরে সেই দুই মহাবীর স্ব স্ব নামোল্লেখপূর্ব্বক পরস্পরকে ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ’ বলিয়া গৰ্জন করিয়া ক্ষিপ্রহস্তে অত্যাশ্চর্য্য ঘঘারতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎকালে সংগ্রামস্থলীতে সকলেই তাঁহাদিগের আশ্চৰ্য্য রূপ অবলোকন এবং বায়ুবেগগামী সিদ্ধ ও চারণগণ তাঁহাদিগের ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সেই বীর। পরস্পরবধার্থী হইয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন।

“তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন আপনার পক্ষীয় ধীরগণকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বীরগণ! কর্ণ আমাকে কহিয়াছেন, তিনি অর্জ্জুনকে বিনাশ না করিয়া কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইবে না, অতএব এক্ষণে তোমরা সাবধানে সূতপুত্রকে রক্ষা কর। হে মহারাজ! দুৰ্য্যোধন বীরগণকে এই কথা কহিতেছেন, এমন সময় শ্বেতবাহন অর্জ্জুন কর্ণের বলবীৰ্য্যদর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া আকর্ণাকৃষ্ট চারিশরে তাঁহার চারি অশ্ব বিনষ্ট ও ভল্লাস্ত্রে সারথিকে রথোপস্থ হইতে নিপাতিত করিয়া আপনার পুত্র রাজা দুর্য্যোধনের সমক্ষেই তাঁহাকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। মহাবীর কর্ণ এইরূপে অর্জ্জুনশরে সমাচ্ছন্ন এবং হতাশ ও হতসারথি হইয়া মোহাবেশপ্রভাবে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা কর্ণকে স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া পুনরায় অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ সময় মদ্ররাজ ত্রিংশৎশরে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলে কৃপাচাৰ্য্য বিংশতিশরে বাসুদেবকে বিদ্ধ করিয়া ধনঞ্জয়ের উপর দ্বাদশ শর নিক্ষেপ করিলেন। তৎপরে সিন্ধুরাজ চারি ও বৃষসেন সাতশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে তাঁহারা প্রত্যেকেই কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে প্রহার করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় অশ্বত্থামাকে চতুঃষষ্টি, মদ্ররাজকে শত ও জয়দ্রথকে দশ এবং বৃসেনকে তিন ও কৃপাচার্য্যকে বিংশতিশরে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিলেন। পরে আপনার পক্ষীয় বীরগণ পার্থের প্রতিজ্ঞাপ্রতিঘাতের নিমিত্ত নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সত্বর তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন।

“অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন কৌরবগণের ত্রাসোৎপাদন করিয়া চতুর্দ্দিকে বারুণাস্ত্র প্রাদুর্ভূত করিলেন। কৌরবেরাও মহার্হরথারোহণপূর্ব্বক শরবর্ষণ করিয়া অর্জ্জুনের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। এইরূপে মহামোহকর অতি ভীষণ সংগ্রাম উপস্থিত হইলে কিরীটী কিছুমাত্র চমৎকৃত না হইয়া শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তিনি কৌরবগণকৃত দ্বাদশবর্ষসমুৎপন্ন ক্লেশপরম্পরা স্মরণপূর্ব্বক রাজ্যলাভার্থী হইয়া গাণ্ডীবনির্মুক্ত শরনিকরে চতুর্দ্দি সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তখন নভোমণ্ডলে উল্কাসকল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল ও বহুসংখ্যক বায়স নরকলেবরে নিপতিত হইতে লাগিল। ব্যোমকেশ যেমন রোষপরবশ হইয়া পিঙ্গলবর্ণজ্যাসম্পন্ন পিনাকদ্বারা শত্রুগণকে সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাবীর অর্জ্জুন গাণ্ডীবশরাসননির্মুক্ত শরনিকরদ্বারা অশ্ব ও গজসমুদয়ে সমারূঢ় কৌরবগণের শরজাল নিরাস করিয়া তাঁহাদিগকে নিপাতিত করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহীপালগণ গুর্ব্বী গদা, লৌহময় অর্গল, অসি, শক্তি ও অন্যান্য নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক সহসা অর্জ্জুনাভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবীর অর্জ্জুন তদ্দর্শনে হাস্যমুখে। যুগান্তকালীন মেঘগম্ভীরনিঃস্বন মহেন্দ্ৰচাপপ্রতিম গাণ্ডীবশরাসন আকর্ষণ করিয়া কৌরবগণকে শরানলে দগ্ধ করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন সেই সমস্ত ধনুর্দ্ধরদিগকে রথ, নাগ ও পদাতিগণের সহিত অস্ত্রবিহীন ও নিপাতিত করিয়া যমরাজ্য বর্দ্ধন করিলেন।”