১১৫. সাত্যকিসহ সমরে কৃতবর্ম্মার পরাজয়

১১৫তম অধ্যায়

সাত্যকিসহ সমরে কৃতবর্ম্মার পরাজয়

হে মহারাজ! আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, তাহা অনন্য মনে শ্রবণ করুন। সেই সমস্ত পাণ্ডব সৈন্য কৃতবর্ম্মার শরপ্রহারে বিদ্রাবিত ও লজ্জায় একান্ত অবনত হইলে আপনার পক্ষীয় বীরেরা অতিশয় হর্ষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তখন যিনি অগাধ সৈন্য সাগর মধ্যে আশ্রয় লাভার্থী পাণ্ডবগণের দ্বীপস্বরূপ হইয়াছিলেন, সেই মহাবীর সাত্যকি কৌরব পক্ষীয় যোদ্ধাদিগের ভয়ঙ্কর সিংহনাদ শব্দ শ্রবণ করিয়া সত্বরে কৃতবর্ম্মার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর কৃতবর্ম্মা সাত্যকির প্রতি নিশিত শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন সাত্যকি সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইয়া চারিশরে কৃতবর্ম্মার চারিঅশ্ব ও শাণিত ভল্লে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর শরজাল বিস্তারপূৰ্ব্বক তাঁহার পৃষ্ঠ রক্ষক ও সারথিকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। এই রূপে মহাবীর সাত্যকি কৃতবর্ম্মাকে রথশূন্য করিয়া সন্নতপর্ব্ব শরদ্বারা তাঁহার সেনাগণকে মর্দ্দন করিতে প্রবৃত হইলেন। সেনাগণ শৈনেয়ের শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। সত্যবিক্রম সাত্যকিও সত্বরে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।

হে মহারাজ! মহাবীর সাত্যকি তৎপরে যেরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি শ্রবণ করুন। তিনি এইরূপে দ্রোণানীক অতিক্রম ও কৃতবর্ম্মাকে পরাজয় করিয়া হৃষ্টমনে সারথিকে কহিলেন, ‘হে সূত! তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে মন্দবেগে রথ চালন কর।’ মহাবীর সাত্যকি সারথিকে প্রথমত এই কথা বলিয়া অসংখ্য রথ, হস্তী, অশ্ব ও পদাতিগণসঙ্কুল কৌরব সৈন্য অবলোকনপূর্ব্বক পুনরায় কহিলেন, ‘হে সারথি! ঐ যে দ্রোণসৈন্যের বামভাগে সুবর্ণধ্বজ পরিশোভিত, মহামেঘ-সন্নিভ-মাতঙ্গারোহী বিপুল সৈন্য সমুদায় অবলোকন করিতেছ, উহারা ত্রিগর্ত্তদেশীয় রাজপুত্র। উহারা সকলেই মহাবল পরাক্রান্ত, বিচিত্র যোদ্ধা ও মহারথ; উহাদিগকে নিবারণ করা অতি দুঃসাধ্য। ঐ রাজপুত্রগণ দুর্য্যোধনের আদেশানুসারে জীবিত নিরপেক্ষ হইয়া রুক্মরথকে অগ্রবর্তী করিয়া আমার সহিত যুদ্ধ করিবার বাসনায় অবস্থান করিতেছেন। অতএব তুমি অবিলম্বে উহাদের নিকট আমার অশ্বচালন কর। আমি দ্রোণ সমক্ষে ত্ৰিগৰ্ত্তদিগের সহিত যুদ্ধ করিব।

সাত্যকিশরে ত্রিগর্ত্তদেশীয় রাজগণের পরাজয়

অনন্তর সারথি সাত্যকির আদেশানুসারে মন্দবেগে অশ্বচালন করিতে আরম্ভ করিল। কুন্দেন্দু-রজতপ্রভ বায়ুবেগগামী সারথির বশীভূত বক্ষমান তুরঙ্গমগণ সাত্যকিকে বহন করিতে লাগিল। তখন বিপক্ষ পক্ষীয় লঘুবেধী মহাবীর সকল তাঁহাকে আগমন করিতে দেখিয়া সুতীক্ষ্ন বিবিধ সায়ক বর্ষণপূর্ব্বক করিসৈন্য দ্বারা তাঁহাকে অবরোধ করিল। তখন মহাবীর সাত্যকি, যেমন গ্রীষ্মবসানে জলদজাল পর্ব্বতের উপর বারি বর্ষণ করে, তদ্রূপ করিসৈন্যের প্রতি শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। মাতঙ্গগণ শিনিবীর-সমীরিত অশনিসমস্পর্শ শরনিকর দ্বারা নিতান্ত নিপীড়িত, শীর্ণদন্ত, ভগ্নকুম্ভ, রুধিরাক্তকলেবর হইয়া রণস্থল পরিত্যাগপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। উহাদের মধ্যে কাহার কর্ণ ছিন্ন ভিন্ন, কাহার মুখ ও শুণ্ড নিকৃত্ত, কাহার নিয়ন্তা নিহত, কাহার পতাকা নিপতিত, কাহার চর্ম্ম ছিন্ন ও ঘণ্টা চূর্ণ, কাহার ধ্বজ দণ্ড খণ্ড খণ্ড এবং কাহারও বা আরোহী বিনষ্ট ও কম্বল পরিভ্রষ্ট হইয়া গেল। এইরূপে সেই সমস্ত জলদোপম নিস্বন মাতঙ্গগণ, সাত্যকির নারাচ, বৎসদন্ত, ভল্ল, অঞ্জলিক, ক্ষুরপ্র ও অর্দ্ধচন্দ্র দ্বারা বিদারিত হইয়া আর্ত্তস্বরে চীৎকার, মল মূত্র পরিত্যাগ ও শোণিত ধারা বর্ষণপূর্ব্বক ইতস্তুত ধাবমান হইল। তন্মধ্যে কতকগুলি ভ্রমণ করিতে লাগিল এবং কতকগুলি স্থলিত, কতকগুলি নিপতিত ও কতকগুলি নিতান্ত ম্লান হইয়া গেল।

এইরূপে সেই করিসৈন্য নিহত হইলে মহাবল পরাক্রান্ত জলসন্ধ পরম যত্ন সহকারে সাত্যকির রথাভিমুখে স্বীয় মাতঙ্গ প্রেরণ করিলেন। ঐ সুবর্ণ বৰ্মধারী কনকাঙ্গদ সুশোভিত, কিরীট ও কুণ্ডলালঙ্কৃত, রক্তচন্দনচর্চিত, মহাবীর, মস্তকে কাঞ্চনময়ী মালা এবং বক্ষস্থলে নিজ ও কণ্ঠসূত্র ধারণপূর্ব্বক মাতঙ্গের উপর উপবিষ্ট হইয়া সুবৰ্ণময় শাসন বিধুনিত করিয়া বিদ্যুদ্দামসম্বলিত অঙ্গুদের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তখন সাত্যকি সেই জলসন্ধের মাতঙ্গকে সহসা আগমন করিতে দেখিয়া যেমন বেলাভূমি মহাসাগরের বেগ অবরোধ করে, তদ্রূপ সেই কবিবরকে তৎক্ষণাৎ নিবারণ করিলেন। মহাবীর জলসন্ধ সাত্যকির শরনিকরে স্বীয় কুঞ্জরকে নিবারিত দেখিয়া ক্রোধে একান্ত অধীর হইয়া উঠিলেন এবং সুতীক্ষ্ন শরনিকরে তাঁহার বক্ষস্থল বিদ্ধ ও নিশিত ভল্লাস্ত্র দ্বারা শরাসন ছিন্ন করিয়া হাস্য মুখে তাঁহাকে নিশিত পাঁচ শরে বিদ্ধ করিলেন। সাত্যকি জলসন্ধের বহুসংখ্য শরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়াও কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি নিতান্ত ব্যস্ত সমস্ত না হইয়া তৎকালে কোন্ শর পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য, তাহা অবধারণ ও অন্য ধনু গ্রহণপূর্ব্বক জলসন্ধকে থাক্ থাক্ বলিয়া আস্ফালন করিতে লাগিলেন এবং হাস্য মুখে তাঁহার বক্ষ স্থলে ষষ্টিশর নিক্ষেপ ও সুতীক্ষ্ন ক্ষুরপ্ৰাস্ত্র দ্বারা তাঁহার কার্ম্মুকের মুষ্ঠিদেশ ছেদনপূর্ব্বক তিন শরে পুনরায় তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন।

সাত্যকি কর্ত্তৃক জলসন্ধ বধ

মহাবীর জলসন্ধ সশর শরাসন পরিত্যাগ করিয়া সত্বরে সাত্যকির প্রতি এক তোমর প্রয়োগ করিলেন। জলসন্ধ নিক্ষিপ্ত তোমর সাত্যকির বাম ভুজ ভেদ করিয়া নিশ্বসন্ত ঘোর উরগের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইল। সত্যবিক্রম সাত্যকি জলসন্ধের শরে নির্ভিন্নবাহু হইয়াও তাঁহাকে সুতীক্ষ্ণ ত্রিংশৎ শরে সমাহত করিলেন। তখন মহাবল জলসন্ধ খড়্গ ও শত চন্দ্রক সঙ্কুল আৰ্ষভচৰ্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক খড়্গ বিঘূর্ণিত করিয়া সাত্যকির অভিমুখে নিক্ষেপ করিলেন। খড়্গ পরিত্যক্ত হইবামাত্র সাত্যকির শরাসন ছেদনপূর্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইয়া অলাত চক্রের ন্যায় সুশোভিত হইতে লাগিল। মহাবীর সাত্যকি তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া সত্বরে শালস্কন্ধ সঙ্কাশ, অশনি সমনিস্বন অন্য শরাসন গ্রহণ ও আকর্ষণ পূর্ব্বক শরদ্বারা জলসন্ধকে বিদ্ধ করিয়া সহাস্য বদনে দুই ক্ষুর দ্বারা তাঁহার বিচিত্র ভূষণ বিভূষিত বাহুদ্বয় ছেদন করিয়া ফেলিলেন। জলসন্ধের অর্গলসদৃশ ভুজযুগল ভূধর হইতে পরিভ্রষ্ট পঞ্চশীর্ষ উরগদ্বয়ের ন্যায় গজপৃষ্ঠ হইতে নিপতিত হইল। তৎপরে মহাবীর সাত্যকি অন্য ক্ষুর দ্বারা জলসন্ধের মনোহর কুণ্ডল যুগল মণ্ডিত দশনরাজি বিরাজিত মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সেই জলসন্ধের ভীমদর্শন কবন্ধ রুধির ধারায় তাঁহার মাতঙ্গকে অভিষিক্ত করিতে লাগিল। অনন্তর মহাবীর সাত্যকি সত্বরে গজস্কন্ধ হইতে মহামাত্রকে নিপাতিত করিলেন। তখন সেই রুধির লিপ্তাঙ্গ মাতঙ্গ সাত্যকির শরজালে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া আর্ত্তস্বর পরিত্যাগ পূর্ব্বক পৃষ্ঠসংশ্লিষ্ট বিলম্বমান আসন বহন ও স্বীয় সৈন্যগণকে মর্দ্দনপূর্ব্বক ধাবমান হইল। হে মহারাজ! আপনার সৈন্যগণ তদ্দর্শনে হাহাকার শব্দ করিতে লাগিল। যোদ্ধা সকল মহাবীর জলসন্ধকে নিহত দেখিয়া জয় লাভে উৎসাহশূন্য ও সমরে পরাঙ্মুখ হইয়া ইতস্তত ধাবমান হইল। ইত্যবসরে মহাবীর দ্রোণ মহাবেগে অশ্বসঞ্চালনপূর্ব্বক সাত্যকির অভিমুখে গমন করিলেন। কৌরবগণও সাত্যকিকে নিতান্ত, উদ্ধত দেখিয়া ক্রোধাবিষ্ট চিত্তে দ্রোণের সহিত ধাবমান হইলেন। তখন মহাত্মা দ্রোণ ও কৌরবগণের সহিত সাত্যকির ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল।