১২১. ধৃতরাষ্ট্রের সবিলাপ যুদ্ধ-প্রশ্ন

১২১তম অধ্যায়

ধৃতরাষ্ট্রের সবিলাপ যুদ্ধ-প্রশ্ন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর সাত্যকি কৌরবসেনা বিদারণ করিয়া অর্জ্জুনসমীপে গমনে প্রবৃত্ত হইলে আমার সেই নির্লজ্জ পুত্রেরা কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিল? সব্যসাচিসদৃশ সাত্যকি সমরে উপনীত হইলে তাহারা মুমূর্ষূ হইয়া কিরূপে সেই দারুণ সমরে ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিল? সেই সমুদয় রণপরাজিত ক্ষত্রিয়গণই বা কি কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করিলেন? আমার পুত্রেরা জীবিত থাকিতে সাত্যকি কিরূপে সমরে অগ্রসর হইল? এই সকল বিষয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর। হে বৎস! সাত্যকি একাকী বিপক্ষপক্ষীয় অসংখ্য মহারথের সহিত সংগ্রাম করিয়া তাহাদিগকে বিনষ্ট করিতেছে, তোমার মুখে এই অদ্ভুত কথা শুনিয়া স্পষ্টই বোধ হইল, আমার পুত্রদিগের প্রতি দৈব প্রতিকূল হইয়াছে। কি আশ্চর্য্য! আমার সৈন্যগণ সমুদয় পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, একমাত্র সাত্যকি অপেক্ষাও কি হীনবল হইল? এক্ষণে স্পষ্টই বোধ হইতেছে, সাত্যকি একাকীই যুদ্ধবিশারদ কৃতী দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরাজিত করিয়া পশুনাশক সিংহের ন্যায় আমার পুত্রদিগকে সংহার করিবে। যখন কৃতবর্ম্মাপ্রমুখ বীরগণ কোনক্রমেই সাত্যকিকে বিনাশ করিতে পারেন নাই, তখন সে নিশ্চয়ই আমার পুত্রগণকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে। যাহা হউক, মহাবীর সাত্যকি যেরূপ সংগ্রাম করিয়াছেন, মহাবলপরাক্রান্ত অর্জ্জুনও ঈদৃশ সংগ্রাম করিতে সমর্থ হয় নাই।”

সঞ্জয়ের সতিরস্কার উত্তর-কৌরবপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! কেবল আপনার কুমন্ত্রণা ও দুর্য্যোধনের দুর্বুদ্ধিই এই তুমুল জনক্ষয়ের কারণ। এক্ষণে যাহা ঘটিয়াছে, সমুদয় কহিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন। সংশপ্তকগণ আপনার পুত্রের শাসনানুসারে যুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত হইয়া পুনরায় সমাগত হইল। তিন সহস্র শক, কাম্বোজ, বাহ্লীক, যবন, পারদ, কুলিঙ্গ, তুঙ্গণ, অম্বষ্ঠ, পিশাচ, বৰ্ব্বর ও পাষাণহস্ত পার্ব্বতীয়গণ এবং পঞ্চশত মহাবীর দুৰ্য্যোধনকে অগ্রবর্তী করিয়া পাবপতনোম্মুখ শলভের ন্যায় সাত্যকির অভিমুখে গমন করিতে লাগিল। ঐ সময় মহারথগণ সহস্র রথ, শত মহারথ, সহস্র হস্তী ও দ্বিসহস্র অশ্বসমভিব্যাহারে বিবিধ শরবর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখীন হইলেন। দুঃশাসনকর্ত্তৃক ঐ সকল বীর সাত্যকিকে বিনাশ করিতে আদিষ্ট হইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিলেন; কিন্তু কি আশ্চৰ্য্য! শিনিপ্রবীর মহাবীর সাত্যকি একাকী সেই বহুসংখ্যক বীরের সহিত যুদ্ধ করিয়া অসংখ্য রথ, হস্তী, গজারোহী, অশ্বারোহী ও দস্যুদিগের প্রাণসংহার করিতে লাগিলেন। তাঁহার শরনিকরবিমথিত চক্র, আয়ুধ, ঈষাদণ্ড, অক্ষ, কুঞ্জর, ধ্বজ, বৰ্ম্ম, চৰ্ম্ম, মাল্য, বস্ত্র, আভরণ ও রথাধঃস্থিত কাষ্ঠ ইতস্ততঃ নিপতিত হওয়াতে সংগ্রামস্থল শরৎকালীন গ্রহগণসমাবৃত নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। অঞ্জন, বামন, সুপ্রতীক, মহাপদ্ম ও ঐরাবত প্রভৃতি মহাগজের বংশে সদ্ভূত পর্ব্বতাকার কুঞ্জরগণ সমরে পতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। মহাবীর সাত্যকি বাণপ্রয়োগানভিজ্ঞ অসংখ্য পার্ব্বতীয়, কাম্বোজ ও বাহকগণ, নানা দেশীয় নানা জাতীয় পদাতিগণ এবং প্রধান প্রধান অশ্বগণের প্রাণসংহার করিলেন।

“এইরূপে সেই সেনাগণ বিনষ্ট হইলে হতাবশিষ্ট সৈন্যগণ পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবীর দুঃশাসন তাহাদিগকে ভগ্ন দেখিয়া দস্যুগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মানভিজ্ঞগণ! তোমরা পলায়ন করিতেছ কেন? নিবৃত্ত হইয়া সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। তাহারা দুঃশাসনের বাক্য শ্রবণ করিয়াও নিবৃত্ত হইল না। তখন তিনি পাষাণবর্ষী পার্ব্বতীয়গণকে যুদ্ধার্থ প্রেরণপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বীরগণ! তোমরা পাষাণযুদ্ধে সুনিপুণ, কিন্তু সাত্যকি ঐ যুদ্ধ কিছুমাত্র অবগত নহে; অতএব তোমরা অবিলম্বে উহাকে পাষাণদ্বারা নিহত কর। কৌরবগণ পাষাণযুদ্ধে অভিজ্ঞ নহেন, তাহারা ঐ যুদ্ধে পারদর্শী হইলে তোমাদের সাহায্য করিতেন। অতএব তোমরা শীঘ্র ধাবমান হও। শৈলবাসিগণ দুঃশাসনকর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া সেই শৈনেয়ভীত সৈন্যগণকে অভয়প্রদানপূর্ব্বক সাত্যকির অভিমুখে ধাবমান হইয়া মাতঙ্গমস্তকসদৃশ উপলখণ্ড গ্রহণ ও উত্তোলনপূর্ব্বক তাঁহার মহা সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। অন্যান্য সৈন্যগণ দুঃশাসনের আদেশক্রমে সাত্যকির বিনাশকামনায় ক্ষেপণীর [পাথরের বড় বড় খণ্ড] দ্বারা দিক্‌সকল আচ্ছাদন করিল। শিনিপুঙ্গব সাত্যকি তাহাদিগকে শিলাবর্ষণপূর্ব্বক আগমন করিতে দেখিয়া নিশিত শর ও নাগসদৃশ নারাচাস্ত্র নিক্ষেপপূর্ব্বক তাহাদের নিক্ষিপ্ত পাষাণসমুদয় চূর্ণ করিতে লাগিলেন। প্রস্তরচুর্ণসকল খদ্যোতরাশির ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া কৌরবপক্ষীয় প্রভূত সেনার প্রাণসংহার করিলে রণক্ষেত্রে হাহাকার শব্দ হইতে লাগিল। ঐ সময় প্রথমতঃ পঞ্চশত শিলাবর্ষী বীরপুরুষ সাত্যকির শরে ছিন্নবাহু হইয়া ধরণীতলে নিপতিত হইল। তৎপরে একাধিক শতসহস্র বীর সাত্যকিকে আঘাত না করিয়াই তাহার শরে ছিন্নবাহু হইয়া পূর্বোক্ত ব্যক্তিদিগের সহিত ভূতলে পতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল। মহাবীর সাত্যকি এইরূপে বহু সহস্র পাষাণযুদ্ধবিশারদ বীরের প্রাণসংহার করিয়া সকলকে আশ্চর্যান্বিত করিলেন।

“তখন শূলধারী অসংখ্য দরদ, তুঙ্গণ, খশ, লম্পক ও পুলিন্দগণ মিলিত হইয়া চতুর্দ্দিকে শিলাবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করিল; মহাবীর সাত্যকিও নারাচাস্ত্রে সেই প্রস্তরসকল ভেদ করিতে লাগিলেন। নিশিতশরে নিভিদ্যমান [নিরতিশয় ভগ্ন] পাষাণের শব্দ নভোমণ্ডলে প্রতিধ্বনিত হইয়া সংগ্রামস্থ রথী, অশ্ব, হস্তী ও পদাতিমণ্ডলকে ভীত ও বিদ্রাবিত করিল। মনুষ্য, অশ্ব ও গজসমূহ শিলাচূর্ণে সমাচ্ছন্ন ভ্রমরদংশিতের ন্যায় রণক্ষেত্রে অবস্থান করিতে অসমর্থ হইল। তখন হতাবশিষ্ট, রুধিরাপ্লুত ছিন্নমস্তক কুঞ্জরগণ সাত্যকির রথসমীপ পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিল। পর্ব্বসময়ে সাগরের যেরূপ শব্দ হইয়া থাকে, সাত্যকিশরাৰ্দিত কৌরবসেনাগণের সেইরূপ মহাকোলাহল হইতে লাগিল।

পলায়মান দুর্য্যোধনসৈন্যের দ্রোণাশ্রয় গ্রহণ

“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর দ্রোণাচার্য্য সেই তুমুল শব্দ শ্রবণ করিয়া সারথিকে কহিলেন, “হে সূত! সাত্বতবংশীয় মহারথ সাত্যকি কোপপূর্ণ হইয়া কৌরবসেনাগণকে বহুধা বিদারণপূর্ব্বক সমরক্ষেত্রে সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় বিচরণ করিতেছে। যে স্থানে ঐ তুমুল শব্দ শ্রুত হইতেছে, বোধ হয়, সাত্যকি সেই স্থানে পাষাণবর্ষী যোধগণের সহিত সমাগত হইয়াছে। অতএব অবিলম্বে তথায় রথসঞ্চালন কর। ঐ দেখ, পলায়মান অশ্বগণ অস্ত্রহীন, বৰ্ম্মবিহীন রথীগণকে সমরক্ষেত্র হইতে অপনীত করিতেছে; সারথিরা কোনক্রমেই উহাদিগকে সংযমন করিতে সমর্থ হইতেছে না।’ সারথি শস্ত্রধরাগ্রগণ্য দ্রোণাচার্য্যের বাক্যশ্রবণানন্তর কহিল, ‘আয়ুষ্মন! ঐ দেখুন, কৌরবপক্ষীয় সেনা ও যোধগণ সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক ভয়ে চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইতেছে। এদিকে বলবান পাঞ্চালগণ পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হইয়া আপনার বিনাশকামনায় আগমন করিতেছে, সাত্যকিও অতি দূরদেশে গমন করিয়াছে। অতএব এক্ষণে তাহার নিকটে গমন অথবা এই স্থানে অবস্থান, এই উভয়ের যাহা কর্ত্তব্য হয়, তাহা স্থির করুন। তাহাদের উভয়ের এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এই সময়ে মহাবীর সাত্যকি সেই রথীগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। রথীগণ সমরে সাত্যকির শরে পীড়িত হইয়া তাহার রথসম্মুখভাগ পরিত্যাগপূর্ব্বক দ্রোণসৈন্যমধ্যে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। দুঃশাসন যেসকল রথীসমভিব্যাহারে সংগ্রামে গমন করিয়াছিলেন, তাহারাও শঙ্কিতচিত্তে দ্রোণাচার্য্যের রথ লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইল।”