১১৯. সমরজয়ী সাত্যকির অর্জ্জুনাভিমুখে গমন

১১৯তম অধ্যায়

সমরজয়ী সাত্যকির অর্জ্জুনাভিমুখে গমন

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! বৃষ্ণিপুঙ্গব মহামতি, সাত্যকি, এইরূপে সংগ্রামে সুদর্শনকে নিহত করিয়া পুনরায় সারথিকে কহিলেন, ‘সারথে! যখন শর শক্তিরূপ তরঙ্গ, খড়্গরূপ মৎস্য ও গদা রূপ গ্রাহযুক্ত, অসংখ রথনাগাশ্ব সঙ্কীর্ণ, বিবিধ আয়ুধের নিস্বন ও বাদিত্রের নিনাদসম্পন্ন, যোধগণের অসুখস্পর্শ, জিগীষুদিগের দুর্দ্ধর্ষ, রাক্ষস সদৃশ জলসন্ধ সৈন্যে সমাবৃত দ্রোণানীকরূপ মহাসাগর অতিক্রম করিয়াছি, তখন এই অবশিষ্ট সেনা, অল্পসলিল সম্পন্ন ক্ষুদ্র নদীর ন্যায় বোধ হইতেছে। অতএব তুমি শীঘ্র অশ্বচালন কর। আমি অবিলম্বে উহা অতিক্রম করিব। যখন দুর্জ্জয় দ্রোণাচার্য্য ও হার্দ্দিক্যকে পরাজয় করিয়াছি, তখন অর্জ্জুনকে সম্মুখস্থিত বোধ হইতেছে। এই সমুদায় সৈন্য অবলোকন করিয়া আমার কিছুমাত্র ত্রাস হইতেছে না। উহারা প্রদীপ্ত পাবক দগ্ধ শুষ্ক তৃণের ন্যায় আমার শরে দগ্ধ হইতেছে। ঐ দেখ, পাণ্ডবপ্রধান অর্জ্জুন যে পথ দিয়া গমন করিয়াছেন, তথায় অংসখ্য হস্তী, অশ্ব ও রথ নিপতিত রহিয়াছে। ঐ কৌরব সেনাগণ অর্জ্জুনের শরে নিপীড়িত হইয়া সমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিতেছে। তুরঙ্গম মাতঙ্গ ও রথ সমুদায় মহাবেগে গমন করাতে কৌশেয়ারুণ রজোরাশি উদ্ধূত হইয়াছে এবং মহাতেজ সম্পন্ন গাণ্ডীবের গভীর নিনাদ শ্রুতিগোচর হইতেছে। অতএব বোধ করি, মহাবীর ধনঞ্জয় অনতিদূরে অবস্থান করিতেছেন। হে সারথে! এক্ষণে যেরূপ নিমিত্ত সকল দৃষ্ট হইতেছে, তাহাতে নিশ্চয়ই বোধ হয়, দিনমণি অস্তাচলগত না হইতে হইতেই অৰ্জন সিন্ধুরাজকে বিনাশ করিবেন। এক্ষণে যে স্থানে অরাতি সৈন্যগণ, দুর্য্যোধন প্রভৃতি বীরগণ, যুদ্ধদুৰ্ম্মদ ক্রুরকর্ম্মা বৰ্মধারী কাম্বোজগণ, ধনুর্ব্বাণধারী যবনগণ এবং বিবিধাস্ত্রধারী শক, কিরাত, দরদ, বর্ব্বর ও তাম্রলিপ্তক প্রভৃতি ম্লেচ্ছগণ আমার সহিত সমরার্থী হইয়া অবস্থান করিতেছে, তুমি সেই স্থানে অশ্ব চালন কর। তুমি মনে মনে স্থির করিয়া রাখ যে, আমি ঐ সমুদায় বীরগণকে রথ, নাগ ও অশ্বের সহিত সংহার করিয়া এই বিষম শঙ্কট হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছি।’

সারথি সাত্যকি বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, হে বার্ষ্ণেয়! যদ্যপি জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম, মহারথী দ্রোণাচাৰ্য্য, কৃপাচার্য্য বা মদ্রেশ্বর শল্য ক্রুদ্ধ হইয়া আপনার অভিমুখে আগমন করেন, তথাপি আপনার আশ্রয়ে আমার কিঞ্চিত্মাত্রও শঙ্কা হয় না। অদ্য আপনি সংগ্রামে যুদ্ধদুৰ্ম্মদ ক্রুরকর্ম্মা বৰ্মধারী কাম্বোজগণ, ধনুর্ব্বাণধারী প্রহার নিপুণ যবনগণ এবং নানাস্ত্রধারী কিরাত, দরদ, বৰ্ব্বর ও তাম্রলিপ্তক প্রভৃতি ম্লেচ্ছগণকে পরাভূত করিয়াছেন, সুতরাং আমার ভয় সঞ্চারের বিষয় কি? পূর্ব্বে আমি কোন সংগ্রামেই কখন ভীত হই নাই, তবে কি নিমিত্ত আজি এই ক্ষুদ্র যুদ্ধে আমার ভয়ের উদয় হইবে? যাহা হউক, এক্ষণে আজ্ঞা করুন, আপনাকে কোন্ পথ দিয়া ধনঞ্জয়ের সমীপে সমানীত করিব। হে আয়ুষ্মন্! আপনি কাহাদের উপর ক্রুদ্ধ হইয়াছেন? কাহাদের মৃত্যু উপস্থিত হইয়াছে? কাহারা শমন ভবনে গমন করিতে বাসনা করিয়াছে! কাহারা আপনাকে কালান্তক যমের ন্যায় অবলোকন করিয়া পলায়ন করিবে? যমরাজ কাহাদিগকে স্মরণ করিয়াছেন? আজ্ঞা করুন, তাহাদের অভিমুখে রথচালনা করি।’

সাত্যকি কহিলেন, ‘হে সূত! তুমি শীঘ্র রথ চালন কর। বাসব যেরূপে দানবদিগকে সংহার করিয়াছেন, সেইরূপ অদ্য আমি এই মুণ্ডিত মুণ্ড কম্বোজগণকে বিনাশপূর্ব্বক প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করিয়া একান্ত প্রিয় অর্জ্জুনের সহিত সাক্ষাৎ করিব। অদ্য দুৰ্য্যোধনাদি কৌরবগণ এই সমুদায় সৈন্যকে নিহত দেখিয়া সমরে আমার পরাক্রম অনুভব করিবেন। অদ্য শরবিক্ষত কৌরব সেনার করুণ বিলাপ শ্রবণ করিয়া দুৰ্য্যোধনকে অবশ্যই অনুতাপিত হইতে হইবে। অদ্য আমি পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ শ্বেতাশ্ব মহাত্মা অর্জ্জুনকে তদুপদিষ্ট পথ প্রদর্শন করিব। অদ্য রাজা দুৰ্য্যোধন সহস্র সহস্র বীর পুরুষকে আমার বাণে বিগতাসু অবলোকন করিয়া অবশ্যই অনুতাপিত হইবেন। অদ্য কৌরবগণ আমার বাণবর্ষণে লঘুহস্ততা ও শরাসনের অলাতচক্র সদৃশ আকার দর্শন করিবেন। অদ্য দুৰ্য্যোধন আমার বাণবিদ্ধ রুধিরস্রাবী সৈনিকগণের বিনাশ দর্শনে বিষন্ন হইয়া সমরে আমার ভয়ঙ্কর রূপ দর্শনপূর্ব্বক অবশ্যই মনে করিবেন যে, দ্বিতীয় অর্জ্জুন অবনিতে অবতীর্ণ হইয়াছেন। অদ্য আমি কৌরবপক্ষীয় সহস্র সহস্র নৃপের প্রাণ সংহার করিয়া দুৰ্য্যোধনকে অনুতাপিত এবং পাণ্ডবগণের প্রতি ভক্তি ও স্নেহের নিদর্শন প্রদর্শিত করিব। অদ্য কৌরবগণ আমার বলবীৰ্য্য ও কৃতজ্ঞতা সবিশেষ জ্ঞাত হইবেন।’

সাত্যকি-শরে দুর্য্যোধনপক্ষীয় যবনসৈন্য বধ

হে মহারাজ! সাত্যকির সারথি তাঁহার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া শশাঙ্ক সদৃশ শ্বেতবর্ণ সাধুবাহী শিক্ষিত অশ্বগণকে চালন করিতে লাগিল। অশ্বগণ, আকাশ পান করিবার নিমিত্তই যেন, বায়ুবেগে ধাবমান হইল। তখন যুযুধান অবিলম্বেই যবনগণ সমীপে উপনীত হইলেন। তাহারা অনেকে মিলিত হইয়া লঘুহস্ততা প্রদর্শন পূর্ব্বক সেনাগ্রবর্তী সাত্যকির উপর অসংখ্য সায়ক নিক্ষেপ করিতে লাগিল। শৈনেয় নতপর্ব্ব বাণ দ্বারা অর্দ্ধপথে সেই শত্রুপক্ষীয় শরজাল ছেদন পূর্ব্বক সুবর্ণপুঙ্খ অজিহ্মগ নিশিত শরনিকরে যবনগণের ভুজ ও মস্তক সমুদায় ছেদন করিলেন। সাত্যকির শরনিকর তাহাদের লৌহময় ও কাংস্যময় বর্ম্ম এবং দেহ ভেদ করিয়া পাতালতলে প্রবিষ্ট হইল। এইরূপে শত শত যবন সাত্যকির শরাঘাতে গতাসু হইয়া বসুধাতলে পতিত হইতে লাগিল। তিনি শরাসন আকর্ণ আকর্ষণপূর্ব্বক শরবর্ষণ করিয়া এক এক বারে পাঁচ, ছয়, সাত বা আট জন যবনকে ভেদ করিতে আরম্ভ করিলেন। সহস্র সহস্র কাম্বোজ, শক, শবর, কিরাত ও বর্ব্বর সাত্যকির শরে জীবন পরিত্যগ পূর্ব্বক ধরাশয্যা গ্রহণ করিলে সমরস্থল তাঁহাদিগের মাংস ও শোণিতে কর্দ্দমময় হইয়া গেল। দস্যুগণের ছিন্নকেশ ও দীর্ঘশ্মশ্রু সম্পন্ন, বিবর্হ বিহঙ্গম সদৃশ মস্তক-সমুদায়ে রণস্থল পরিব্যাপ্ত হইল। রুধিরাভিষিক্ত সৰ্বাঙ্গ অসংখ্য কবন্ধ উত্থিত হওয়াতে সমরক্ষেত্র শোণ মেঘসমাচ্ছন্ন নভোমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। এইরূপে সেই মহাবীরগণ সাত্যকি অশনিসমস্পর্শ অপূর্ব্ব অজিহ্মগামী শরনিকরে নিহত ও নিপতিত হইয়া বসুন্ধরা সমাবৃত করিল। হতাবশিষ্ট বর্ম্মধারী যোধগণ সম্ভগ্ন ও বিচেতনপ্রায় হইয়া অশ্বপৃষ্ঠে পার্ষ্ণি ও কশাঘাতপূর্ব্বক শঙ্কিতচিত্তে মহাবেগে পলায়ন করিতে লাগিল। হে মহারাজ! এই রূপে পুরুষব্যাঘ্ৰ সত্যবিক্রম সাত্যকি দুর্জ্জয় কাম্বোজ, শক ও যবনগণকে বিভ্রাবণপূর্ব্বক বিজয় লাভ করিয়া সারখিকে রথ চালনের অনুমতি করিলেন। তখন সংগ্রাম দর্শনার্থী গন্ধৰ্ব্ব ও চারণগণ সেই অর্জ্জুনের পৃষ্ঠ রক্ষাৰ্থ গমনোদ্যত যুযুধানের অলৌকিক কাৰ্য্য ও অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিয়া ভূরি ভূরি ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। কৌরব পক্ষীয়েরাও বারংবার তাঁহার কাৰ্য্যের প্রশংসা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।