১৩৬. ভীমকর্ণের পুনরায় ভীষণ যুদ্ধ-কর্ণপরাজয়

১৩৬তম অধ্যায়

ভীমকর্ণের পুনরায় ভীষণ যুদ্ধ-কর্ণপরাজয়

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহারথ কর্ণ আপনার আত্মজগণকে ভীমশরে বিনষ্ট দেখিয়া ক্রোধাবিষ্ট ও আত্মরক্ষায় হতাশ হইলেন এবং তাঁহারই প্রত্যক্ষে আপনার পুত্রগণ নিহত হইতেছেন, এই নিমিত্ত তিনি তৎকালে আপনাকে অপরাধী বোধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ভীম পূর্ব্ববৈর স্মরণপূর্ব্বক রোষপরবশ হইয়া সসম্ভ্রমে কর্ণের প্রতি নিশিত শরনিকর পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কর্ণ প্রথমতঃ তাঁহাকে পাঁচবাণে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় হাস্যমুখে স্বর্ণপুঙ্খ শিলাশিত সপ্ততিসায়কে বিদ্ধ করিলেন। ভীমসেন সেই কর্ণনির্মুক্ত শরনিকর লক্ষ্য না করিয়াই তাঁহার উপর আনতপর্ব্ব শত শর নিক্ষেপপূর্ব্বক পুনরায় সুতীক্ষ্ণ পাঁচবাণে তাঁহার মর্ম্মস্থল বিদ্ধ করিয়া একভল্লে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন কর্ণ নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া অন্য কার্মুক গ্রহণপূর্ব্বক শরজালে ভীমসেনকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর ক্রোধভরে কর্ণের সারথি ও অশ্বগণকে সংহার করিয়া পুনর্ব্বার হাস্যমুখে তাঁহার স্বর্ণপৃষ্ঠ কার্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর মহারথ কর্ণ রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া ক্রোধভরে গদাগ্রহণপূর্ব্বক ভীমের প্রতি প্রয়োগ করিলেন। মহাবীর ভীম সেই কর্ণনির্মুক্ত গদা আগমন করিতে দেখিয়া সসৈন্যসমক্ষে শরনিকরে নিবারণপূর্ব্বক কর্ণকে সংহার করিবার মানসে অজস্র সহস্র সহস্র শর প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ শতজালদ্বারা ভীমের শরনিকর নিরাশ করিয়া অসংখ্য সায়ক নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার কবচ ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং সৈন্যগণসমক্ষে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া পঞ্চবিংশতি ক্ষুদ্রকাস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইল।

কর্ণসাহায্যকারী চিত্রাদি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রবধ

“তখন মহাবীর বৃকোদর ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কর্ণের প্রতি নতপর্ব্ব নয় বাণ নিক্ষেপ করিলেন। সেই সমস্ত সুতীক্ষ্ণ শর কর্ণের কবচ ও দক্ষিণভুজ ভেদ করিয়া পন্নগগণ যেরূপ বল্মীকমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইল। এইরূপে মহাবীর কর্ণ ভীমশরে সমাচ্ছন্ন হইয়া পুনরায় সমরে পরাঙ্মুখ হইলেন। তদ্দর্শনে রাজা দুৰ্য্যোধন ভ্রাতৃগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভ্রাতৃগণ! তোমরা যত্নবান্ হইয়া সত্বর কর্ণের রথাভিমুখে ধাবমান হও। হে মহারাজ! তখন আপনার আত্মজ চিত্র, উপচিত্র, চিত্রাক্ষ, চারুচিত্র, শরাসন, চিয়ায়ুধ ও চিত্ৰবর্ম্মা—ইঁহারা জ্যেষ্ঠভ্রাতা দুৰ্য্যোধনের আজ্ঞাপ্রাপ্তিমাত্র শরবর্ষণপূর্ব্বক ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ভীম তাঁহারা উপস্থিত না হইতে হইতেই তাঁহাদিগকে এক এক শরে বিনাশ করিলেন। তাঁহারা তৎক্ষণাৎ বাতভগ্ন মহীরুহের ন্যায় সমরভূমিতে নিপতিত হইলেন। তখন মহাবীর কর্ণ আপনার মহারথ পুত্রগণকে বিনষ্ট দেখিয়া অশ্রুপূর্ণলোচনে বিদুরের সেই সমস্ত বাক্য স্মরণ করিতে লাগিলেন। পরে তিনি পুনরায় যথাবিধি সুসজ্জিত অন্য রথে আরোহণ করিয়া সত্বর যুদ্ধার্থ ভীমের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন ঐ মহাবীরদ্বয় স্বর্ণপুঙ্খ নিশিত শরজালে পরস্পরকে বিদ্ধ করিয়া দিনকরকরজালসংবলিত জলধরযুগলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর বৃকোদর রোষপরবশ হইয়া প্রভাভাস্বর নিশিত ষট্‌ত্রিংশৎ ভল্লদ্বারা কর্ণের কবচ ছেদন করিয়া ফেলিলেন, সূতপুত্ৰ কর্ণও আনতপর্ব্ব পঞ্চাশৎশরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন সেই রক্তচন্দনচর্চিত বীরদ্বয় শরব্রণাঙ্কিত [বাণাঘাতজনিত ক্ষতযুক্ত] ও শোণিতসিক্তকলেবর হইয়া উদিত চন্দ্ৰসূৰ্য্যের ন্যায় শোভাপ্রাপ্ত হইলেন। তৎকালে তাঁহাদের বর্ম্ম ছিন্নভিন্ন ও দেহরুধিৱেক্ষিত হওয়াতে তাঁহারা নির্মোকমুক্ত উরগদ্বয়ের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন।

“অনন্তর সেই বীরদ্বয় দশনপ্রহারে সমুদ্যত ব্যাঘ্রদ্বয়ের ন্যায় পরস্পরকে শস্ত্রপ্রহার ও জলধারাবর্ষী জলধরযুগলের ন্যায় পরস্পরের উপর অনবরত শরধারা বিসর্জিত করিতে লাগিলেন এবং মাতঙ্গদ্বয় যেমন বিশাল দশনদ্বারা পরস্পরের দেহ ভেদ করিয়া থাকে, তদ্রূপ তাঁহারা সায়ক বর্ষণপূর্ব্বক পরস্পরের দেহ ভেদ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহারা কখন সিংহনাদ, কখন শরবর্ষণ, কখন ক্রীড়া, কখন রোষকষায়িতলোচনে পরস্পরকে অবলোকন ও কখন বা রথদ্বারা মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। সেই সিংহসদৃশ মহাবলপরাক্রান্ত বীরদ্বয় গাভীলাভার্থ সমুৎসুক বৃষভদ্বয়ের ন্যায় গভীর নিনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক ইন্দ্র ও বৈরোচনের ন্যায় ঘোরতর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ সময় মহাবীর ভীমসেন শরাসন আকর্ষণ করিয়া বিদ্যুদ্দামসম্বলিত অম্বুদের ন্যায় সমরাঙ্গনে শোভা পাইতে লাগিলেন। তিনি বারিধারাসদৃশ সুপুঙ্খ শরনিকরদ্বারা পর্ব্বতসদৃশ কর্ণকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তাঁহার কার্মুকনিঃস্বন অশনির্ঘোষের ন্যায় শ্রবণগোচর হইল। হে মহারাজ! তখন আপনার পুত্রগণ ভীমের সেই অদ্ভুত বলবীৰ্য্য অবলোকন করিতে লাগিলেন। এইরূপে মহাবীর ভীম, অর্জ্জুন, কেশব, সাত্যকি ও চক্ররক্ষকদ্বয়কে আনন্দিত করিয়া কর্ণের সহিত অতি ভীষণ সমরানল প্রজ্বলিত করিলেন। আপনার আত্মজগণ ভীমের অসাধারণ পরাক্রম, ভুজবীৰ্য্য ও ধৈর্য্য অবলোকন করিয়া একান্ত বিমনায়মান হইলেন।”