১৩৫. ভীমহস্তে কর্ণপরাজয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ত্রাস

১৩৫তম অধ্যায়

ভীমহস্তে কর্ণপরাজয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ত্রাস

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! অকিঞ্চিত্বর পুরুষকারে ধিক! আমি দৈবকেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া বিবেচনা করি। মহাবীর কর্ণ কৃষ্ণের সহিত পাণ্ডবগণকে রণস্থলে পরাজয় করিবার নিমিত্ত উৎসাহ প্রদর্শন করিয়া থাকে; কিন্তু সে ভীমের শরে নিপীড়িত হইয়া তাঁহাকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইল না। কর্ণের সমান যোদ্ধা পৃথিবীমধ্যে আর কেহই নাই, আমি এই কথা দুর্য্যোধনের মুখে বারংবার শ্রবণ করিয়াছি। মন্দবুদ্ধিপরায়ণ দুর্য্যোধন পূর্ব্বে আমাকে কহিয়াছিল, ‘কর্ণ মহাবলপরাক্রান্ত, দৃঢ়ধন্বা ও ক্লমশূন্য; তিনি আমার সহায় হইলে হতবীর্য্য বিচেতনপ্রায় পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, সুরগণও আমাকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবেন না। কিন্তু এক্ষণে সে কর্ণকে নিৰ্ব্বিষ ভুজঙ্গের ন্যায় পরাজিত ও রণস্থল হইতে পলায়িত নিরীক্ষণ করিয়া কি করিতেছে? কি আশ্চর্য্য! দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন মোহাবিষ্ট হইয়া যুদ্ধে একান্ত অপটু একমাত্র দুর্মুখকে হুতাশনমুখে পতঙ্গের ন্যায় সমরে প্রেরণ করিয়াছিল। মহাবীর অশ্বত্থামা, মদ্ররাজ ও কৃপ—ইহারা কর্ণের সহিত সমবেত হইয়া ভীমের সমক্ষে অবস্থান করিতে সমর্থ হয়েন না। ইঁহারা সেই কালান্তকমসদৃশ ভীমকর্ম্মা ভীমসেনের অযুত নাগতুল্য বল ও ক্রুর ব্যবসায় অবগত হইয়া কি নিমিত্ত তাহার রোষানল প্রজ্বলিত করিয়া দিলেন? কিন্তু একমাত্র কর্ণ স্বীয় বাহুবল অবলম্বনপূর্ব্বক ভীমকে অনাদর করিয়া তাহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। অসুরবিজয়ী সুররাজের ন্যায় ভীমসেন তাঁহাকে পরাজয় করিয়াছে। অতএব ভীমকে সমরে পরাজিত করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। যে ভীম ধনঞ্জয়কে অন্বেষণ করিবার নিমিত্ত দ্রোণকে প্রমথিত করিয়া আমার সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছে, বজ্রপ্রহারে উদ্যত দেবরাজ ইন্দ্রের সম্মুখীন অসুরের ন্যায় কে জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক তাহার সমক্ষে গমন বা অবস্থান করিতে সমর্থ হইবে? মনুষ্য কৃতান্তনিকেতনে গমন করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হইতে পারে; কিন্তু ভীমের হস্তে নিপতিত হইলে কিছুতেই প্রতিগমন করিতে সমর্থ হয় না। যাহারা মোহাবিষ্ট হইয়া ক্রোধপরায়ণ ভীমের প্রতি ধাবমান হইয়াছিল, সেই সমস্ত অল্পতেজঃসম্পন্ন মনুষ্যেরা বহ্নিমধ্যে প্রবিষ্ট পতঙ্গের ন্যায় বিনষ্ট হইয়াছে। ভীমসেন রোষপরবশ হইয়া কৌরবগণসমক্ষে সভামধ্যে আমার পুত্রগণকে বধ করিবার নিমিত্ত যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, দুঃশাসন দুৰ্য্যোধনের সহিত তাহা স্মরণ ও কর্ণকে পরাজিত নিরীক্ষণ করিয়া ভয়প্রযুক্ত ভীমের সহিত যুদ্ধ করিতে বিরত হইয়াছে। মূঢ়মতি দুৰ্য্যোধন সভামধ্যে বারংবার কহিয়াছিল, ‘আমি কর্ণ ও দুঃশাসনের সহিত মিলিত হইয়া পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিব।’ কিন্তু সে এক্ষণে ভীমের বাহুবলে কর্ণকে পরাজিত ও রথশূন্য নিরীক্ষণ এবং কৃষ্ণের সন্ধিপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যানবিষয় স্মরণ করিয়া সাতিশয় সন্তপ্ত হইতেছে। সে স্বদোষে ভ্রাতৃগণকে ভীমসেনশরে নিহত দেখিয়া অতিশয় আকুলিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই। যাহা হউক, এক্ষণে কোন্ জীবিতলাভার্থী ব্যক্তি সাক্ষাৎ কৃতান্তসদৃশ নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট ভীমায়ুধ ভীমের প্রতিকূলে গমন করিবে? বোধ হয়, মনুষ্য বাড়বানলমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে মুক্তিলাভ করিতে পারে, কিন্তু ভীমের সম্মুখে গমন করিলে তাহার আর কিছুতেই পরিত্রাণ নাই। অর্জ্জুন, কেশব, সাত্যকি ও পাঞ্চালগণ রোষপরবশ হইলে প্রাণরক্ষণেও নিরপেক্ষ হইয়া থাকেন; অতএব এক্ষণে নিশ্চয়ই আমার পুত্রগণের প্রাণসংশয় হইয়া উঠিয়াছে।”

ভীমহস্তে ধৃতরাষ্ট্রপুত্ৰ দুর্ম্মৰ্ষণাদি বধ

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনি এক্ষণে এই লোকক্ষয় উপস্থিত দেখিয়া শোক করিতেছেন, কিন্তু আপনিই ইহার মূল কারণ সন্দেহ নাই। আপনি পুত্রগণের বাক্যে বৈরানল প্রজ্বলিত করিয়াছেন এবং মনুষ্য যেমন হিতকর ঔষধপানে একান্ত পরাঙ্মুখ হয়, তদ্রূপ আপনিও সুহৃদগণের বাক্যে অনাদর প্রদর্শন করিয়াছেন। হে নরোত্তম! আপনি স্বয়ং নিতান্ত দুর্জ্জয় কালকূট পান করিয়াছেন, এক্ষণে তাহার সমগ্র ফল প্রাপ্ত হউন। যোদ্ধৃগণ সাধ্যানুসারে যুদ্ধ করিতেছে, তথাপি আপনি তাহাদের নিন্দায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। যাহা হউক, এক্ষণে যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছে, তাহা আনুপূর্বিক বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন।

‘অনন্তর আপনার আত্মজ দুর্ম্মর্ষণ, দুঃসহ, দুর্ম্মদ, দুৰ্দ্ধর ও জয়—এই পাঁচ সহোদর কর্ণের পরাজয়দর্শনে একান্ত অসহিষ্ণু হইয়া ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং তাহাকে পরিবেষ্টন করিয়া শলভশ্রেণীর ন্যায় শরনিকরে দশদি সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীম সেই সমস্ত দেবরূপী রাজকুমারগণকে সহসা সমাগত দেখিয়া হাস্যমুখে প্রতিগ্ৰহ করিলেন। তখন কর্ণ দুর্ম্মৰ্ষণপ্রমুখ আপনার আত্মজগণকে ভীমের সম্মুখবৰ্ত্তী দেখিয়া সুবৰ্ণপুঙ্খ শিলানিশিত সুতীক্ষ্ন বিশিখ বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার সন্নিহিত হইলেন। ঐ সময় মহাবীর ভীম আপনার পুত্রগণকর্ত্তৃক নিবারিত হইয়াও সত্বর কর্ণের প্রতি গমন করিলেন। তখন আপনার পুত্রগণ কর্ণের চতুর্দ্দিকে অবস্থানপূর্ব্বক ভীমের প্রতি সন্নতপর্ব্ব শরজাল নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন তদ্দর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া পঞ্চবিংশতি বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক সেই দুর্ম্মৰ্ষণপ্রমুখ পঞ্চ ভ্রাতাকে অশ্ব ও সারথির সহিত শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। বিচিত্র কুসুমসুশোভিত পাদপদল যেমন সমীরণপ্রভাবে ভগ্ন হইয়া যায়, তদ্রূপ তাঁহারা সারথিদিগের সহিত গতাসু হইয়া রথ হইতে ভূতলে নিপতিত হইলেন। হে মহারাজ! মহাবীর ভীম এইরূপে কর্ণকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া আপনার আত্মজগণকে বিনাশ করিলেন দেখিয়া সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইল। তখন সূতপুত্র কর্ণ ভীমের নিশিতশরে নিবারিত হইয়া তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন; ভীমও রোষারুণলোচনে শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক বারংবার তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন।”