১৪৭. কৃপাচার্য্য-অশ্বত্থামার যুগপৎ অর্জ্জুন-আক্রমণ

১৪৭তম অধ্যায়

কৃপাচার্য্য-অশ্বত্থামার যুগপৎ অর্জ্জুন-আক্রমণ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর সিন্ধুরাজ নিহত হইলে কৌরবপক্ষীয় বীরগণ কি করিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর কৃপাচার্য্য জয়দ্রথকে নিহত দেখিয়া রোষাবিষ্টচিত্তে ধনঞ্জয়ের উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন; অশ্বত্থামাও ঐ সময় রথারোহণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলেন। এইরূপে মহারথ কৃপাচার্য্য ও অশ্বত্থামা উভয়ে দুই দিক হইতে অতি তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহারথশ্রেষ্ঠ মহাবাহু অর্জ্জুন তাঁহাদের শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া অত্যন্ত কাতর হইলেন। তখন তিনি গুরু কৃপাচার্য্য ও গুরুপুত্র অশ্বত্থামাকে বিনাশ করিবার বাসনায় আচার্য্যের ন্যায় বিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক স্বীয় অস্ত্রদ্বারা কৃপ ও অশ্বত্থামার শরবেগ নিবারণ করিলেন; তৎপরে তাঁহাদের নিধনবাসনা পরিত্যাগপূর্ব্বক মন্দবেগে শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুননির্মুক্ত শরসমুদয় অনবরত গাত্রে নিপতিত হওয়াতে তাঁহারা দুইজনে অতিশয় কাতর হইয়া উঠিলেন। কৃপাচার্য্য পার্থশরপ্রভাবে মূর্চ্ছিত হইয়া রথোপরি অবসন্ন হইলেন। সারথি তাঁহাকে বিহ্বল দেখিয়া মৃতজ্ঞানে রথ লইয়া পলায়ন করিল; তদ্দর্শনে অশ্বত্থামাও ভীত হইয়া অর্জ্জুনের নিকট হইতে প্রস্থান করিলেন।

কৃপাচার্য্যপীড়নে অর্জ্জুনের সবিলাপ খেদ

“ঐ সময় মহাধনুর্দ্ধর ধনঞ্জয় শরপীড়িত কৃপাচার্য্যকে রথোপরি মুর্চ্ছিত অবলোকন করিয়া বিলাপ করিয়া অপূর্ণনয়নে দীনবচনে কহিতে লাগিলেন, ‘বিজ্ঞবর বিদুর কুলান্তক পাপাত্মা দুৰ্য্যোধন জন্মিবামাত্র মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে কহিয়াছিলেন যে, এই কুলাঙ্গারকে বিনাশ করুন। ইহা হইতেই কৌরবগণের মহাভয় উপস্থিত হইবে। এখন সত্যবাদী বিদুরের সেই কথা সপ্রমাণ হইতেছে। দুরাত্মা দুর্য্যোধনের নিমিত্তই আজ গুরুকে শরশয্যায় শয়ান দেখিতে হইল। অতএব ক্ষত্রিয়দিগের আচার ও বলবীর্য্যে ধিক্। আমার সদৃশ কোন ব্যক্তি আচার্য্যের অনিষ্টাচরণে প্রবৃত্ত হয়? মহাত্মা কৃপ ঋষিপুত্র, আমার আচার্য্য ও দ্রোণের প্রিয়সখা; আমি ইচ্ছা না করিয়াও উহাকে শরনিকরে নিপীড়িত করিলাম। উনি আমার বাণে নিপীড়িত ও রথোপরি অবসন্ন হইয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ করিতেছেন। উনি আমায় অসংখ্যশরে নিপীড়িত করিলেও আমার উপেক্ষা করা উচিত; কিন্তু আমি বিপরীতাচরণ করিয়াছি। এক্ষণে উনি আমার শরে মূর্চ্ছিত হইয়া আমাকে পুত্রশোক অপেক্ষা অধিকতর দুঃখগ্রস্ত করিলেন। হে কৃষ্ণ! ঐ দেখ, কৃপাচার্য্য দীনভাবে রথোপরি অবসন্ন রহিয়াছেন। যাঁহারা কৃতবিদ্য হইয়া গুরুকে অভিলষিত দ্রব্য প্রদান করেন, তাঁহারা দেবত্ব লাভ করিয়া থাকেন, আর যে দুরাত্মারা কৃতবিদ্য হইয়া শিক্ষকদিগকে বিনাশ করে, তাহারা নিরয়গামী হয়। অতএব আজ আমি শরবর্ষণে আচাৰ্য্যকে রথমধ্যে অবসন্ন করিয়া নরকগমনের কাৰ্য্য করিলাম। কৃপাচার্য্য আমার অস্ত্রশিক্ষা সময়ে কহিয়াছিলেন যে, হে কুরুবংশোদ্ভব! তুমি কখনই গুরুকে প্রহার করিও না। কিন্তু আজ আমি তাঁহাকে শরাঘাত করিয়া তাঁহার বাক্য উল্লঙ্ঘন করিলাম। এক্ষণে রণে পরাঙ্মুখ পূজ্যতম গৌতমপুত্রকে প্রণাম করি, আমি উহাকে প্রহার করিয়াছি; আমাকে ধিক!

কৃষ্ণকর্ত্তৃক কর্ণসহ যুদ্ধেছু অর্জ্জুনকে নিবারণ

“হে মহারাজ! অর্জ্জুন এইরূপে বিলাপ করিতেছেন, এমন সময় মহাবীর কর্ণ সিন্ধুরাজকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া ধনঞ্জয়ের প্রতি ধাবমান হইলেন। যুধামন্যু, উত্তমৌজা ও সাত্যকি কর্ণকে অর্জ্জুনের সমীপে আগমন করিতে দেখিয়া সহসা তাঁহার প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ অর্জ্জুন হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া সাত্যকির অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তদ্দর্শনে ধনঞ্জয় হাস্যবদনে কৃষ্ণকে কহিলেন, ‘হে হৃষীকেশ! ঐ দেখ, মহাবীর সূতপুত্র সাত্যকির অভিমুখে গমন করিতেছে। ঐ মহাবীর কখনই ভূরিশ্রবার বিনাশ সহ্য করিতে পারিবে না। অতএব শীঘ্র কর্ণের সমীপে রথসঞ্চালন কর। কর্ণ যেন সাত্যকিকে ভূরিশ্রবার পদবীতে [ভূরিশ্রবার তুল্য অবস্থায় মৃত্যুপথে] প্রেরণ না করে।’

“মহাবীর অর্জ্জুন এইরূপ কহিলে মহাবাহু কেশব তাঁহাকে তত্ত্বালোচিত কথা কহিতে লাগিলেন, “হে অর্জ্জুন। মহাবাহু সাত্যকি একাকীই কর্ণের সহিত সংগ্রাম করিতে সমর্থ; তাহাতে আবার যুধামন্যু ও উত্তমৌজা উহার সহায় রহিয়াছে। বিশেষতঃ এখন কর্ণের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়া তোমার কর্ত্তব্য নহে। উহার নিকট প্রজ্বলিত মহোল্কাসদৃশ বাসবদত্ত শক্তি বিদ্যমান রহিয়াছে। ঐ মহাবীর তোমার সংহারার্থই যত্নপূর্ব্বক ঐ শক্তি রাখিয়াছে। অতএব কর্ণ এক্ষণে সাত্যকির নিকট গমন করুক। হে অর্জ্জুন! তুমি যে সময় ঐ দুরাত্মাকে তীক্ষ্ণশরে ভূতলে নিপাতিত করিবে, আমি তাহা বিলক্ষণ অবগত আছি।”

কর্ণ-সাত্যকির তুমুল যুদ্ধ—কৌরবপরাজয়

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর ভূরিশ্রবা ও সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ নিহত হইলে কর্ণের সহিত সাত্যকির কিরূপ সংগ্রাম হইল? সাত্যকি রথবিহীন হইয়াছিলেন; এক্ষণে তিনি কোন্ রথে আরোহণ করিয়া যুদ্ধ করিলেন? আর পাণ্ডবপক্ষীয় চক্ররক্ষক যুধামন্যু ও উত্তমৌজাই বা কিরূপে সংগ্রাম করিলেন? এই সমুদয় বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন কর।”

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আমি আপনার নিকট আপনারই দুরাচারজনিত সমরবৃত্তান্ত বৰ্ণন করিতেছি, আপনি ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক শ্রবণ করুন। মহাত্মা বাসুদেব অতীত ও অনাগত বিষয় বর্ত্তমানের ন্যায় প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন। যূপকেতু ভূরিশ্রবা যে সাত্যকিকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবেন, ইহা পূর্ব্বেই তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হইয়াছিল। তিনি তন্নিবন্ধন নিজ সারথি দারুককে রথ সুসজ্জিত করিয়া রাখিতে আদেশ করিয়াছিলেন। হে কুরুরাজ! দেবতা, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, উরগ, রাক্ষস ও মনুষ্যগণের মধ্যে মহাত্মা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে পরাজয় করিতে পারে, এমন কেহই নাই। পিতামহ প্রভৃতি দেবগণ ও সিদ্ধগণ ঐ দুই মহাত্মার অতুল প্রভাবের বিষয় সম্যক বিদিত আছেন। যাহা হউক, এক্ষণে যেরূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, আপনি অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন।

“মহামতি বাসুদেব মহাবীর সাত্যকিকে রথশূন্য ও কর্ণকে যুদ্ধে সমুদ্যত অবলোকন করিয়া ঋষভম্বরে [নিসাদ আদি সপ্তস্বরের অন্যতম] শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। দারুক সেই শঙ্খধ্বনিশ্রবণে কৃষ্ণের সঙ্কেত বুঝিতে পারিয়া অবিলম্বে সাত্যকির নিকট গরুড়ধ্বজ রথ উপনীত করিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি কেশবের আদেশানুসারে কামগামী স্বর্ণালঙ্কারভূষিত শৈব্য, সুগ্রীব, মেঘপুষ্প ও বলাহকনামক চারি অশ্বসংযোজিত সূৰ্য্যাগ্নিসঙ্কাশ বিমানপ্রতিম রথে আরোহণ করিয়া সায়কবর্ষণপূর্ব্বক কর্ণের প্রতি ধাবমান হইলেন। ঐ সময় চক্ররক্ষক যুধামন্যু ও উত্তমৌজাও ধনঞ্জয়ের রথ পরিত্যাগ করিয়া কর্ণের প্রতি দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ রোষভরে শরবর্ষণপূর্ব্বক সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! তৎকালে সাত্যকির সহিত কর্ণের যেরূপ সংগ্রাম হইল, ঐরূপ যুদ্ধ ভূলোক বা দ্যুলোকে দেবতা, গন্ধর্ব্ব, অসুর, উরগ ও রাক্ষসগণমধ্যেও কদাচ উপস্থিত হয় নাই। সেই উভয়পক্ষীয় চতুরঙ্গবল তকালে ঐ বীরদ্বয়ের মোহকর কার্য্য অবলোকন করিয়া যুদ্ধ হইতে বিরত হইল। তাঁহারা সেই বীরদ্বয়ের অলৌকিক সংগ্রাম এবং রথস্থ দারুকের গতপ্রত্যাগত, আবৃত্ত, মণ্ডল ও সন্নিবর্ত্তন প্রভৃতি গতি প্রদর্শনসহকারে সারথ্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান নিরীক্ষণ করিয়া বিষ্মিত হইলেন। দেব, দানব ও গন্ধর্ব্বগণ নভোমণ্ডলে অবস্থান করিয়া অনন্যমনে ঐ উভয় বীরের ঘোরতর যুদ্ধ সন্দর্শন করিতে লাগিলেন।

“তখন মিত্ৰাৰ্থ যুদ্ধে প্রবৃত্ত সেই মহাবলপরাক্রান্ত বীরদ্বয় পরস্পরের প্রতি শরনিকর বর্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। অমরসঙ্কাশ মহাবীর কর্ণ ভূরিশ্রবা ও জলসন্ধের বিনাশ সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া শরবর্ষণপূর্ব্বক সাত্যকিকে মর্দ্দিত করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি শোকাবেগবশতঃ ভীষণ ভুজগের ন্যায় নিশ্বাসপরিত্যাগপূর্ব্বক রোষারুণনেত্রে সাত্যকিকে দগ্ধ করিয়াই যেন বারংবার মহাবেগে ধাবমান হইলেন। সাত্যকি তাঁহাকে ক্রোধাবিষ্ট দেখিয়া মাতঙ্গ যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী মাতঙ্গকে দন্তাঘাত করিয়া থাকে, তদ্রূপ অনবরত শরাঘাত করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে সেই পরাক্রমশালী বীরদ্বয় ব্যাঘ্রদ্বয়ের ন্যায় পরস্পর মিলিত হইয়া শরনিকরে পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন।

“অনন্তর মহাবীর সাত্যকি শরজালদ্বারা বারংবার কর্ণের কলেবর ভেদ করিয়া ভল্লাস্ত্রে তাঁহার সারথিকে রথোপস্থ হইতে নিপাতিত করিলেন এবং নিশিতশরনিকরে তাঁহার শ্বেতবর্ণ চারি অশ্ব বিনষ্ট ও শতশরে রথধ্বজদণ্ড শতধা খণ্ড খণ্ড করিয়া আপনার আত্মজ দুৰ্য্যোধনের সমক্ষেই তাঁহাকে রথহীন করিলেন। অনন্তর আপনার পক্ষীয় মদ্ররাজ শল্য, কর্ণাত্মজ বৃষসেন ও দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা চতুর্দ্দিক হইতে সাত্যকিকে পরিবেষ্টন করিতে লাগিলেন। তখন সমস্ত সৈন্য আকুল হইয়া উঠিল; কেহ কাহাকে জ্ঞাত হইতে সমর্থ হইল না। সৈন্যগণ কর্ণকে রথশূন্য নিরীক্ষণ করিয়া হাহাকার করিতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর কর্ণ মহারাজ দুর্য্যোধনের সহিত বাল্যাবধি সৌহার্দ্য স্মরণ ও তাঁহার নিকট রাজ্যপ্রাপ্তিহেতু পাণ্ডবপরাজয়বিষয়ে যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন তাহা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করিয়া সাত্যকির শরজালে সমাচ্ছন্ন ও একান্ত বিহ্বল হইয়া নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে দুর্য্যোধনের রথে আরোহণ করিলেন।

“মহাবীর সাত্যকি এইরূপে কর্ণকে রথশূন্য করিয়া দুঃশাসনপ্রমুখ শুরগণকে বিরথ ও বিহ্বল করিতে লাগিলেন; কিন্তু ভীমের পূর্ব্বকৃত প্রতিজ্ঞা স্মরণপূর্ব্বক কিছুতেই তাঁহাদের প্রাণনাশ করিলেন না। আর মহাবীর অর্জ্জুন পুনর্দ্যূতসময়ে কর্ণকে সংহার করিবেন বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, তন্নিবন্ধন সাত্যকি তাঁহার বিনাশেও ক্ষান্ত হইলেন। কর্ণপ্রমুখ মহারথগণ সাত্যকিকে বধ করিবার নিমিত্ত বারংবার যত্ন করিয়াছিলেন, কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। ঐ মহাবীর ধর্ম্মরাজের হিতানুষ্ঠানার্থে জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া একমাত্র ধনুঃপ্রভাবে অশ্বত্থামা, কৃতবর্ম্মা ও অন্যান্য মহারথগণকে পরাজিত করিলেন। এইরূপে বাসুদেব ও অর্জ্জুনসদৃশ মহাবলপরাক্রান্ত সাত্যকি হাস্যমুখে আপনার পক্ষীয় সৈন্যগণকে যমালয়ে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এই ভূমণ্ডলে কৃষ্ণ, অর্জ্জুন ও সাত্যকি—এই তিনজনই মহাধনুর্দ্ধর, ইহাদের তুল্য ধনুর্দ্ধর আর কাহাকেও উপলব্ধ হয় না।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! বলবীৰ্য্যদর্পিত, দারুকসারথিসমবেত, বাসুদেবসদৃশ মহাবীর সাত্যকি কৃষ্ণের অজেয় রথে আরোহণপূর্ব্বক কর্ণকে রথশূন্য করিয়া কি আর কোন রথে সমারূঢ় হইয়াছিলেন? ইহা শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়াছে; অতএব আমার সমক্ষে উহা কীৰ্ত্তন কর। আমার মতে সাত্যকির পরাক্রম নিতান্ত অসহ্য।”

সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যাহা কহিলেন, কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। কিয়ৎক্ষণ পরে দারুকের অনুজ যথাবিধি সুসজ্জিত, লৌহ ও কাঞ্চনময় পট্টে বিভূষিত, বিচিত্র কূবরযুক্ত, তারাসহস্রখচিত, সিংহধ্বজ ও পতাকাসম্পন্ন, সুবর্ণালঙ্কৃত, বায়ুবেগগামী অশ্বগণে সংযুক্ত মেঘগম্ভীরনিঃস্বন অন্য এক রথ সাত্যকির নিকট আনয়ন করিল। মহাবীর সাত্যকি উহাতে আরোহণ করিয়া কৌরবসৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। কৃষ্ণসারথি দারুক স্বেচ্ছানুসারে কৃষ্ণের সন্নিধানে গমন করিলেন। তখন কর্ণের এক সারথিও শঙ্খ ও গোক্ষীরের ন্যায় পাণ্ডুরবর্ণ, কাঞ্চনবর্ম্মধারী, বেগগামী অশ্বগণে সংযুক্ত, সুবর্ণকক্ষাযুক্ত ধ্বজদণ্ডে সুশোভিত, যন্ত্রবদ্ধ, পতাকায় সমলঙ্কৃত, বহুবিধ অস্ত্রশস্ত্র ও পরিচ্ছদে পরিপূর্ণ রথ সমানীত করিল। মহাবীর কর্ণ তাহাতে আরোহণ করিয়া বিপক্ষগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! আপনি যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, তৎসমুদয় কহিলাম। এক্ষণে আপনার দুর্নীতিজনিত বিনাশবৃত্তান্তও শ্রবণ করুন। এই যুদ্ধে বিচিত্ৰযোদ্ধা ভীমসেন আপনার দুর্মুখপ্রমুখ একত্রিংশৎ পুত্রকে এবং সাত্যকি ও অর্জ্জুন ভীষ্ম ও ভগদত্তপ্রমুখ শত শত বীরগণকে বিনাশ করিয়াছেন। হে মহারাজ! কেবল আপনার দুর্ম্মন্ত্রণাপ্রভাবেই এইরূপ লোকক্ষয় হইতেছে।”