৬৮তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনের প্রতি গান্ধারীর দুর্ব্বাক্যপ্রয়োগ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি সর্ব্বলোকাধিপতি মাধবকে কিরূপে অবগত হইলে, আমিই বা কি নিমিত্ত তাঁহাকে বিদিত হইতে সমর্থ হইতেছি না? তুমি এক্ষণে ইহা কীর্ত্তন কর।” সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনি বিদ্যাশূন্য বিষয়ান্ধকারে অন্ধপ্রায় হইয়া আছেন; এই নিমিত্ত কেশবকে অবগত হইতে সমর্থ হইতেছেন না। আমি বিদ্যাসম্পন্ন; সেই বিদ্যাপ্রভাবে যুগত্ৰয়ের অধিষ্ঠান, বিশ্বের কর্ত্তা, স্বতঃসিদ্ধ প্রাণীগণের উৎপত্তি ও লয়স্থান, ভগবান জনাৰ্দনকে বিদিত হইতেছি।” ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি যে ভক্তিপ্রভাবে ভগবান কেশবকে অবগত হইতেছ, তাহা কিরূপ?” সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার মঙ্গল হউক। আমি মায়ার সেবা ও বৃথা ধর্মের অনুষ্ঠান করি নাই; কেবল ভক্তিবলে বিশুদ্ধভাবসম্পন্ন হইয়া শাস্ত্রে তাঁহাকে বিদিত হইতেছি।”
তখন ধৃতরাষ্ট্র দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “বৎস! সঞ্জয় আমাদের হিতকারী; অতএব তুমি কেশবের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার শরণাপন্ন হও।” দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “তাত! যদি কেশব অর্জ্জুনের সহিত সৌহৃদ্য সংস্থাপন করিয়া সমস্ত লোক সংহারার্থ সমুদ্যত হয়েন, তথাপি আমি এখন তাহার শরণাপন্ন হইব না।” রাজা ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “প্রিয়ে! তোমার পুত্ৰ দুৰ্য্যোধন ঈৰ্ষাপরায়ণ, অভিমানী ও উপদেশগ্ৰহণ-পরাঙ্মুখ; অতএব উহাকে নরকে গমন করিতে হইবে।” গান্ধারী কহিলেন, “রে দুরাশয়! তুমি ঐশ্বৰ্য্য, জীবন ও পিতামাতাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক শক্ৰগণের প্রীতিবৰ্দ্ধন এবং আমাকে শোকসাগরে বিসর্জ্জন করিয়া ভীমের হস্তে কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক পিতার বাক্য স্মরণ করিবে।”
ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি কৃষ্ণমাহাত্ম্যশ্রবণে সঞ্জয়ের উপদেশ
অনন্তর ব্যাসদেব কহিলেন, “মহারাজ! তুমি আমার প্রিয়পাত্র, এক্ষণে আমি কৃষ্ণের বিষয় কীর্ত্তন করি, শ্রবণ কর। তাহা হইলে তোমার মহদ্ভয় নিবারণ হইবে। সঞ্জয় তোমাকে শ্রেয়স্কর কাৰ্য্যে নিয়োগ করিতেছে; এ ব্যক্তি চিরন্তন হৃষীকেশকে সবিশেষ অবগত হইয়াছে। যেসকল ব্যক্তি ক্রোধ ও অমর্ষপরায়ণ; আপনার ধনে অসন্তুষ্ট ও কামপ্রভৃতি বিবিধ পাশে সংযত, তাহারা অন্ধকর্ত্তৃক নীয়নান অন্ধের ন্যায় স্বীয় কর্ম্মবলে নীত হইয়া বারংবার যমের বশবর্ত্তী হইয়া থাকে। এই জ্ঞানমার্গ ব্ৰহ্মলোকের হেতুভূত; মনীষিগণ এই পথ অবলম্বন করিয়া সংসারপাশ হইতে বিমুক্ত হইয়া থাকেন। মহৎলোক কদাচ তাহাতে সংযুক্ত হয়েন না।” ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি যে পথ অবলম্বনপূর্ব্বক হষীকেশকে প্রাপ্ত হইয়া মোক্ষলাভ করিতে সমর্থ হই, সেই নির্ভর পথ কি প্রকার? তুমি তাহা আমার নিকট কীর্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “নরনাথ! অর্জিতাত্মা ব্যক্তি সেই নিত্যসিদ্ধ জনাৰ্দনকে কদাচ অবগত হইতে সমর্থ হয় না। ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ না করিয়া কেবল ক্রিয়াকলাপদ্বারা তাঁহাকে লাভ করা নিতান্ত দুষ্কর। অতি প্রবল ইন্দ্ৰিয়গণের নিগ্রহ, অপ্ৰমাদ ও অহিংসা, এই কয়েকটি জ্ঞানের কারণ; অতএব আপনি আলস্যশূন্য হইয়া ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহে যত্নবান হউন। আপনার বুদ্ধি যেন কদাচ প্রচ্যুত না হয়। আপনি বুদ্ধিবৃত্তি বশীভুত করুন। ব্রাহ্মণগণ ইন্দ্ৰিয়নিগ্রকেই জ্ঞানশব্দে নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। মনীষিগণ এই জ্ঞানরূপ পথই অবলম্বন করেন। হে মহারাজা! ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ ব্যতিরেকে কদাচ কেশবকে প্রাপ্ত হওয়া যায় না। তিনি শাস্ত্র ও যোগবলে প্ৰসন্ন হইয়া তত্ত্বজ্ঞান প্ৰদান করিয়া থাকেন।”