১৭৭. অর্থাভাবে মঙ্কিমহর্ষির অশান্তি—ত্যাগে শান্তি

১৭৭তম অধ্যায়

অর্থাভাবে মঙ্কিমহর্ষির অশান্তি—ত্যাগে শান্তি

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যদি কেহ কৃষি, বাণিজ্য এবং যজ্ঞ ও দানাদি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে ইচ্ছা করিয়া, ধন লাভ করিতে না পারিয়া ধনতৃষ্ণায় অভিভূত হয়, তাহা হইলে কিরূপ কার্য্যদ্বারা তাহার সুখলাভ হইতে পারে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! যে ব্যক্তি সৰ্ব্ববিষয়ে সমভাবে দৃষ্টিপাত, ঐশ্বর্য্যাদিলাভে অনাস্থা, সত্যবাক্য প্রয়োগ, বৈরাগ্য অবলম্বন ও কৰ্ম্মানুষ্ঠানের বাসনা পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই সুখী বলিয়া পরিগণিত হয়েন। পণ্ডিতেরা ঐ পাঁচটিকেই মোক্ষলাভের উপায় বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন। ঐ সমুদয় ভিন্ন স্বর্গ, ধৰ্ম্ম ও উৎকৃষ্ট সুখলাভের উপায়ান্তর নাই।

“মহাত্মা মঙ্কি নিৰ্ব্বেদ [অনুতাপ জাত অনাস্থা] উপস্থিত হইলে যাহা কহিয়াছিলেন, এক্ষণে সেই পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ঐ মহাত্মা বারংবার ধনলাভের চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। পরিশেষে তিনি কোনপ্রকারে কিঞ্চিৎ ধনদ্বারা দুইটি গোবৎস ক্রয় করিলেন। ঐ বৎসদ্বয় মঙ্কির আবাসে অতি যত্নসহকারে প্রতিপালিত হইত। একদা হতভাগ্য মঙ্কি উহাদিগকে ভূমিকর্য্যণে শিক্ষিত করিবার অভিলাষে যুগকাষ্ঠে [জোয়ালে] সম্যকরূপে যোজিত করিয়া ক্ষেত্রাভিমুখে গমন করিতেছেন, এমন সময় উহারা পথিমধ্যে এক উষ্ট্রকে শয়ান দেখিয়া সহসা বন্ধনছেদনপূৰ্ব্বক মহাবেগে তাহার স্কন্ধদেশে নিপতিত হইল। উষ্ট্র সেই বৎসদ্বয়ের দৌরাত্ম্যে যারপরনাই ক্রোধাবিষ্ট হইয়া গাত্রোত্থানপূর্ব্বক তাহাদিগকে বারংবার উৎক্ষেপণ করিতে করিতে মহাবেগে গমন করিতে লাগিল। তখন মঙ্কি সেই বৎসদ্বয়কে পরমশত্রু উষ্টকর্ত্তৃক হ্রিয়মাণ ও মৃতপ্রায় দেখিয়া কহিলেন, ‘যে অর্থ দৈবকর্ত্তৃক সম্পাদিত না হয়, সুনিপুণ ব্যক্তি বিশেষরূপে যত্ন করিলেও তাহা সুসিদ্ধ করিতে পারে না। আমি নানাবিধ চেষ্টাদ্বারা অর্থলাভে কৃতকার্য্য হইতে না পারিয়া পরিশেষে এই গোবৎসদ্বয় ক্রয় করিয়া ধনলাভের বাসনা করিয়াছিলাম। এক্ষণে এ বিষয়েও এই দৈবদুর্ঘটনা উপস্থিত হইল। আমার এই প্রিয় বৎসদ্বয় উৎপথগামী উষ্ট্রের গমনদোষে বারংবার উৎক্ষিপ্ত মণিদ্বয়ের ন্যায় লম্বমান হইতেছে। এক্ষণে দৈব ব্যতীত এই দুর্ঘটনার অন্য কোন কারণই লক্ষিত হইতেছে না। সুতরাং এ বিষয়ে পৌরুষপ্রকাশ করা নিতান্ত নিষ্ফল। যদিও লোকদৃষ্টান্তে পুরুষকারের অস্তিত্ব স্বীকার করা যায়, কিন্তু বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে উহা যে দৈবায়ত্ত, তাহা অবশ্যই বোধগম্য হইবে। যাহা হউক, সুখাভিলাষী পুরুষের বৈরাগ্য আশ্রয় করাই অবশ্য কর্ত্তব্য। বৈরাগ্যসম্পন্ন ব্যক্তি এককালে অর্থসাধনের আশা পরিত্যাগ করিয়া স্বচ্ছন্দে নিদ্রাসুখ অনুভব করিতে পারেন। মহাত্মা শুকদেব সমস্ত পরিত্যাগপূৰ্ব্বক স্বীয় পিতার আবাস হইতে অরণ্যে গমন করিবার সময় এই কয়েকটি অতি উত্তম কথা কহিয়া গিয়াছেন যে, যিনি স্বীয় সমুদয় অভীষ্টলাভে সমর্থ হয়েন আর যিনি সমুদয় অভীষ্ট পরিত্যাগ করিতে পারেন, এই উভয়ের মধ্যে ভোগবিরত শেষোক্ত ব্যক্তিই অপেক্ষাকৃত প্রশংসনীয়। পূৰ্ব্বে কেহই ভোগাভিলাষের সীমা অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় নাই। যাহারা নিতান্ত মূঢ়, তাহাদিগেরই শরীর ও জীবনরক্ষায় মহাযত্ন উপস্থিত হইয়া থাকে।

অতএব হে অর্থকামুকমন! তুমি আশা হইতে নিবৃত্ত হও এবং বৈরাগ্য আশ্রয়পূৰ্ব্বক শান্তি অবলম্বন কর। পূৰ্ব্বে তুমি বারংবার আশাকর্ত্তৃক বঞ্চিত হইয়াছ, তথাপি বৈরাগ্য অবলম্বন কর নাই। এক্ষণে যদি তোমার আমাকে বিনাশ না করিয়া আমার সহিত ক্রীড়া করিবার বাসনা থাকে, তাহা হইলে আর আমাকে বৃথা ধনলোভ প্রদর্শন করিও না। তুমি বারংবার ধনসঞ্চয় করিয়াও উহা রক্ষা করিতে পার নাই, তথাপি তোমার ধনাশা নিবৃত্ত হইতেছে না। আর কবে উহা তিরোহিত হইবে? হায়! আমার কি মূর্খতা! আমি এখনও তোমার ক্রীড়াপাত্র হইয়া এই স্থানে অবস্থান করিতেছি। কি পূৰ্ব্বে, কি এক্ষণে, কখনই কেহ আশার পরাকাষ্ঠা-সন্দর্শনে সমর্থ হয় নাই। অতএব আশা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়ঃ। আশা ত্যাগ করিলে আর পরের অনুবর্তী হইতে হয় না। যাহা হউক, এক্ষণে সমুদয় পরিত্যাগ করাতে আমার মোহনিদ্রা ভঙ্গ হইয়াছে।

‘হে বাসনা! আমার নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে, তোমার হৃদয় বজ্রের ন্যায় নিতান্ত সুকঠিন। নচেৎ তোমার উপর শত শত অনিষ্টপাত হইলেও উহা শতধা বিদীর্ণ হইল না কেন? আমি তোমাকে এবং তোমার প্রিয়বস্তুসকল অবগত আছি। এক্ষণে আমি তোমার প্রিয়চিকীর্ষু [হিতাভিলাষী] হইয়া পরমাত্মা হইতে পরম সুখলাভ করিব। তুমি সঙ্কল্প হইতে সম্ভূত হইয়া থাক; অতএব আমি সঙ্কল্পত্যাগ করিলেই তুমি সমূলে উন্মূলিত হইবে। অর্থস্পৃহা কখনই সুখাবহ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে না। অর্থলাভ হওয়া নিতান্ত দুষ্কর। অর্থ হস্তগত হইলে চিন্তাতরঙ্গে নিমগ্ন হইতে হয় এবং অধিকৃত ধনের নাশ হইলে উহা মৃত্যুতুল্য ঘোরতর দুঃখাবহ হইয়া উঠে। ফলতঃ অন্যের নিকট যাচ্ঞা করিয়াও অর্থলাভ না হইলে লোকের যে দুঃখ উপস্থিত হইয়া থাকে, বোধহয়, উহা অপেক্ষা গুরুতর ক্লেশ আর কিছুই নাই। কোনক্রমে অর্থলাভ হইলেও তাহাতে লোকের তৃপ্তিলাভ হয় না; প্রত্যুত ক্রমে ক্রমে অধিক লাভের আশা পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকে। আমি বিলক্ষণ বুঝিয়াছি যে, ধনতৃষ্ণাই আমার বিনাশের মূল; অতএব হে বাসনা! তুমি আমাকে পরিত্যাগ কর। যে পঞ্চভূত আমার দেহকে আশ্রয় করিয়া অবস্থান করিতেছে, তাহারা আমার দেহ হইতে যেখানে ইচ্ছা হয়, গমন করিয়া সুখে বাস করুক। অহঙ্কারাদি কাম ও লোভের অনুগত। তাহাদিগের প্রতি আমার কিছুমাত্র প্রীতি নাই; অতঃপর আমি তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া একাগ্রতা আশ্রয় করিব। আমি হৃৎপদ্মে সৰ্ব্বভূত ও আত্মাকে অবলোকনপূৰ্ব্বক যোগবিষয়ে বুদ্ধি, শ্রবণাদি জ্ঞানে একাগ্রতা ও ব্রহ্মে মনঃসংযোগ করিয়া অনাসক্তচিত্তে নিরুপদ্রবে পরমসুখে এই জগতে বিহার করিব।

‘বাসনা! আর তুমি আমাকে কার্য্যে প্রেরণ করিয়া দুঃখে নিপাতিত করিতে সমর্থ হইবে না। তৃষ্ণা, শোক ও শ্রম প্রভৃতি সমুদয়ই তোমা হইতে সম্ভূত হইয়া থাকে। অতএব আমি অবশ্যই তোমাকে পরিত্যাগ করিব। ধনের অনেক দোষ। মনুষ্যের ধনক্ষয় হইলে সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকতর দুঃখ ভোগ করিতে হয়। জ্ঞাতি ও মিত্রগণ নিৰ্দ্ধন ব্যক্তিকে নিরন্তর অবজ্ঞা ও অপমান করে। অর্থে যে অল্পমাত্র সুখলাভ হইয়া থাকে, তাহাও দুঃখজালে জড়িত। যাহার ধন থাকে, দস্যগণ তাহাকে নিরন্তর বিবিধ ক্লেশ প্রদানপূর্ব্বক উদ্বেলিত [উদ্বিগ্ন] করে। যাহা হউক, এক্ষণে আমি বহু কালের পর জানিলাম যে, অর্থলালসা অতিশয় ক্লেশকর। অতএব হে বাসনা! তুমি আর আমাকে বৃথা ক্লেশ প্রদান করিও না। তুমি অনলের ন্যায় শরীর দগ্ধ করিয়া থাক; তুমি নিতান্ত অদূরদর্শী বালক ও দুরাকাঙ্ক্ষ [দুষ্টবাসনাযুক্ত]; তোমার যখন যাহাতে অভিরুচি হয়, তুমি তৎক্ষণাৎ তাহাতে অনুরক্ত হইতে আমাকে অনুরোধ কর। কোন বস্তু সুলভ আর কোন্ বস্তু দুর্ল্লভ, তাহা তোমার কিছুমাত্র বোধ নাই। পাতালের ন্যায় তোমাকে কোনরূপেই পরিপূর্ণ করা যায় না। তুমি পুনরায় আমাকে দুঃখে পতিত করিতে অভিলাষ করিতেছ; অতএব আজ অবধি আমি এককালে তোমার সহবাসে বিরত হইলাম। আজ দ্রব্যনাশনিবন্ধন দুঃখ উপস্থিত হওয়াতে আমি সহসা সমুদয় সুখভোগে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়াছি; সুতরাং আর তোমাকে চরিতার্থ করিব না। ইতিপূৰ্ব্বে অজ্ঞানবশতঃ তোমার প্রীতিসাধন করিতে গিয়া যারপরনাই ক্লেশ ভোগ করিয়াছি, কিন্তু এক্ষণে ধননাশনিবন্ধন বৈরাগ্য অবলম্বনপূৰ্ব্বক তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া নিশ্চিন্তচিত্তে পরমসুখে গমন করিব। আর তুমি আমার সহবাস বা আমার সহিত ক্রীড়া করিতে সমর্থ হইবে না। এখন কেহ অপমান বা হিংসা করিলে আমি তাহার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন এবং কেহ বিদ্বেষপূৰ্ব্বক অপ্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিলে তাহাতে অনাদর প্রদর্শনপূৰ্ব্বক প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিব। নিত্য যাহা লাভ হইবে, তাহাতেই পরিতৃপ্ত হইয়া জীবন ধারণপূৰ্ব্বক সুখী হইব। তুমি আমার পরমশত্ৰু, সুতরাং আর তোমাকে চরিতার্থ করিব না; এক্ষণে বৈরাগ্য, নিবৃত্তি, তৃপ্তি, শান্তি, সত্য, দম, ক্ষমা, লোভ, তৃষ্ণা ও দীনতা আমাকে পরিত্যাগ করিয়া দূরে পলায়ন করুক। আমি এখন লোভ পরিত্যাগপূর্ব্বক সুখী হইয়াছি; আর লোভের বশীভূত হইয়া অজিতেন্দ্রিয়ের ন্যায় দুঃখভোগ করিব না।

‘যিনি যে পরিমাণে কাম পরিত্যাগ করেন, তাঁহার সেই পরিমাণে সুখলাভ হয়। কামাধীন ব্যক্তি প্রতিনিয়ত দুঃখই ভোগ করে। রজোগুণপ্রভাবেই কামের উৎপত্তি হয় এবং কাম ও ক্রোধবশতঃ দুঃখ, নির্লজ্জতা ও অসুস্থতা উপস্থিত হইয়া থাকে। অতএব ঐ গুণ পরিত্যাগ করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। এক্ষণে আমি গ্রীষ্মকালে সুশীতল হ্রদের ন্যায় ব্রহ্মকে আশ্রয়পূৰ্ব্বক সমুদয় কার্য্যে সখানুভব করিতেছি। কামজনিত ঐহিক সুখ ও পারত্রিক সুখসমুদয় তৃষ্ণাক্ষয়জনিত সুখের ষোড়শাংশের একাংশও নহে। অতঃপর আমি ভীষণ শত্রুর ন্যায় কামকে বিনাশপূর্ব্বক শাশ্বত ব্রহ্মরূপ সুখময় পুরে প্রবেশ করিয়া নরপতির ন্যায় পরমসুখে অবস্থান করিব।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! মহাত্মা মঙ্কি এইরূপে গোবৎসনাশজনিত বৈরাগ্যপ্রভাবে বিষয়বাসনা পরিত্যাগ করিয়া ব্রহ্মানন্দস্বরূপে উৎকৃষ্ট সুখসম্ভোগপূৰ্ব্বক অমরত্ব লাভ করিয়াছিলেন।”