১৮১. পাপ-পুণ্যের কুফল-সুফল-কৰ্ম্মগতি

১৮১তম অধ্যায়

পাপ-পুণ্যের কুফল-সুফল-কৰ্ম্মগতি

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! দান, যজ্ঞ, তপস্যা ও গুরুশুশ্রূষা প্রজ্ঞা ও শ্ৰেয়োলাভের হেতু কি না, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! বুদ্ধি কামক্রোধাদিযুক্ত হইলেই চিত্ত পাপকর্ম্মে নিরত হয় এবং পাপকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলেই অতি ক্লেশকর লোকে অবস্থান করিতে হয়। পাপাত্মা ব্যক্তিরাই দরিদ্র হইয়া বারংবার দুর্ভিক্ষ, ক্লেশ, ভয় ও মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করে। আর দমগুণান্বিত শুভাচারনিষ্ঠ ব্যক্তিরা ধনাঢ্য হইয়া বারংবার উৎসব, স্বর্গ ও সুখসম্ভোগ করিয়া থাকেন। আত্মজ্ঞানশূন্য নাস্তিকদিগকে হস্তুবন্ধনী রজ্জুদ্বারা বন্ধন ও নগর হইতে নির্ব্বাসিত হইয়া ব্যাল [হস্তবন্ধনের দড়ি], কুঞ্জর, সর্প ও তস্করপরিপূর্ণ অরণ্যমধ্যে অবস্থান করিতে হয়। আর যাঁহারা সাধুসহবাসে অনুরক্ত, বদান্য এবং দেবতা ও অতিথিপ্রিয়, তাঁহারা জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির তুল্য পদবীতে পদার্পণ করেন। অধাৰ্মিক ব্যক্তিগণ ধান্যমধ্যে পুলাক [অসার ধান্য—আগরা বা চিটা] ও পক্ষিমধ্যে মশকের ন্যায় মনুষ্যমধ্যে নিতান্ত অপকৃষ্ট বলিয়া পরিগণিত হয়। পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্ম ছায়ার ন্যায় মনুষ্যের অনুগামী হইয়া মনুষ্য শয়ন করিলে শয়ন, অবস্থিতি করিলে অবস্থান, গমন করিলে গমন এবং কাৰ্য্য আরম্ভ করিলে কার্য্যানুষ্ঠান করিতে থাকে। ফলতঃ সকলকেই পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্মানুসারে ফলভোগ করিতে হয়। কাল জীবগণের কৰ্ম্ম অনুসারেই তাহাদিগকে আকর্ষণ করিতেছে। ফলপুষ্প যেমন কোন চেষ্টা না করিলেও নিয়মিত সময়ে পরিপক্ক হয়, তদ্রূপ পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্মফলও যথাসময়ে পরিণত হইয়া থাকে। ফলভোগদ্বারা পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্মের ক্ষয় হইলে মনুষ্যকে আর তাহার ফলস্বরূপ সম্মান, অপমান, লাভ, অলাভ এবং বৃদ্ধি ও ক্ষয় প্রাপ্ত হইতে হয় না।

“মানবগণ গর্ভশয্যায় [মাতার উদরে] শয়ান থাকিয়াও পূৰ্ব্বজন্মাকৃত কৰ্ম্মানুসারে সুখদুঃখ ভোগ করিয়া থাকে। ফলতঃ মনুষ্য বাল্য, যৌবন ও বার্দ্ধক্য প্রভৃতি যে অবস্থায় যেরূপ শুভাশুভ কার্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে সেই অবস্থায় তদনুরূপ ফলভোগ করিতে হয়। যেমন গোষ্ঠমধ্যে সহস্র সহস্ৰ ধেনু বর্ত্তমান থাকিলেও বৎস আপনার মাতার নিকটে গমন করে, তদ্রূপ পূৰ্ব্বকৃত কৰ্ম্মসমুদয়। কৰ্ত্তার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া থাকে। মনুষ্য বিষয়বাঞ্ছা পরিত্যাগ করিতে পারিলেই প্ৰক্ষালিত বস্ত্রের ন্যায় পরিশুদ্ধ হইয়া মোক্ষপদলাভে সমর্থ হয়। যাঁহারা দীর্ঘকাল তপোবনে বাস করিয়া তপানুষ্ঠানদ্বারা পাপরাশি দূরীকৃত করিতে সমর্থ হয়েন, তাঁহাদিগেরই অভীষ্টসিদ্ধি হইয়া থাকে। যেমন আকাশমার্গে পক্ষিগণের এবং সলিলমধ্যে মৎস্যসমূহের গমনকালে পদচিহ্ন দৃষ্ট হয় না, তদ্রূপ ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিদিগের গতিও লক্ষিত হইবার নহে। যাহা হউক, এক্ষণে অন্যান্য বাগাড়ম্বর বা দোষকীর্ত্তনে প্রয়োজন নাই, কেবল এইমাত্র বলিলেই পৰ্য্যাপ্ত হইবে যে, মনুষ্য বিবেচনাপূৰ্ব্বক আপনার হিতোপযোগী কার্য্যানুষ্ঠান করিলেই শ্ৰেয়োলাভ করিতে পারে।”