১৫৮. পাপ উৎপত্তির স্থান—লোভের প্রভাব

১৫৮তম অধ্যায়

পাপ উৎপত্তির স্থান—লোভের প্রভাব

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কি হইতে পাপ প্রবর্ত্তিত হইয়া থাকে, আমি তাহা প্ৰকৃতরূপে শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! যাহার প্রভাবে পাপ প্রবর্ত্তিত হয়, আমি তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একমাত্র লোভই লোকের সমুদয় পুণ্য গ্রাস করিতেছে। লোভ হইতে পাপ ও দুঃখ প্রবর্ত্তিত হইয়া থাকে। লোকে যে শঠতাচরণে প্রবৃত্ত হইয়া পাপে আসক্ত হয়, লোভই তাহার মূল। লোভ হইতেই ক্রোধ, কাম, মোহ, মায়া, অভিমান, গৰ্ব্ব, পরাধীনতা, অক্ষমা, নির্লজ্জতা, শ্রীনাশ, ধৰ্ম্মক্ষয়, চিন্তা ও অকীৰ্ত্তি প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে। লোভই লোকের কৃপণতা, বিষয়তৃষ্ণা, কুকর্ম্মে প্রবৃত্তি ও বিদ্যাভিমান, রূপ ও ঐশ্বর্য্যের গর্ব্ব, পরের অনিষ্টচিন্তা, অবজ্ঞা, অবিশ্বাস, কপট ব্যবহার, পরস্বাপহরণ ও পরদারাভিগমনের বাসনা, মানসিক আবেগ, ঔদারিকতা, দারুণ মৃত্যুভয়, বলবতী ঈর্ষা, পরনিন্দাশ্রবণ-প্রবৃত্তি, আত্মশ্লাঘা ও অসাধারণ সাহসিকতা জন্মাইয়া দেয়। মনুষ্যগণ কি বাল্য, কি কৌমার, কি যৌবন কোন অবস্থাতেই লোভ পরিত্যাগ করিতে সমর্থ নহে; উহারা জরাজীর্ণ হইলেও লোভ কদাচই জীর্ণ হয় না। অগাধসলিলসম্পন্ন অসংখ্য স্রোতস্বতীদ্বারাও যেমন সাগর পরিপূর্ণ হইতে পারে না, তদ্রূপ ফললাভদ্বারা লোভ কদাচ উপশমিত হয় না। নষ্টবস্তু লাভ ও বিবিধ ভোগদ্বারা যাহাকে পরিতৃপ্ত করা যায় না এবং দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব, অসুর, উরগ ও অন্যান্য প্রাণীগণ যাহার প্রভাব অবগত হইতে সমর্থ নহেন, জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি সেই লোভকে মোহের সহিত পরাজয় করিবেন। যাহারা অধীর প্রকৃতি ও লুব্ধ, তাহারা সততই অহঙ্কার, পরের অনিষ্টচেষ্টা, পরনিন্দা, ক্রূরতা ও মাৎসর্য্য প্রকাশ করিয়া থাকে। যাঁহারা বহুদর্শী হইয়া শাস্ত্ৰসিদ্ধান্ত স্মরণ ও অন্যের সংশয়াপনোদন করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগকেও লোভের বশীভূত হইলে কষ্টভোগ করিতে হয়। লুব্ধেরা সততই ক্রোধদ্বেষপরায়ণ ও শিষ্টাচারপরিশুন্য হইয়া থাকে। উহারা তৃণাচ্ছন্ন কূপের ন্যায় লোকেরও অনিষ্টজনক। উহাদিগের বাক্য অতি মধুর, কিন্তু হৃদয় ক্রূরভাব-পরিপূর্ণ। উহারা কপট ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া ধর্ম্ম প্রচার করিতে প্রবৃত্ত হয়। উহারা অতি ক্ষুদ্রাশয় ও জগতের দস্যুস্বরূপ। ঐ দুরাত্মারা যুক্তিবল অবলম্বনপূৰ্ব্বক অধৰ্ম্মকেও ধৰ্ম্ম বলিয়া প্রখ্যাপিত [প্রকাশিত] ও সংস্থাপিত [প্রমাণিত] এবং সৎপথ এককালে উন্মূলিত করে। অহঙ্কার, ক্রোধ, হর্ষ, শোক ও অভিমান নিরন্তর উহাদিগেরই আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আছে। ফলতঃ উহাদের ন্যায় অশিষ্ট আর কেহই নাই।

শিষ্টজনের লক্ষণ

“এক্ষণে শিষ্টদিগের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যাঁহাদিগের পুনর্জ্জন্মগ্রহণের ভয় ও নরকভয় নাই, যাঁহাদিগের প্রিয় ও অপ্রিয় উভয়ই তুল্য, যাঁহাদের ভোগ্য বস্তুতে কদাচই লোভ জন্মে না, যাঁহারা শিষ্টাচারপরায়ণ, ইন্দ্রিয়নিগ্রহশীল ও সত্যব্রতনিরত, যাঁহাদিগের সুখদুঃখে কিছুমাত্র আস্থা নাই, যাঁহারা পরমদয়ালু, দানশীল, পরোপকারী, অতি ধীরস্বভাব ও সৰ্ব্বধৰ্ম্মজ্ঞ, যাঁহারা কদাচ অন্যের দ্রব্য প্রতিগ্রহ করেন না; সতত ভক্তিসহকারে পিতৃলোক, দেবতা ও অতিথিগণের সৎকার করিয়া থাকেন এবং অন্যের হিতসাধনাৰ্থ প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত প্রদান করিতেও কুণ্ঠিত হয়েন না, সেই সমস্ত ধর্ম্মপ্রচারকদিগকে কেহই বিচলিত করিতে পারে না। তাঁহাদিগের সচ্চরিত্রতা কিছুতেই বিলুপ্ত হইবার নহে। তাঁহারা নির্ভীক, সৎপথবৰ্ত্তী ও অহিংসক; সাধুলোকসমুদয় সতত তাঁহাদিগের সেবা করিয়া থাকেন। ঐ সমস্ত মহাত্মারা কাম ক্রোধ-বিবর্জ্জিত, মমতা ও অহঙ্কারশূন্য, নিত্যব্রতপরায়ণ ও পরম সম্মানাস্পদ[সম্মানের পাত্র]; অতএব সতত তাঁহাদিগের উপাসনা ও তাঁহাদিগকে নিরন্তর ধর্ম্মের মর্ম্ম জিজ্ঞাসা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তাঁহারা ধনলোভ বা যশের লোভে ধর্ম্ম পরিগ্রহ [গ্রহণ আচরণ] করেন না; শরীররক্ষণোপযোগী আহারাদি কার্য্যের নায় ধৰ্ম্ম অবশ্যকর্ত্তব্য বলিয়াই উহার অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। তাঁহারা কপট ও পাষণ্ডদিগের ধৰ্ম্মের সবিশেষ অনাদর প্রদর্শন করেন। শোক, লোভ ও মোহ তাঁহাদিগকে কদাচ অভিভূত করিতে সমর্থ হয় না। তাঁহারা সত্যবাদী ও সরল-স্বভাব। অতএব তুমি প্রতিনিয়ত তাঁহাদিগের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করিবে; তাঁহারা লাভে হর্ষপ্রকাশ করেন না এবং নিরাশ হইলেও বিষণ্ন হয়েন না। তাঁহারা নির্ম্মলপ্রকৃতি, সত্ত্বগুণাবলম্বী ও সমদর্শী; তাঁহাদিগের জীবন ও মৃত্যু উভয়ই তুল্য। তুমি ইন্দ্রিয়নিগ্রহশীল ও অপ্রমত্ত হইয়া সেই সমস্ত ধর্ম্মপ্রিয় মহানুভবদিগকে অর্চ্চনা করিবে। দৈবপ্রভাবেই লোকের বাক্য কখন বিপদ ও সকল সম্পদের হেতু হইয়া উঠে।”