১৯২. বানপ্রস্থ আশ্রম

১৯২তম অধ্যায়

বানপ্রস্থ আশ্রম

“ভৃগু বলিলেন, ‘হে ভরদ্বাজ! বানপ্রস্থীরা স্বধৰ্ম্মানুসারে মৃগ, মহিষ, বরাহ, শার্দ্দূল ও বন্য মাতঙ্গসমাকীর্ণ অরণ্যে তপানুষ্ঠান এবং পবিত্র তীর্থ, নদী ও প্রস্রবণ প্রভৃতি বিবিধ প্রদেশ প্রদর্শনপূর্ব্বক সঞ্চরণ করিয়া থাকেন। গ্রাম্য বস্ত্র, আহার ও উপভোগে তাঁহাদিগের অভিরুচি থাকে না। উঁহারা বন্য ফলমূল, পত্র ও ওষধি পরিমিতরূপে ভোজন; ভূমি, পাষাণ, বালুকাময় প্রদেশ, কর্কর ও ভস্মের উপর শয়ন; কাশ, কুশ, চর্ম্ম ও বল্কল পরিধান; কেশ শ্মশ্রু নখ লোম ধারণ; নিয়মিত সময়ে স্নান এবং যথানিয়মে বলি ও হোমের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। ইঁহারা সমিৎ, কুশ ও কুসুম প্রভৃতি পূজাপহার সংগৃহীত ও সম্মার্জ্জত [সন্ধাঙ্গ আপোমার্জ্জনাদি] না করিয়া কদাচ বিশ্রাম লাভ করেন না। অনবরত শীত, উত্তাপ, বৃষ্টি ও বায়ু সহ্য করাতে উঁহাদিগের ত্বক্‌সমুদয় [চৰ্ম্মবিদীর্ণ—চামড়া ফেটে যাওয়া] ভিন্ন এবং বিবিধ নিয়ম ও আহারসঙ্কোচদ্বারা মাংস ও শোণিত শুষ্ক হইয়া যায়। তাঁহারা কেবল কঙ্কালমাত্রাবশিষ্ট দেহ ধারণ করিয়া থাকেন। ঐ মহাত্মারা অতি সুধীর। যিনি এইরূপ ব্রহ্মর্ষিবিহিত ব্রত অনুষ্ঠান করেন, তিনি অগ্নির ন্যায় দোষসমুদয় দগ্ধ ও দুর্জ্জয় লোকসমুদয় আপনার আয়ত্ত করিতে পারেন।

ভিক্ষু আশ্রম-সন্ন্যাস

“এক্ষণে পরিব্রাজকদিগের আচার কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পরিব্রাজকেরা অগ্নি, ধন, কলত্র ও অন্যান্য ভোগ্যদ্রব্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক স্নেহপাশবিমুক্ত হইয়া ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিয়া থাকেন। ঐ মহাত্মারা লোষ্ট্র ও কাঞ্চন সমান জ্ঞান করেন; ধর্ম্মার্থকামে কদাচ আসক্ত হয়েন না; কি শত্ৰু, কি মিত্র, কি উদাসীন, সকলেরই প্রতি সমভাবে, দৃষ্টিপাত করেন এবং কায়মনোবাক্যে জরায়ুজ, অণ্ডজ ও উদ্ভিদগণের কোন অপকারসাধন করেন না। তাঁহাদিগের আবাসস্থান নির্দ্দিষ্ট নাই; তাঁহারা নিরন্তর পর্ব্বত, পুলিন বৃক্ষমূল ও দেবগৃহে পরিভ্রমণ করিয়া থাকেন। ঐ মহাত্মারা কখন গ্রামে ও কখন বা নগরে বাস করিবার নিমিত্ত গমন করেন। কিন্তু নগরে একাদিক্রমে পাঁচরাত্রি ও গ্রামে একরাত্রি ব্যতীত অবস্থান করেন না। তাঁহারা গ্রাম বা নগরমধ্যে গমন করিয়া কোন সদাশয় ব্রাহ্মণের আবাসে প্রবেশপূৰ্ব্বক তথায় অবস্থান করিয়া থাকেন। তাঁহারা ভিক্ষার্থ কাহারও নিকট কিছু প্রার্থনা করেন না, যদৃচ্ছালব্ধ দ্রব্যেই তৃপ্তিলাভ করিয়া থাকেন এবং কদাচ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও অহঙ্কারে অভিভূত ও পরনিন্দা ও পরহিংসায় প্রবৃত্ত হয়েন না। শাস্ত্রে কথিত আছে যে, যিনি প্রাণীগণকে অভয় প্রদানপূর্ব্বক সঞ্চরণ করেন, তাঁহার কাহা হইতেও ভয় উৎপন্ন হয় না; যিনি আপনাতে শারীর অগ্নি সমাহিত করিয়া সেই অগ্নির উদ্দেশে আপনার মুখে ভিক্ষালব্ধ দ্রব্যজাতরূপ হবিঃ প্রদান করেন, তিনি সাগ্নিকদিগের লোক লাভ করিতে সমর্থ হয়েন। যিনি সঙ্কল্পহীন বুদ্ধি অবলম্বনপূৰ্ব্বক বিশুদ্ধচিত্তে শাস্ত্রানুসারে মোক্ষাশ্রম আশ্রয় করেন, তিনিই ইন্ধনশূন্য [কাষ্ঠ বিনা স্বয়ং বহ্নিতেজের] জ্যোতির ন্যায় প্রশান্তভাবে ব্রহ্মলোকে গমন করিয়া থাকেন।

“ভরদ্বাজ কহিলেন, ‘ব্ৰহ্মণ! আমরা শুনিয়াছি যে, এই ভারতবর্ষের পর অন্য লোক বিদ্যমান আছে। কিন্তু উহা ত’ কাহার নয়নগোচর হয় না; অতএব ঐ লোক কিরূপ, তাহা অবগত হইতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে; আপনি কীৰ্ত্তন করুন।’

কর্ম্মভূমি ভারতের পবিত্র উত্তরাখণ্ড প্রভাব

“ভৃগু কহিলেন, ‘তপোধন! উত্তরদিকে হিমালয়ের পার্শ্বদেশে এক সর্ব্বগুণান্বিত পরমপবিত্র প্রদেশে পাপবিহীন মঙ্গলজনক লোক বিদ্যমান রহিয়াছে। লোভমোহবিবর্জ্জিত পাপহীন পবিত্রচিত্ত মানবগণ ঐ লোকে নিরুপদ্রবে কালহরণ করেন। তথায় অকালমৃত্যু বা ব্যাধির নামগন্ধও নাই; এই সমস্ত গুণ থাকাতেই ঐ স্থান স্বর্গতুল্য বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। ঐ স্থানে সকলেই পরদারগমনে বিরত, স্ব স্ব পত্নীর প্রতি অনুরক্ত, পরস্পর নিপীড়নে পরাঙ্মুখ ও বিস্ময়বিহীন হইয়া অবস্থান করিতেছেন। তথায় কিছুমাত্র অধৰ্ম্ম নাই। কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে সন্দিগ্ধ হয় এবং তথায় কার্য্যানুষ্ঠানের ফল প্রত্যক্ষ প্রতীয়মান হইয়া থাকে। সেই লোকে কেহ কেহ অপূৰ্ব্ব অট্টালিকাবাসী ও সুবর্ণালঙ্কারভূষিত হইয়া বিবিধ পানীয় পান ও ভক্ষ্যদ্রব্য ভোজনপূৰ্ব্বক সমুদয় কামনা পূর্ণ করিতেছেন, কেহ কেহ ভোগবাসনা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরমাত্মার ধ্যানে নিরত রহিয়াছেন এবং কেহ কেহ কঠিন পরিশ্রমদ্বারা যোগবল লাভ করিতেছেন।

ফলতঃ ঐ লোক ভারতবর্ষ অপেক্ষা অনেকাংশে উৎকৃষ্ট। ইহলোকে কেহ ধার্ম্মিক, কেহ নিষ্ঠুর, কেহ সুখী, কেহ দুঃখী, কেহ ধনবান্ এবং কেহ বা নিৰ্দ্ধন হইয়া থাকে। মূর্খ ব্যক্তিরা নিরন্তর শ্ৰম, ভয়, মোহ, ক্ষুধা ও অর্থলোভে মুগ্ধ হয়। ইহলোকে ধর্ম্মাধর্ম্মবিষয়িণী বিবিধ বার্ত্তা বিদ্যমান আছে। যে ব্যক্তি জ্ঞানপ্রভাবে ঐ উভয়বিধ বার্ত্তা জ্ঞাত হইতে পারেন, তিনি কখনই পাপে লিপ্ত হয়েন না। যে ব্যক্তি দম্ভ, চৌর্য্য, পরিবাদ, অসূয়া, পরপীড়ন, হিংসা, খলতা ও মিথ্যাবাক্যপ্রয়োগে প্রবৃত্ত হয়, তাহার তপস্যা ক্ষয় হইয়া যায়। আর যিনি ঐসকল কার্য্যে বিরত থাকেন, তাঁহার তপস্যা পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। ইহলোকে ধৰ্ম্মাধর্ম্মের বিচার ও কর্ম্ম বিবিধ প্রকার। ইহার নাম কৰ্ম্মভূমি; লোকে এই স্থানে শুভ ও অশুভ উভয়বিধ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। তন্মধ্যে যাঁহারা শুভকার্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তাঁহাদিগের শুভ ফল, আর যাহারা অশুভকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাদিগের অশুভ ফল লাভ হয়।

‘পূৰ্ব্বে প্রজাপতি, দেবতা ও ঋষিগণসমভিব্যাহারে ইহলোকে তপানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক পবিত্র হইয়া ব্রহ্মলোক লাভ করিয়াছেন। এই স্থানে যাঁহারা যোগে সমাদর ও পুণ্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন, তাঁহাদিগের পূৰ্ব্বোক্ত পৃথিবীর উত্তরভাগস্থিত পবিত্র লোক লাভ হইয়া থাকে; আর যাহারা পুণ্যকাৰ্য্যে বিরত হয়, তাহারা ক্ষীণায়ু হইয়া কলেবর পরিত্যাগপূলক তির্য্যগযোনিতে জন্মগ্রহণ করে। লোভমোহসমন্বিত পরস্পর নিপীড়ননিরত [হিংসাপরায়ণ] পাপাত্মারাই উত্তরদিকস্থিত উৎকৃষ্ট লোক লাভ করিতে না পারিয়া বারংবার ইহলোকে জন্মগ্রহণ করিতেছে। যাঁহারা সংযত হইয়া ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বনপূৰ্ব্বক বিধানানুসারে গুরুশুশ্রূষা করেন, তাঁহারাই লোকসমুদয়ের গতির বিষয় পরিজ্ঞাত হইতে পারেন। হে ব্রহ্মন! এই আমি তোমার নিকট বেদোক্ত বৃত্তান্ত সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিলাম। যে ব্যক্তি লোকের কর্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য বিশেষরূপে অবগত হইতে পারেন, তাঁহাকেই বুদ্ধিমান বলিয়া নির্দেশ করা যায়।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তখন প্রতাপান্বিত ধর্ম্মপরায়ণ ভরদ্বাজ মহর্ষি ভৃগুকর্ত্তৃক এইরূপে অভিহিত হইয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে তাঁহার যথোচিত পূজা করিলেন। এই আমি তোমার নিকট জগতের সৃষ্টির বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম, অতঃপর তোমার যাহা শ্রবণ করিতে ইচ্ছা হয়, ব্যক্ত কর।”