১৭০. গৌতমের বক আতিথ্যগ্রহণ

১৭০তম অধ্যায়

গৌতমের বক আতিথ্যগ্রহণ

ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহারাজ! বক এই কথা কহিলে গৌতম তাহার মধুরবাক্যশ্রবণে বিস্মিত ও কৌতূহলান্বিত হইয়া অনিমেষনেত্রে তাহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন রাজধৰ্ম্ম গৌতমকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘ব্ৰহ্মন্! আমি কশ্যপের ঔরসে দাক্ষায়ণীর গর্ভে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছি। আপনি আমার নিকট আতিথ্য গ্রহণ করুন।’ সদাশয় বক এই বলিয়া যথানিয়মে তাঁহার পূজা করিয়া তাঁহাকে শালপুষ্পময় দিব্য-আসন, গঙ্গাসলিলান্তৰ্গত বৃহৎ বৃহৎ মৎস্য ও প্রদীপ্ত হুতাশন প্রদান করিল এবং গৌতম প্রীতমনে ভোজন করিলে তাঁহার শ্ৰমাপনোদনের নিমিত্ত স্বীয় পক্ষপুট[পক্ষদ্বয়]দ্বারা বীজন করিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে গৌতমের শ্রম দূর হইলে রাজধৰ্ম্ম তাঁহার নাম-গোত্র জিজ্ঞাসা করাতে তিনি এইমাত্র উত্তর প্রদান করিলেন যে, আমি ব্রাহ্মণ, আমার নাম গৌতম।’ অনন্তর রাজধৰ্ম্ম গৌতমের নিমিত্ত দিব্যপুস্পযুক্ত পর্ণময় সুবাসিত শয্যা প্রস্তুত করিয়া দিল; গৌতমও পরমসুখে তাহাতে শয়ন করিলেন। তখন কশ্যপতনয় গৌতমকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, ‘ব্ৰহ্মন্! আপনি কি নিমিত্ত এ স্থানে আগমন করিয়াছেন?’ গৌতম কহিলেন, ‘বিহঙ্গম! আমি নিতান্ত দীনহীন; কিঞ্চিৎ অর্থের নিমিত্ত সমুদ্রগমনাভিলাষে বহির্গত হইয়া এস্থানে উপস্থিত হইয়াছি।’ তখন রাজধৰ্ম্ম কহিল, ‘ব্রহ্মন্! আপনার উৎকণ্ঠিত হইবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। আপনি অচিরাৎ কৃতকার্য্য হইয়া অর্থসমভিব্যাহারে গৃহে গমন করিবেন। বৃহস্পতি পরম্পরাগত , দৈব, কাম্য ও মৈত্র [পৈতৃক, ভাগ্যবলে লব্ধ, প্রার্থনাদ্বারা প্রাপ্ত ও বন্ধু হইতে সংগৃহীত] এই চারি প্রকার অর্থাগমের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। এক্ষণে আপনার সহিত আমার মিত্রতা জন্মিয়াছে; অতএব আপনি যাহাতে ধনবান্ হন, আমি তদ্বিষয়ে বিশেষ যত্ন করিব। বক এই কথা বলিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিল; ব্রাহ্মণ পরমসুখে নিদ্রিত হইলেন।

“অনন্তর রজনী প্রভাত হইলে রাজধৰ্ম্ম গৌতমকে একটি সুদীর্ঘ পথ প্রদর্শনপূৰ্ব্বক কহিল, ‘ব্রহ্ম! আপনি এই পথে গমন করিলেই কৃতকার্য্য হইবেন। এখান হইতে তিন যোজন দূরে বিরূপাক্ষনামে মহাবলপরাক্রান্ত রাক্ষসাধিপতি বাস করিতেছেন। তিনি আমার পরম বন্ধু, আপনি তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেই তিনি আপনার মনোরথ পূর্ণ করিবেন, সন্দেহ নাই।’ রাজধৰ্ম্ম এই কথা কহিলে গৌতম সেই বিহঙ্গনির্দ্দিষ্ট পথে স্বেচ্ছানুসারে অমৃততুল্য ফলভক্ষণ ও চন্দনাগুরুভূয়িষ্ঠ [সুগন্ধি চন্দন ও অগুরুকাষ্ঠবহুল] বনাবলী দর্শন করিতে করিতে দ্রুতপদসঞ্চারে গমন করিয়া মেরুব্রজনামক নগরে উপস্থিত হইলেন। ঐ নগরের তোরণ, প্রাকার, কপাট ও অর্গলসমুদয় প্রস্তরময়। গৌতম তথায় উপস্থিত হইবামাত্র দ্বারবান রাক্ষসরাজের নিকট তাঁহার আগমনবার্ত্তা নিবেদন করিল। তখন রাক্ষসরাজ স্বীয় সখা রাজধৰ্ম্ম গৌতমকে প্রেরণ করিয়াছে বুঝিতে পারিয়া ভৃত্যগণকে আজ্ঞা প্রদান করিলেন যে, তোমরা অচিরাৎ নগরদ্বার হইতে গৌতমকে আমার নিকট উপনীত কর। ভৃত্যগণ আজ্ঞাপ্রাপ্তিমাত্র শ্যেনের ন্যায় দ্রুতগমনে দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া গৌতমকে কহিল, ‘মহাশয়! রাক্ষসাধিপতি বিরূপাক্ষ আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বাসনা করিতেছেন; অতএব আপনি শীঘ্র আগমন করুন।’ গৌতম ভৃত্যগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া রাক্ষসাবিপতির দর্শনবাসনায় বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে পুরশোভা নিরীক্ষণ করিতে করিতে দূতগণের সহিত দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলেন।”