১৬০. ধৰ্ম্মের সার—ইন্দ্রিয়সংযম

১৬০তম অধ্যায়

ধৰ্ম্মের সার—ইন্দ্রিয়সংযম

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ইহলোকে স্বাধ্যায়নিরত ধর্ম্মপরায়ণ মনুষ্যের কিরূপে শ্রেয়োলাভ হইতে পারে? ধৰ্ম্মপথ অতি বৃহৎ ও বহুশাখাসঙ্কুল; অতএব কিরূপে সংক্ষেপপূৰ্ব্বক ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করিলে কৃতকার্য্য হওয়া যায়, আর ধর্ম্মের মূলই বা কি, তৎসমুদয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তুমি যাহা শ্রবণ করিয়া অমৃতপায়ীর [অমৃতপানকারীর] ন্যায় তৃপ্তিলাভ করিবে, যদ্দ্বারা তোমার যারপরনাই শ্ৰেয়োলাভ হইবে, আমি সেই বিষয় তোমার নিকটে কীৰ্ত্তন করিতেছি। মহর্ষিগণ স্বীয় স্বীয় বিজ্ঞানবলে নানাপ্রকার ধর্ম্ম নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন, তন্মধ্যে ইন্দ্রিয়সংযমই তাঁহাদের সকলের মতে সৰ্ব্বপ্রধান। তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতেরা দমগুণকে [ইন্দ্রিয়দমনকে—বাহ্যেন্দ্রিয় সংযমশক্তিকে] মুক্তিলাভের কারণ বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। দমগুণ সকল লোকেরই, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণের সনাতন ধর্ম্ম। দমগুণপ্রভাবেই ব্রাহ্মণের কার্য্যসিদ্ধি হইয়া থাকে। দমগুণ দান, যজ্ঞ ও শাস্ত্রজ্ঞান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। উহা দ্বারা তেজ পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। দমগুণের তুল্য পবিত্র আর কিছুই নাই, লোকে দমগুণপ্রভাবেই পাপবিহীন ও তেজস্বী হইয়া ব্রহ্মপদ লাভ করিয়া থাকে। দমগুণ অতি উৎকৃষ্ট ধৰ্ম্ম। দমগুণ হইতে ইহলোকে সিদ্ধি ও পরলোকে সুখলাভ করিতে পারা যায়। দমগুণসম্পন্ন ব্যক্তি অনায়াসে. উৎকৃষ্ট ধর্ম্মলাভে সমর্থ হয় এবং নির্ভয়ে নিদ্রাসুখানুভব, নির্ভয়ে জাগরণ ও নির্ভয়ে জনসমাজে বিচরণ করিতে পারে। তাঁহার অন্তঃকরণ সততই প্রসন্ন থাকে। যে ব্যক্তি দমগুণবিহীন, তাহাকে নিরন্তর ক্লেশ ভোগ করিতে হয় এবং সে আপনার দোষে বহু অনর্থ উৎপাদন করে। চারি আশ্রমেই দমগুণ উৎকৃষ্ট ব্ৰত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। এক্ষণে আমি দমগুণ হইতে যেসমুদয় গুণ উৎপন্ন হয়, তাহা তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। দমগুণই ক্ষমা, ধৃতি, অহিংসা, সমদর্শিতা, সত্য, সরলতা, ইন্দ্রিয়পরাজয়, দক্ষতা, মৃদুতা, লজ্জা, স্থিরতা, অদীনতা, অক্রোধ, সন্তোষ, প্রিয়বাদিতা, অহিংসা, অনসূয়া, গুরুপূজাপ্রবৃত্তি ও দয়ার উৎপত্তির কারণ। দমগুণান্বিত মহাত্মারা কদাচ ক্রূর ব্যবহার, মিথ্যাবাক্যপ্রয়োগ এবং অন্যের অপমান, উপাসনা বা নিন্দা করেন না; তাঁহারা কাম, ক্রোধ, লোভ, দর্প, আত্মশ্লাঘা, রোষ, ঈর্ষা ও বিষয়ানুরাগ এককালে পরিত্যাগ করিয়া থাকেন; অনিত্য সুখলাভে তাঁহাদের কখনই তৃপ্তি হয় না; সম্বন্ধ-সংযোগ জনিত মমতানিবন্ধন তাঁহাদিগকে কখনই ক্লেশ ভোগ করিতে হয় না। যে মহাত্মা গ্রাম্য ও আরণ্য ব্যবহার পরিত্যাগ করেন এবং কদাচ কাহার নিন্দা ও প্রশংসা করেন না, তিনি অচিরাৎ মুক্তিলাভে সমর্থ হয়েন। ব্রাহ্মণ সদাচারপরায়ণ, প্রসন্নচিত্ত ও আত্মতত্ত্বজ্ঞ। ব্রাহ্মণও বিবিধ সংসর্গ হইতে মুক্ত হইতে পারিলে ইহলোকে সম্মান ও পরলোকে উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে পারেন। সাধুব্যক্তিরা যেসমস্ত কার্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তৎসমুদয়ই জ্ঞানবান্ তপস্বীর পথস্বরূপ। অতএব সেই পথ পরিত্যাগ করা কদাপি বিধেয় নহে। যে জিতেন্দ্রিয় জ্ঞানবান্ ব্যক্তি সংসারাশ্রম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অরণ্যবাস আশ্রয় করিয়া সেই পথ অবলম্বন করেন, তিনি অনায়াসে ব্রহ্মত্ব লাভ করিতে সমর্থ হয়েন।

সংযমীর সুগতি

“যে ব্যক্তি প্রাণীগণ হইতে কিছুমাত্র ভয় না করেন এবং প্রাণীগণ যাঁহা হইতে কিছুমাত্র ভীত না হয়, তাঁহাকে কখনই পরলোকে শঙ্কিত হইতে হয় না! যিনি অর্থ সঞ্চয় না করিয়া সত্যার্য্যানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক উহা ব্যয় করেন এবং সৰ্ব্বভূতে সমদৃষ্টি হইয়া সকলের সহিত মিত্ৰতাচরণে প্রবৃত্ত হয়েন, তিনি চরমে ব্রহ্মে লীন হইয়া থাকেন। যাঁহারা গৃহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মোক্ষ আশ্রয় করেন, তাঁহারা চিরকাল তেজোময় লোকে অবস্থান করিতে সমর্থ হয়েন। যে ব্যক্তি যথাবিধি তপস্যা, বিবিধ বিদ্যা, ঐশ্বৰ্য্য ও সমুদয় কাৰ্য্য পরিত্যাগ করিয়া সত্যাভিলাষী, বিষয়রাগবিবর্জ্জিত [রূপ-রসাদি বিষয়াসক্তিশূন্য], প্রসন্নচিত্ত ও আত্মতত্ত্বজ্ঞ হইতে পারেন, তিনি ইহলোকে সম্মান ও পরলোকে স্বর্গলাভ করিয়া স্বেচ্ছানুসারে সমুদয় লোকে বিচরণ করিতে পারেন। দমগুণ প্রভাবেই হৃৎপদ্মনিহিত অবিরোধী [তুল্যভাবে সৰ্ব্বভূতের কল্যাণকর] সনাতন ব্রহ্মপদ প্রাপ্ত হওয়া যায়। জ্ঞানবান্ মহাত্মাদিগের পরলোকে ভয়ের কথা দূরে থাকুক, ইহলোকে পুনর্জ্জন্মনিবন্ধন ভয়ও তিরোহিত হয়। দমগুণের এই একমাত্র দোষ [ন্যূনতা—লৌকিক দৃষ্টিতে দৌর্ব্বল্য] লক্ষিত হইয়া থাকে যে, লোকে দমগুণান্বিত ব্যক্তিকে নিতান্ত অসমর্থ বিবেচনা করে। উহা ভিন্ন দমগুণের আর কিছুমাত্র দোষ নাই, প্রত্যুত বহুতর গুণই বিদ্যমান রহিয়াছে। সহিষ্ণু ব্যক্তি ক্ষমাগুণপ্রভাবে অসংখ্য লোককে বশীভূত করিতে পারেন। দমগুণসম্পন্ন ব্যক্তির অরণ্যগমনের প্রয়োজন কি? তিনি যে স্থানে বাস করেন, সেই স্থানই অরণ্য ও পুণ্যাশ্রম।”

বৈশম্পায়ন কহিলেন, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভীষ্মের মুখে এইরূপ অমৃতায়মান বাক্য শ্রবণপূৰ্ব্বক পরম পরিতুষ্ট হইয়া পুনরায় তাঁহাকে ধর্ম্মবিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন; মহাত্মা ভীষ্মদেবও যারপরনাই প্রীত হইয়া তাঁহার নিকট উহা কীৰ্ত্তন করিতে লাগিলেন।